Wednesday, October 4, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,পঞ্চম সংখ্যা,এপ্রিল-২০২০জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণ : পর্যালোচনা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১০ই জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণ : পর্যালোচনা

অধ্যাপক আবুল বারাকাত: বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের (১৭ই জানুয়ারি ১৯৭২) ভাষণটি সম্ভবত তার জীবনের সংক্ষিপ্ততম ভাষণের একটি। ভাষণটি বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত প্রসঙ্গ
আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণটির অন্তর্নিহিত গুরুত্ব উপলব্ধি সম্ভব শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বাস্তব প্রেক্ষিত (পড়হঃবীঃ) বিবেচনা করে। শুধুমাত্র ঐতিহাসিক বাস্তব প্রেক্ষিত বিবেচনা করেই এ উপসংহারে আসা সম্ভব যে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ভিত্তি সৃষ্টি করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের নিরিখে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। বিষয়গুলো এ-রকম :
১. দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান কাঠামোতে বাঙালি জাতির মুক্তি হবে নাÑ এ বিষয় বঙ্গবন্ধু ছিল ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকেই। আর সে-কারণেই তখন থেকেই তিনি মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, যা তার সমসাময়িক কেউই ভাবেন নি। এবং সে-স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি বহুমুখী নৈতিক-রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আর এ সংগ্রামে তিনি কখনই আপোস করেন নি।
২. বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা স্বপ্নের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হলো ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ। যে ভাষণে তিনি স্পষ্ট বললেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আর এ আহ্বানে সমগ্র বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করল এবং জয়ী হলো। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সেøাগানটা ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
৩. পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধুই সম্ভবত একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি ‘মুক্তি’ (খরনবৎঃু অর্থে) ও ‘স্বাধীনতা’Ñ প্রত্যয় দুটির অতুলনীয় ব্যবহার করেছেন। তিনি একদিকে যেমন ‘মুক্তি’কে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসেবে দেখেছেন, অন্যদিকে ‘স্বাধীনতা’কে মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছেন। তিনি একদিকে যেমন বলেছেন, ‘স্বাধীনতা’ কোনো আংশিক বা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়Ñ ‘স্বাধীনতা’ হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিকাশের পূর্বশর্ত; আর অন্যদিকে বলেছেন ‘মুক্তি’ হলো ‘শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য-সাম্প্রদায়িক মনন’ থেকে মুক্ত হওয়া।
৪. বঙ্গবন্ধুর ‘মুক্তি-স্বাধীনতা’ স্বপ্নের মূল উপজীব্য ছিল ‘মানুষ’, ‘আমার মানুষ’, ‘দুঃখী মানুষ’, আর নিঃশর্ত যা তিনি চেয়েছিলেন তা হলো এমন একটি দেশ গড়তে যে দেশ হবে ‘সোনার বাংলা’, ‘ক্ষুধামুক্ত, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানুষের বাংলাদেশ’।
সুতরাং, রাজনৈতিক সমীকরণে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ অবস্থাটা যা-ই হোক না কেন বঙ্গবন্ধু সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই এদেশের মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ-পদ্ধতি অন্বেষণ-আবিষ্কার করেছেন; তা বাস্তবায়নে লড়াই-সংগ্রাম মই-এর নীচু থেকে ধাপে ধাপে উচ্চতম স্তরে-শিখরে উত্তরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সমগ্র এ প্রক্রিয়ায় তার বিশ্বাস ছিল ‘জনগণ, একমাত্র জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে’, আর তাই তিনি জনগণের অন্তর্নিহিত অসীম শক্তির প্রতি আস্থা রেখেছেন, আর সেই জনগণই ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেনÑ যেন তিনি সুস্থ শরীরে নিজভূমিতে ফিরে এসে আবারও জনগণের পথ প্রদর্শক হন। পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে; বঙ্গবন্ধুর চোখের সামনে তার কবর খোঁড়া হয়েছে; তার একমাত্র আর্জি তখন “আমার লাশটা যেন আমার বাংলায় ফেরত দেয়া হয়”। কঠিন-কণ্টকাকীর্ণ এ প্রক্রিয়ায় যখন অন্যান্য নেতা সাধারণ থেকে হয়ে ওঠেন অসাধারণ, তখন বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন সাধারণ থেকে অতিসাধারণ।
