সাইদ আহমেদ বাবু: গত ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সর্বশেষ ৫ নভেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন ২৬৪টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট নিয়ে এগিয়ে রয়েছেন। জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ৬টি ভোট। রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২১৪টি ভোট। এতে বুঝা যাচ্ছে নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন জো বাইডেন। শুধু আমেরিকা নয়, সারাবিশ্ব রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করে আছে এই নির্বাচনে কে জেতেন তা দেখার জন্য। কারণ, এই নির্বাচনের ফলাফল সারাবিশ্বের জনগণের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে। সন্দেহ নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম সুপার পাওয়ার। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে আমেরিকা এখনও বিশ্বের নাম্বার ওয়ান পরাশক্তি। বলতে দ্বিধা নেই আমেরিকার ভাগ্যের সাথে জড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীর ভাগ্যও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুটি দল। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন রিপাবলিকান। এ দলটিকে সেদেশে ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’ বলেও ডাকা হয়। রিপাবলিকানরা আদতে একটি রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল। ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি, করের হার কমানো, বন্দুক রাখার অধিকার এবং অভিবাসনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষে। অন্যদিকে জো বাইডেন হলেন ডেমোক্র্যাটদের পক্ষের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। ডেমোক্র্যাট দলটি উদারপন্থি মনোভাবের জন্য পরিচিত। নাগরিক অধিকার, অভিবাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে তাদের উদারপন্থার জন্য দলটি পরিচিত। ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, আমেরিকার শহরাঞ্চলে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন তুলনামূলকভাবে বেশি। আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ থাকে দুনিয়াব্যাপী। কার হাতে পরের চার বছরের জন্য শক্তিধর ওই রাষ্ট্রটির ক্ষমতা যাবে, তা জানার আগ্রহ সবার থাকাটাই স্বাভাবিক। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। নির্বাচনে কে জিতবেন, তা ফলাফল প্রকাশের আগে বোঝা মুশকিল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনমত জরিপও চলছে। প্রায় সব জনমত জরিপেই জো বাইডেন এগিয়ে থাকলেও নিশ্চিত করে কেউ-ই বলতে পারছেন না যে শেষ হাসি কে হাসবেন। এর আগের নির্বাচনে জনমত জরিপে এগিয়ে থাকলেও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে ডেমোক্র্যাটিক দলের হিলারি ক্লিনটনকে। এবার শেষ মুহূর্তে এসে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা প্রচারণায় জোর দিচ্ছেন সুইং স্টেটগুলোতে (দোদুল্যমান রাজ্যে)। এ কারণে মানুষের মোট ভোটের চেয়ে রাজ্য জয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব রাজ্যেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ৭ কোটির বেশি আগাম ভোট পড়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ৪ কোটি ৭০ লাখ আগাম ভোট পড়েছিল; কিন্তু এবার নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালেই চলতি মাসের প্রথম দিকে ওই সংখ্যাটি পার হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ভোটার ১৫ কোটি ৩০ লাখ। ভোটের এই গতি বজায় থাকলে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে এবার ভোট পড়ার হার সর্বোচ্চ হতে পারে। এবার গত ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোট পড়বে, যা ১৫ কোটির, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ ছাড়াবে। এর আগে এত ভোট পড়েছিল ১৯০৮ সালে। এই বিপুলসংখ্যক ভোট বদলে দিতে পারে প্রার্থীদের সব হিসাব-নিকাশ। হাতছাড়া হতে পারে নিশ্চিত জয় ভেবে নেওয়া অঙ্গরাজ্যও। আমেরিকার ভোটের ইতিহাসে এটি নতুন। কয়েকটি কারণে এবার আগাম ভোট পড়ছে বেশি। প্রথম কারণ হলো করোনাভাইরাস মহামারি। দ্বিতীয়ত; এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে ভোটারদের তীব্র আগ্রহ রয়েছে। অধ্যাপক ম্যাকডোনাল্ড বলেছেন, এবার যে হারে আগাম ভোট পড়ছে, তা এক কথায় বিস্ময়কর।
