জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন, তার সেই অসমাপ্ত কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে আলোকবর্তিকা হাতে নিরলস ছুটে চলছেন তারই যোগ্য উত্তরাধিকার স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকার জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
সাইদ আহমেদ বাবু: বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির এবং বাংলাদেশের নেতা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনক হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিরও জনক। তিনি একই সমান্তরালে বিশ্ববন্ধু ও বিশ্বনেতা। বাঙালির ভাগ্য ফেরানো ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন; আর এমন দর্শনে সম্পৃক্ত ছিল বিশ্বমানবতার ভাগ্য ফেরানোর ব্যাপারটিও। সুতরাং, তিনি যখন শোষণমুক্তির ডাক দিতেন তখন তার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু হলেন বিশ্বের শোষিত মানুষের সর্বাধিক উচ্চারিত একটি নাম।
পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য ও আদর্শিক ভিত্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিল। উপরন্তু, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যে কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তাও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিল। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদর্শগুলো হবে জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’- এমন নীতির দ্বারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষভাবে উল্লেখ্য উক্তিটি ছিল : “আমার বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।” সংক্ষিপ্ত এ বাক্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যৎ দিক-নির্দেশনা স্পষ্ট ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানে এই উক্তির সারমর্ম ধারণ করে বলা হয়েছিল : “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার থেকে নিরস্ত থাকবে এবং পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্যে সচেষ্ট হবে।”
গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি ছিল আপাদমস্তক ঘটনাবহুল। ইতিহাসের মোড় আর বিশ্ব রাজনীতির পটপরিবর্তন করে দেওয়ার মতো অনেক ঘটনাই ঘটেছে বিশ শতকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, পরাজয় হলো ফ্যাসিবাদের, তখন বিশ্ব মোটামুটি দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক ব্লকে রইল পুঁজিবাদ, অন্য ব্লকে সমাজতন্ত্র। সামরিকভাবেও হয়ে গেল দুটি ব্লক। ন্যাটো আর ওয়ারশ জোট। এ অবস্থায় দুই ব্লকের রেষারেষিতে হুমকির সম্মুখীন ছিল মূলত কম শক্তির দেশগুলো, বিশেষ করে এশিয়া আর আফ্রিকার সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত অনুন্নত দেশগুলো। এই দেশগুলোর স্বকীয়তা, স্বাধীনতা আর অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার জন্য একই পতাকাতলে আসা জরুরি ছিল। এই রাজনৈতিক দুই ব্লকের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা সবরকম জোটের বাইরে থাকবে। আফ্রিকা, এশিয়া আর লাতিন আমেরিকায় যখন চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম, বিশ্ব যখন ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ নামক এক দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুক্ষয়ী রোগে আক্রান্ত, সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল ‘নন-অ্যালাইনড মুভমেন্ট’ বা ‘ন্যাম’ নামক এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যাকে বাংলায় বলা হয় ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’। ন্যাম এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা মঞ্চে পরিণত হয়। আকারের দিক থেকে ন্যাম জাতিসংঘের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা। অধিকাংশ দেশের স্বাধীনতা, চলমান আন্দোলনে ন্যাম রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই সংস্থা গঠনের পেছনে ছিলেন পাঁচজন মানুষ। যুগোসøাভিয়া থেকে জোসিপ ব্রজ টিটো, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের (মিশর ও সিরিয়া) জামাল আবদেল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার আহমেদ সুকর্ন, ঘানার কুয়ামে এনক্রুমা আর ভারতের জওহরলাল নেহেরু। নেহেরু ছিলেন পঞ্চশীল নীতির প্রবক্তা। ১৯৫৫ সালের বানদুং সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা। পরে ১৯৬১ সালে পুরনো যুগোসøাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জন্ম হয় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের। প্রথম কনফারেন্স হয় বেলগ্রেড, ১৯৬১ সালের ১ থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ন্যামের মূলমন্ত্র হচ্ছে- ‘আমরা বামেও নেই, ডানেও নেই, আমরা জোটনিরপেক্ষ’।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু এবং ১৬ জুলাই স্বীকৃতি দান করে। একই বছরের ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় রাষ্ট্র আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ‘চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ ৭৩ জাতি শীর্ষ সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেন। বাংলাদেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সর্বাগ্রে দেখার জন্য অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কসহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলেন শীর্ষ সম্মেলনে আগত অন্য নেতারা। সাংবাদিকসহ সবার কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সারাবিশ্বের দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিল বঙ্গবন্ধু ও ন্যাম সম্মেলনের দিকে। তখনকার দুই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত দুই জোট এবং তাদের কোল্ড ওয়ারের মাঝখানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল দুর্বল ও উন্নয়নশীল দেশ এবং সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষের জন্য শেষ আশা ও ভরসাস্থল।