এতক্ষণ কথাগুলো বললাম এ কারণে যে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য যে দিক-নির্দেশনামূলক সংক্ষিপ্ত ভাষণটি দিলেন তার মর্মবস্তু প্রেক্ষিত-বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তা হবে সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণটি বিশ্লেষণের আগে আরও একটা বিষয় না বললেই নয়। আর তা হলো বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবনে যত ভাষণ দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির মূল সুর ‘জনগণের স্বার্থ সবার ঊর্ধ্বে’ এবং যে কারণে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণও পাওয়া যাবে না যেটি মর্মবস্তুগতভাবে অন্য ভাষণের সাথে সামঞ্জস্যহীন। এসবের স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যদি আমরা তার ১৯৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকালে প্রত্যেক গ্রামের বক্তৃতা থেকে শুরু করে ১৯৭৪-এর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণ বিশ্লেষণ করি।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন ভাষণ পর্যালোচনার ক্ষেত্রে আরও একটা প্রেক্ষিত বিবেচনায় রাখতে হবে। আর তা হলো : বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশ পাকিস্তানের উত্তরসূরি কোনো রাষ্ট্র নয়। অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে।
বলে রাখা উচিত, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণটির পর্যালোচনা হতে পারে সামাজিক গবেষণায় গৃহীত বিভিন্ন ধরনের গবেষণা পদ্ধতি অবলম্বনে। আমি যে পদ্ধটির ব্যবহার করেছি, তা ভাষণে উল্লিখিত ক্রমানুসারিক পর্যালোচনা নয়। আমার পদ্ধতিটির কিছুটা পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়-ক্রমভিত্তিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণভিত্তিক।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণ পর্যালোচনা প্রসঙ্গে
বঙ্গবন্ধুরই আহ্বানে তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলো; মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা মাত্রাহীন; রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনার কোনো প্রাক্-অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আসছেনÑ পাকিস্তানের কারাগার থেকে যেখানে ৯ মাসে বাংলাদেশে কী ঘটেছে তা জানার অবতরণ করলেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে, রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাতে লাগলো ৪ ঘণ্টা, অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আনুমানিক ১০ লক্ষ মানুষের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেনÑ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণ।
যে প্রেক্ষিতের কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি সেসব বিবেচনায় নিলে এ প্রশ্ন উত্থাপন খুবই স্বাভাবিক : বঙ্গবন্ধু আসছেন; স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু কী পথনির্দেশনা দেবেন? এ প্রশ্নের উত্তর কারও জানা ছিল না, যেমন জানা ছিল না ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু কী বলবেন, কী হবে তার আহ্বান-নির্দেশ?
আমার মনে হয় গ্রাম-শহরের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মানুষ সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিনির্মাণের কিছু দিক-নির্দেশনা দেবেন। সেটাই বাস্তব হলো। কিন্তু সে রাষ্ট্র গড়তে কি করতে হবে এবং করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু যে এসব নিয়েও নির্দেশনা দেবেন তাও মনের ভেতরের গভীর ক্ষত ও সর্বোচ্চ আবেগ সত্ত্বেওÑ এসব সম্ভবত কেউ ভাবতেই পারেন নি। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেই এসব বললেন।
বঙ্গবন্ধু তো পোড়খাওয়া সমাজ-দার্শনিক যিনি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক দর্শন বিনির্মাণ করলেন; ঐ দর্শন বাস্তবায়িত হলো; এরপরে এটিই স্বাভাবিক যে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব দেবেনÑ যে দেশটি হবে “ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, আলোকিত মানুষের প্রগতি-রাষ্ট্র”। আমার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেষের কাজটিরই নির্দেশনা দিলেনÑ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণে। কী ছিল তার সেই নির্দেশনা?