মার্কিন নির্বাচন অনেকটাই অন্যরকমের হয়। সাধারণত আমরা সব দেশের নির্বাচনেই দেখে থাকি, যে প্রার্থী সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছেন, তিনি জিতেছেন। তবে আমেরিকার ক্ষেত্রে তেমনটা নাও হতে পারে। কারণ বৃহৎ ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ভোটের ওপর নির্ভর করে জয়-পরাজয় নির্ধারণ হয় না। নির্ভর করে ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির ওপর এবং যে রাজ্যে জনসংখ্যা বেশি, তার ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যাও বেশি। আমেরিকার মানুষ সরাসরি ভোট দিয়ে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারে না। ইলেকটোরাল কলেজের জন্য নাগরিকরা ভোট দিয়ে থাকেন। ইলেকটোরাল কলেজ এবং আমেরিকান কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা এক। আমেরিকান কংগ্রেস হলো আমেরিকান পার্লামেন্ট, যার দুটি কক্ষÑ ‘দ্য সেনেট’ এবং ‘হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভস’। এক্ষেত্রে দ্য সেনেট হলো উচ্চকক্ষ এবং হাউস অব রিপ্রেসেনটেটিভস হলো নিম্নকক্ষ।
১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় সেটি একক কোনো দেশ ছিল না; বরং সেটি ছিল অনেকগুলো স্বাধীন রাজ্যের একটি সমন্বিত জোট। তাই এখনও আমরা দেখতে পাই, আমেরিকার প্রতিটি রাজ্যের আইন পরস্পরের চেয়ে কতটা আলাদা ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। সে যাই হোক, আমেরিকার গোড়াপত্তনের সময় নিউজার্সির মতো ছোট রাজ্যগুলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভার্জিনিয়া কিংবা নিউইয়র্কের মতো জনবহুল রাষ্ট্রগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্যের ভয়ে প্রচলিত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পথে যেতে চায়নি। তাই জাতীয় নির্বাচনে ছোট-বড় সব রাজ্যের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতেই এই ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থার অবতারণা। এছাড়া আম জনগণ সরাসরি ভোট দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং মানের চেয়ে সংখ্যার আধিপত্যে প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারেÑ এসব আশঙ্কায় মার্কিন জাতির জনকরা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বদলে পরোক্ষ গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছিলেন। যদিও অতীতে অনেকবারই এ-ব্যবস্থা বাতিলের দাবি উঠেছে এবং আদালতে চলেছে অনেক তর্ক-বিতর্ক, এখন অবধি পূর্ব পুরুষদের করা এই নিয়মই টিকে আছে মার্কিন মুল্লুকে।
আমেরিকার ২৪৪ বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই প্রধান দল রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বাইরে শুধু একবারই অন্য প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আমেরিকার জনগণ অসাধারণ সৌভাগ্যবান, স্বাধীনতার পরে ২৪৪ বছর কেটে গেছে; কিন্তু এর মধ্যে কখনও নির্বাচিত সরকারকে অসাংবিধানিক উপায়ে বিদায় দেবার চেষ্টা হয়নি। প্রেসিডেনসিয়াল নির্বাচন আজ পর্যন্ত কখনও স্থগিত হয়নি বা পিছিয়ে যায়নি। আমেরিকার সংবিধান যেহেতু রাষ্ট্রপতি প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ কংগ্রেস দুটোই সরাসরি জনসাধারণের দ্বারা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয় সেজন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকুক তার কোনো প্রভাব সরকারের সাহিত্যের ওপর পড়ে না। এমন অনেক সময় হয়েছে যে রাষ্ট্রপতি এক দলের লোক আর সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অন্য দলের; কিন্তু সরকার চালনায় অসুবিধা হয়নি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মানেই হাতি ও গাধার দ্বন্দ্ব। সরাসরি হাতি ও গাধাকে যুদ্ধে না নামিয়ে দিলেও এই দুই মার্কা নিয়ে যুদ্ধে নামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট পার্টি। গাধা প্রতীকটি প্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকার সপ্তম প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসন (১৮২৯-১৮৩৭)। ডেমোক্র্যাটদের গাধা হলো সহিষ্ণুতার প্রতীক আর রিপাবলিকানদের হাতি হলো বল ও শক্তির প্রতীক। ১৯৪৭ সালে ২২তম সংবিধান সংশোধনীর পর দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকার সুযোগ আর কারও নেই। মূলত আমেরিকার স্থপতি এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের নিমিত্তে এ আইনটি করা হয়েছে। রুজভেল্ট একমাত্র চারবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকার রেকর্ড আছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রতি চার বছরে একবার। প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালও চার বছর। নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরের মঙ্গলবার ধার্য করা আছে নির্বাচনের দিন। তাই যুগ যুগ ধরে একটুও নড়চড় হয় না নির্বাচনের দিনক্ষণের। আগের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চলাকালেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর। আমেরিকার ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট জন এফ ক্যানেডি। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণভাবে তার নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী মন্ত্রী নির্বাচন করেন, তারপর অবশ্য তাকে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়। ফলে এমন মানুষই মন্ত্রীর আসনে বসাতে পারেন, যিনি পেশাগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজের দপ্তরের বিষয় সম্বন্ধে খুব ভালোরকম জানেন এবং যার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাশা নেই, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিনি রাজনীতির লোক নন। অপরপক্ষে সংসদরা সিনেটর বা কংগ্রেসম্যান পুরোপুরি রাজনীতির লোক তারা নিজের অঞ্চলের স্বার্থ দেখেন এবং সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে মন্ত্রীদের জনস্বার্থ অনুযায়ী চলতে বাধ্য করেন একদিকে প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রিসভা, অন্যদিকে সংসদের দুই কক্ষ এই দুয়ের মধ্যে এ-ধরনের পরস্পর খবরদারির রক্ষাকবচ সংবিধানের মধ্যে থাকার ফলে কোনো পক্ষই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না। একে বলা হয় চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হলে সরকার অনেক সুষ্ঠুভাবে চলে।
আমেরিকার ভোটাররা ৩ নভেম্বর নির্ধারণ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তারা আরও চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউসে দেখতে চান কি-না। নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন, যিনি বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনেক বেশি পরিচিত। যদিও তিনি গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। ট্রাম্প না বাইডেন কে যাবেন হোয়াইট হাউসে? আমেরিকায় মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৫৩৮, যার মধ্যে শুধু ক্যালিফোর্নিয়াতেই রয়েছে সর্বোচ্চ ৫৫টি। ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর আমেরিকান ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ৫৩৮ সদস্য ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচন করবেন এবং ওই ইলেকটোরাল কলেজের নির্বাচিত ৫৩৮ সদস্য ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ রাজধানী ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল হিলে মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ভোট প্রদান করবেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীকে সর্বনিম্ন ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হবে। আর ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি আমেরিকান বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন।
২০০০ সালের ইলেকশনে শেষবার ঘটেছিল এমন ঘটনা। সেবার জর্জ ডাব্লিউ বুশ মেজরিটি ভোট পাননি ঠিকই; কিন্তু পেয়েছিলেন ২৭১টি ইলেকটোরাল ভোট। অন্যদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যালগোর অধিকাংশ পপুলার ভোট পেয়েও ইলেকটোরাল ভোটের চক্করে পড়ে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন ২৬৬টি ইলেকটোরাল ভোট। ৪৮.৪ শতাংশ ভোট পেয়েও অ্যালগোর হেরে গিয়েছিলেন ৪৭.৯ শতাংশ ভোট পাওয়া জর্জ বুশের কাছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন একজন ধনকুবের ব্যবসায়ী ও সেলেব্রিটি হিসেবে। রাজনীতির মাঠে পা ফেলার আগে তিনি ছিলেন বিশাল এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মালিক। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছিলেন ৩০৪টি ইলেকটোরাল ভোট আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পেয়েছিলেন ২২৭টি। নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী পেশাদার রাজনীতিবিদ হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ কম ভোট পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের অভিনব নির্বাচনী ব্যবস্থা ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চার বছরের পুরো মেয়াদ পার করে ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য রিপাবলিকান দল থেকে আবারও তিনি প্রার্থী হয়েছেন। তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট রাজনীতিতে, যার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
