উত্তরণ প্রতিবেদন: আলোর রোশনাইয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাংলার আকাশ। মুক্তির মহানায়কের জন্মশতবর্ষে নানা আয়োজন-আনুষ্ঠানিকতায় শ্রদ্ধা জানাল পুরো জাতি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে জনসমাগম কমিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আয়োজিত মুজিববর্ষের মূল অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে দেশের সব টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘মুক্তির মহানায়ক’ শিরোনামের দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণ রাত ৮টায়। ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর ও হাতিরঝিলেও চলে অনুষ্ঠান। মনোমুগ্ধকর পরিবেশনায় সাজানো অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত হয়েছে জাতির পিতার জীবনের আদর্শ, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের অধ্যায়। সেই সুবাদে অনুষ্ঠান উপভোগের পাশাপাশি মহান নেতার অবিনাশী কীর্তির কথা গভীরভাবে রেখাপাত করেছে গোটা জাতির মননে। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি।
রাত ৮টায় বঙ্গবন্ধুর জন্মক্ষণে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ থেকে আতশবাজি দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। সোনার বাংলার স্বপ্নমাখা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার বারতা দিয়েছে আতশবাজির সেই আলোকরেখা। এরপর মুজিববর্ষের উদ্বোধনী আয়োজনে দর্শক দেখেছে জাতীয় প্যারেড স্কয়ার থেকে ধারণকৃত বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রচারিত হয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাণী। জাতির উদ্দেশ্যে উদ্দীপনাময় ভাষণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুভূতি প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। প্রচারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও সংস্থার প্রধানদের বাণী।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর শত কণ্ঠে গাওয়া হয় মুজিববর্ষের থিম সংগীত ‘তুমি বাংলার ধ্রুবতারা/তুমি হৃদয়ের বাতিঘর’। এই গানে দেশের প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা। এছাড়া অনুষ্ঠানে পিতাকে নিয়ে শেখ রেহানার লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন শেখ হাসিনা। শত যন্ত্রসংগীতশিল্পীর সুরের মূর্ছনায় উপস্থাপিত হয়েছে জাতির পিতার জীবনের নানা অধ্যায়। শতাব্দীর মহানায়ক শীর্ষক মনোমুগ্ধকর থিয়েট্রিক্যাল কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, সাহস, সংগ্রামের বিবরণসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে পিক্সেল ম্যাপিং বা লেজার শোর মাধ্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
উদ্বোধনী আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে দর্শক দেখেছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের নির্দেশিত নয়ন জুড়ানো নৃত্য পরিবেশনা। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ভিত্তি করে সাজানো পরিবেশনাটির শিরোনাম ‘ফাদার : ভিশন অব দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’।
বিদ্যা-লোটে-গুতেরেসের মুখেও
বঙ্গবন্ধুর জয়গান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত ১৭ মার্চ মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন পাঁচ বিদেশি অতিথি। বার্তায় তারা মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর জয়গান, তার জীবন ও কর্মের ভূয়সী প্রশংসা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ওআইসি’র মহাসচিব ইউসুফ বিন আহমেদ আল ওথাইমান। এছাড়া শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে টুইট বার্তায় বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এদিকে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। খবর বাসসের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করে মুজিববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী গত ১৭ মার্চ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন এবং ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন উপলক্ষে তাকে ও বাংলাদেশের জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ভুটানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করেছেন। তারা এক হাজার ‘ঘি প্রদীপ’ জ্বালিয়ে তার বিদেহী আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ও দেশের জনগণের অব্যাহত শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকার ও বাংলাদেশের জনগণকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় এক টুইটার বার্তায় তিনি অভিনন্দন জানান। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের জীবন ও কর্মের জন্য সারাবিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জানান, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে রাষ্ট্রপতি
ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৭ মার্চ সকালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান তারা।
প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার সমাধিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পর স্বাধীনতার এই মহান স্থপতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে তারা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে করুণ সুর বাজানো হয়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ফাতেহা পাঠ করেন এবং জাতির পিতা ও ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শহিদদের আত্মার শান্তি চেয়ে বিশেষ মোনাজাতে শরিক হন। জাতির পিতার ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এবং শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এ-সময় উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ।
একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, আইজিপি ড. মুহম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, পিএমও সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীনসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা এবং পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে রক্ষিত পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পরে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সমাধি প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশ নেন।
সকালে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের পরপরই প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জাতির পিতার সমাধিসৌধ টুঙ্গিপাড়ায় আসেন।