বাংলাদেশ বিমানে বঙ্গবন্ধু পৌঁছালেন টারমাকে। বিমানবন্দরে উড়ছিল বাংলাদেশসহ ৯২টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জাতীয় পতাকা। বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে প্রেসিডেন্ট বুমেদিন দারুণভাবে সংবর্ধনা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। পরদিন স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু-বুমেদিনের কোলাকুলির ছবি প্রাধান্য পেয়েছিল। সব প্রোটোকল ভেঙে তাকে রিসিভ করতে দাঁড়িয়েছিলেন জোসিপ ব্রজ টিটো, যিনি ‘মার্শাল টিটো’ নামে পরিচিত। তিনটি দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্য জাঁদরেল সিংহ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন জোসিপ ব্রজ টিটো। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে সামনে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরলেন টিটো। অশ্রুসজল চোখ, সিংহহৃদয়ের মানুষকে কেউ কখনও কাঁদতে দেখেনি। পৃথিবীর দুই প্রান্তের মেরু ব্যবধানের আলাদা মানুষ হয়েও যেন ছিলেন আত্মার আত্মীয়। বঙ্গবন্ধু পৌঁছাতে সম্মেলন কক্ষের চেহারা পাল্টে গিয়েছিল। অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ক তার দিকে ছুটে এসেছিলেন। সম্মেলন কক্ষের দোরগোড়াতে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, আনোয়ার সাদত এবং ফিদেল কাস্ত্রো। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতা বঙ্গবন্ধু পা বাড়ালেন আন্তর্জাতিক পরিসরে। তার সঙ্গে সেই সম্মেলনে দেখা হয়েছিল ফিদেল কাস্ত্রো, লি কুয়ান আর জামাল আবদেল নাসেরের মতো নেতাদের। প্রবল মেরুকরণের যুগে যারা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশকে সেই স্রোতে গা ভাসানো থেকে দূরে রেখেছিলেন। রচনা করছিলেন একের পর এক রাজনৈতিক মহাকাব্য।
সম্মেলনের শুরুতে বিভিন্ন দেশের নেতাদের পরিচয় করিয়ে দেন সম্মেলনের সভাপতি ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন। একজন করে নেতা মঞ্চে এসে দাঁড়ানোর পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিন ছোট্ট বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচিতির সময় সম্মেলন কক্ষে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাঙালি পোশাকে পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো মুজিব কোট পরিহিত প্রায় ছয় ফুটের এক হিমাচল সদৃশ হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত বিশ্বনেতারা ও প্রতিনিধিরা আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে চলছিলেন, সেই করতালি যেন আর থামার নয়। তিন মিনিটের বেশি সময় ধরে করতালির পর প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের ইশারায় সবাই আবার আসন নিয়েছিলেন। এভাবেই সেদিন বিশ্বনেতারা সমবেত নেতৃবৃন্দ বাঙালি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিরোচিত সংবর্ধনা ও অভিনন্দন জানান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনে দু-দফা বক্তব্য দেন। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, বিশ্বের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে চায়। যে তিনজন বিশ্বখ্যাত নেতার সহায়তায় ন্যাম গড়ে উঠেছে, সেই যুগোসøাভিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসিপ ব্রজ টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর প্রতি শ্রদ্ধা জানান বঙ্গবন্ধু। আলজেরিয়া, ভিয়েতনামসহ সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের এবং বাংলাদেশের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ সব সময় আফ্রিকা-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতাকামী দেশগুলোর পাশে থাকবে। আলজেরিয়ার বীর জনগণকে স্যালুট জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের বিজয় সারাবিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। ৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদবিরোধী মজলুম জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাতে জোটনিরপেক্ষ নীতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি শুরুতেই জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের যেসব গণমানুষ শহিদ হয়েছেন, তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। ভিয়েতনাম, অ্যাঙ্গেলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনিসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মুক্তিসংগ্রাম অব্যাহত। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’ ওই সম্মেলনে বিশ্ব সমাজব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু-ভাগে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। প্রধানত পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রভাবিত বিশ্বে শোষক-শোষিতভিত্তিক বৈষম্য সামাজিক বাস্তবতা; আর এমন বাস্তব সত্যের প্রতিধ্বনী করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই বক্তৃতা সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে এ বৈষম্য নিরসনে অনিবার্য সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান যে শোষিতের পক্ষে, এমন বাণী শোনানোর ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর জন্য ইতিহাস-নির্দিষ্ট স্থানটি নিশ্চিত হয়েছিল। বিশ্ববিবেক আন্দোলিত করা বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মুজিব, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত বিশ্বের এই বাঁচার সংগ্রাম আমারও সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুকে বর্ণনা করতে গেলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তার সিদ্ধান্ত, অবিচলতা নিয়ে বলতে গিয়ে কাস্ত্রো বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি; কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, যিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে বারবার বললেন, ‘আমি লজ্জিত, আমি লজ্জিত।’
পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘উপমহাদেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে যে কোনো সমস্যার মানবিক সমাধান খুঁজতে হবে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ওপর জোর দিতে হবে। আমি আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই এক হওয়ার জন্য।’ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে প্রথমবার বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বনেতাদের নজর কাড়েন। তার ক্যারিশমেটিক কূটনৈতিক দর্শন বিশ্বনেতাদের নজর কাড়তে সমর্থ হয়, যা পরে বাংলাদেশের বিশ্বস্বীকৃতি, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বশান্তি পদক ‘জুলিও কুরি’ অর্জন তার ব্যক্তিত্বের নিদর্শনস্বরূপ। তাই বলা হয়, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পরই বঙ্গবন্ধু পেলেন বিশ্বনেতার মর্যাদা। সম্মেলন শেষে ঘোষণাপত্রে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তাদের সমর্থন দেয় বাংলাদেশকে। ফলে এটা ইতিবাচক হয়ে যায় বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে। এটি ছিল একটি বড় সম্মেলন। এতে যোগ দিয়েছিলেন, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো বিশ্বনেতারা। সম্মেলনের পরে ইন্দিরা গান্ধী, মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো, ফিদেল কাস্ত্রোসহ বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষনেতার সাথে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। এটি তার মুসলিম বিশ্বের প্রতি পররাষ্ট্রনীতির একটি মাইলফলকও বটে। এ সম্মেলনে বিশ্বের শান্তি আন্দোলন এবং পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক জোটের বাইরে একটি শক্ত জোরালো নিরপেক্ষ অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হন। পাকিস্তানের মিথ্যা প্রচারণায় মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করত। বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের নেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ধারণা প্রদান করেন। এ সম্মেলনের পরপরই অনেক মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিনের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক দুটি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি-র সম্মেলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে বুমেদিন মধ্যস্থতা করেন। বুমেদিনের সৌজন্যে ১৯৭৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২২ জন প্রতিনিধি নিয়ে আলজেরিয়ার বিশেষ বিমানে লাহোরে ওআইসি-র সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের পরেই ১৯৭৪ সালের ৮ মার্চ বুমেদিন বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফর করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারের সময় ফিদেল কাস্ত্রো চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে সিআইএ-র তৎপরতার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘সিআইএ থেকে সাবধান। সুযোগ পেলেই ওরা আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পরিণতি যা-ই হোক, আমি আপস করব না।’ জোসেফ মার্শাল টিটো তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন : “বঙ্গবন্ধুকে তিনি সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তারা বড় অনেকগুলো দেশের চক্ষুশূল। তাই সাবধানে থাকাই শ্রেয়।’ বরাবরের মতোই বঙ্গবন্ধু বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছিলেন। জোটনিরপেক্ষ দেশের অধিকাংশ নেতাই একাধিকবার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হয়েছেন একবার। সেই একবারেই তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কারণ বঙ্গবন্ধু একটিবারের জন্যও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবেননি। নিজের দেশের মানুষকে তিলমাত্র অবিশ্বাস করতে চাননি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যাপক জনপ্রিয় নেতারাও হত্যার শিকার হয়েছেন।” তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি বিশ্বের অন্যতম বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিতে হলো। কতিপয় স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রকারী, দেশদ্রোহী ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির স্বার্থ রক্ষার জন্যই নৃশংসভাবে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের শাহাদাতবরণ করতে হয়েছিল। ফলে ষড়যন্ত্রকারীদের মর্মান্তিকভাবে নিহত বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক ও মনীষীদের তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও যুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ আজও সেই শোণিত স্মৃতি বহন করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু সেই নেতাদের অংশ ছিলেন, যারা পিছিয়ে পড়া একাধিক দেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন দেখানোর কারিগর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামনের সারিতে যেসব নেতারা ছিলেন, মার্শাল টিটো বাদে কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। সবার মৃত্যু হয়েছে ষড়যন্ত্রের জালে পড়ে। ওই বছরেরই জুলাই মাসে হত্যা করা হয় সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালকে। তিনি এক বছরের মধ্যে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। ধারণা করা হয়, সিআইএ এবং ইসরায়েলের মোসাদের যুক্ত চক্রান্তে তিনি তার পরিবারের এক সদস্যের হাতে তিনি নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির সালভাদর আলেন্দে, ব্রাজিলের জোয়াও গোলার্ট, ইরানের মোহাম্মদ মোসাদ্দেক, গুয়াতেমালার জ্যাকাবো আরবেঞ্জ কিংবা ঘানার কুয়ামে এনক্রুমা তারা নিজ নিজ দেশে যখন সংস্কারের কর্মসূচি শুরু করেছেন, সিআইএ-র সাহায্য নিয়ে সেদেশের সেনাবাহিনী তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সমাজতন্ত্রী ভাবাপন্ন নেতাদের বিভিন্ন সময় সিআইএ একে একে হত্যা করেছে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করানো হয়েছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা। আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করানো হয়েছে চরমপন্থি মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গিদের দ্বারা। যদিও বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এখন জানা যাচ্ছে, মোসাদের চরেরা তার শরীরে স্পের পয়জনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল। আরব বসন্তের নামে হত্যা করা হয় লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে। এ সময়কালে শত ষড়যন্ত্র করেও সিআইএ কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে পারেনি। জোসিপ মার্শাল টিটো নিজেও একাধিকবার হত্যার শিকার হতে পারতেন। সাবধানতা তাকে রক্ষা করেছিল। টিটোর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন সারথিদের সর্বাগ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধুই। তাকে হত্যা করা হয় সবার আগে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতারা সারাবিশ্বের জন্যই আলোকবর্তিকার মতো। যারা বিশ্বকে শেকলবন্দি করে রাখতে চায়, বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য ছিলেন পথের কাঁটা। কিন্তু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মাত্র দুই বছর পরেই বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যা সেই সম্ভাবনার বিনাশ ঘটায়। এরপর একে একে টিটো ও ইন্দিরার মৃত্যু আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি করে।
নেহেরু এবং নাসেরের মৃত্যুর পর শক্ত হাতে এই আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন ইন্দিরা, টিটো এবং কাস্ত্রো। সত্তরের দশকের গোড়ায় ন্যাম যখন স্নায়ুযুদ্ধে পীড়িত বিশ্বে দুই সুপার পাওয়ারের প্রভাববলয়ের মাঝখানে একটি সত্যিকারের শান্তির মরূদ্যান এবং একটি প্রভাবশালী আন্দোলন, তখন এর প্রধান নেতা ইন্দিরা, টিটো ও কাস্ত্রোর সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবের নামটিও অচিরেই যুক্ত হবে- এমন একটি আভাস ন্যামের ১৯৭৩-এর আলজিয়ার্স সম্মেলনেও পাওয়া গিয়েছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চীনের শত্রুতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সরকার চীনের দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়েছিলেন, চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের কাছে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
তখনকার দুই পরাশক্তির আধিপত্যমূলক প্রভাববলয়ের বাইরে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে আগ্রহ ছিল, সেই আগ্রহ ও নিষ্ঠা যে তার কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার মধ্যেও সমভাবে বিদ্যমান তার প্রমাণ তার প্রথম-দফা প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে ঢাকায় ‘ন্যাম ভবন’ প্রতিষ্ঠা এবং ন্যামের সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠানের জন্য ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন, তার সেই অসমাপ্ত কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে আলোকবর্তিকা হাতে নিরলস ছুটে চলছেন তারই যোগ্য উত্তরাধিকার স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকার জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।