তবে ট্রাম্পের জন্য পজিটিভ দিক হলো, ১৯৯২-এর পর থেকে আর কোনো ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকেই পরাজিত করা যায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে গত ২৮ বছরে মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে দুই মেয়াদে কাজ করতে সুযোগ দেওয়ার একটা ট্র্যাডিশন দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারীকে বাইডেনের রানিংমেট হিসেবে বেছে নেওয়াটা মার্কিন সাম্রাজ্যের রক্ষণশীল এবং খ্রিষ্টীয় মৌলবাদী অংশটি-যাদের বিশাল ভোট ব্যাংক রয়েছে, তারা পছন্দ করছে না। এই অংশটা প্রেসিডেন্টের দিকে ঝুঁকবে। এর পাশাপাশি এবার ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থিতার লড়াইয়ে থাকা বার্নি স্যান্ডার্সের অনুসারীদের ভোটও বাইডেনের বিপক্ষে যেতে পারে। তদুপরি, ট্রাম্পের সহযোগীদের ধারণা, সিদ্ধান্ত নেননি এমন ভোটারদের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের ঝুলিতেই শেষ পর্যন্ত আসবে। আর গতবারের মতোই তাদের পক্ষে থাকতে পারে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটগুলোও। ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ সেøাগান দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের আবারও একবার একই ছাতার তলে আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তবে কোভিড-১৯ ইস্যু, প্রায় ২ লাখ মৃত্যু নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্টকে ধরাশায়ী করতে চাইবেন। অর্থনীতির প্রশ্ন আসবে। তবে তেমন সুবিধা হবে না। কারণ, ট্রাম্প ব্যবসা ভালো বোঝেন। অর্থনীতির নানা সূচক ওঠানামা করছে ঠিকই; কিন্তু খুব খারাপ পর্যায়ে যায়নি। ছয় মাস সবকিছু বন্ধ থাকলে হয়তো যেতে পারত। এ কৃতিত্ব ট্রাম্প নিশ্চয়ই নেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের শেষ বিতর্কে করোনাভাইরাস, জলবায়ু পরিবর্তন, বর্ণবাদ ও অভিবাসন ইস্যু প্রাধান্য পেয়েছে। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন দুজনই ছিলেন অনেকটাই সংযত। তারা একে অন্যকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকলেও একে অন্যকে অসম্মান করেননি।
আমেরিকাজুড়ে এখন সর্বাঙ্গীন তা-ব এই নির্বাচনের প্রচার ঘিরে। ভোটের প্রচার সব সময়েই উচ্চগ্রামে বাধা হয়; কিন্তু এবার যেন সব ইতিহাস ছাপিয়ে গিয়েছে ভোটজ্বরের তাপমান। এজন্যই মনে হচ্ছে, এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেন যুগসন্ধির মতো গুরুতর। যারা বামঘেঁষা কিংবা অধিকার আন্দোলনের লড়াকু মুখ, তাদের প্রতি মধ্যবাদী লিবারালদের তাই এবার বিশেষ অনুরোধÑ আগে গণতন্ত্রকে রক্ষা করা হোক, ‘সিস্টেম’কে বাঁচানো হোক, শুভবোধের সলতেটাকে আগে ঝড়ের ঝাপ্টা থেকে আড়াল করা হোক, বাকি কাজ পরে। সলতে যদি টেকে, আলো পরেও জ্বালানো যাবে। বাকি যুদ্ধ পরেও লড়া যাবে।
বস্তুত প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মৃত্যুর পর লিন্ডন জনসন ছাড়া অপর কোনোও ডেমোক্র্যাট পার্টির সাদা ভোটের অধিকাংশ অর্জন করতে পারেনি। জিমি কাটার জিতেছিলেন বটে, তবে শ্বেতাঙ্গদের মাত্র ৪০ শতাংশকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। অর্থাৎ অন্তত ওই শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ভোট না জোটাতে পারলে কোনো ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর পক্ষে হোয়াইট হাউসে যাওয়া অসম্ভব।
বাইডেন, না-কি ট্রাম্পকে পেতে যাচ্ছেন মেজরিটি ইলেকটোরাল ভোট? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই জানা যাবে কে হবেন হোয়াইট হাউসের পরবর্তী বাসিন্দা। তবে ট্রাম্প বা বাইডেন যে-ই প্রেসিডেন্ট হোন-না-কেন, বিশ্ববাসীরই প্রত্যাশা থাকবে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেন হাতে করে নিয়ে আসেন শান্তির পায়রা। আর সংঘাত নয়, যেন যুদ্ধে জর্জরিত এই ধরায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় তার দূরদর্শিতায়। যুদ্ধ, প্রেম, আবহাওয়া, রাজনীতি, নির্বাচনÑ এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন। তবু কখনও কখনও কিছু পূর্বাভাস অনুমান পাওয়া যায়। সেই অনুমান ভুল হতে পারে। আবার ঠিকও হতে পারে।
লেখক : উত্তরণ সম্পাদনা পরিষদের সদস্য