১. বঙ্গবন্ধু বক্তব্য শুরু করলেন এভাবে : “গত ৭ মার্চ এই ঘোড়দৌড় ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আপনারা বাংলাদেশের মানুষ এই স্বাধীনতা এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই একতা বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালির প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নেই।”
অর্থাৎ ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দিলেন : মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে; ষড়যন্ত্র চলছে; একতা বজায় রেখে স্বাধীনতা বিনষ্টকারী শক্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে, আর অন্যদিকে বাঙালির অজেয় শক্তির কথাও মনে করিয়ে দিলেন। তাহলে নির্দেশনাটি এ-রকম : “স্বাধীনতা অর্জন কঠিন কাজ, আর স্বাধীনতা ধরে রাখা এবং তা তাৎপর্যময় করা কঠিনতর।”
২. বিশ্ববাসীর কাছে সহযোগিতা চেয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন : “আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য দানের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি।”
অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু একদিকে কোটি কোটি নিঃসম্বল ও দুঃখ মানুষের দেশকেও ‘সোনার বাংলা’ বলছেন আর অন্যদিকে বিশ্ববাসীর মানবতার কাছে আবেদন করছেন। এ আবেদন তিনি অতীতে অন্যান্য বহুদেশের জন্য করেছেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধুকে ‘নিপীড়িত মানুষের’ বৈশ্বিক নেতা হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
৩. স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে ভাই হিসেবে বঙ্গবন্ধু বললেন : “নেতা হিসাবে নয়, ভাই হিসাবে আমি আমার দেশবাসীকে বলছি আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবেÑ পূর্ণ হবে না।”
অর্থাৎ যে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু, আর বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা তিনি কি না ভাই হিসেবে আহ্বান করছেন স্বাধীনতার পূর্ণ রূপ দিতে মানুষের আশ্রয়, খাদ্য ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের। এসব একদিকে বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন আর অন্যদিকে স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ রূপ নিশ্চিত করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। এখানেই বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনের বীজমন্ত্র।
৪. শতভাগ মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও নীতির প্রশ্নে আপোস নয়। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু বললেন : “… আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল।… আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।”
“১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন তাঁদের বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হয় আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়।”
তাহলে কী দাঁড়াল? বঙ্গবন্ধু সচেতনভাবেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। একদিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে যাবেন নাÑ মরতে হলে এখানেই মরবো, আর অন্যদিকে পাকিস্তানে ফাঁসির মঞ্চ থেকে বলছেন নতি স্বীকার করবে নাÑ অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই মৃত্যুর সম্ভাবনা শতভাগ। এ শুধুমাত্র সাহস নয়, এ হলো দেশপ্রেমের জন্য দেশের মানুষের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের সচেতন নিদর্শন।
৫. পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ আর পাক-হানাদার বাহিনীর এক কথা নয়। এসব প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন : “আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই।… কিন্তু যারা অন্যায়ভাবে আমাদের মানুষদের মেরেছে তাদের অবশ্যই বিচার হবে।”
“পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচারে গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের আবেদন জানাচ্ছি।”
উপরের বক্তব্য দুটি বড় মাপের রাষ্ট্রনায়কোচিত ও গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ হলো ‘ভাই’ কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যারা এদেশে গণহত্যা করেছে তাদের ক্ষমা নেইÑ বিচার হবে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। লক্ষ করবেন এখন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ (বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘ভাই’) বলেÑ ‘হ্যামকো বাংলাদেশ বানা দো।’ আমি যদি বলি এখন থেকে ৪৭ বছর আগে (১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণকালে) বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, যদি আমরা স্বাধীনতা সুসংহত করতে পারি এবং ‘বঙ্গবন্ধু-দর্শন’ বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বলবে, ‘হ্যামকো বাংলাদেশ বানা দো।’ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এসব কথা পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আরও ২০-২৫ বছর আগেই বলতো।
৬. ভারত, ভারতীয় সৈন্য, ইন্দিরা গান্ধী প্রসঙ্গ : “আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি।… আমি যখনই চাইব, ভারত বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী তখনই ফিরিয়ে নিবে।… তিনি (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী) ব্যক্তিগতভাবে আমার মুক্তির জন্য বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন, তারা যেন আমাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান, আমি তাঁর নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকব।” ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি অনেকের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে স্পষ্ট করেছিলেন যে তিনি যখনই চাইবেন ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে। কোনোরকম কালক্ষেপণ না করে শেষোক্তটি বাস্তবায়িত হলো।
৭. ভুট্টোর অনুরোধ ও তা প্রত্যাখ্যান। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলছেন : “পাকিস্তানী কারাগার থেকে যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করেছিল, সম্ভব হলে আমি যেন দুদেশের মধ্যে একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের নিকট ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। এখন আমি বলতে চাই, জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে।”
বক্তব্যটি বহুদিক থেকে প্রণিধানযোগ্য। আসলে দুদেশের মধ্যে ‘শিথিল সম্পর্ক’ রাখার বিষয়ে ভুট্টো সাহেবের প্রস্তাবটি বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের উত্তরসূরি কোনো রাষ্ট্র নয়। আবার অন্যদিকে সম্ভাব্য স্বাধীনতা হরণকারীদের উদ্দেশ্যে নিঃসংকোচে সর্বপ্রথম নিজের প্রাণ দেবার কথাও বলেছিলেন। একজন ব্যক্তি-জীবনে কতবার প্রাণ দিতে পারে? এই একই ভাষণে আমরা দেখছি বঙ্গবন্ধু তিনবার জীবন উৎসর্গ করছেন। তবে সত্যটা হলো, বঙ্গবন্ধু যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন বিনির্মাণ করেছিলেন তা যেন কোনোভাবেই বাস্তবে রূপ না নেয়, সে-জন্য ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাকেসহ তার পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণেও আঁচ করা সম্ভব কেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো এবং এ হত্যার কুশীলব-পরিকল্পনাকারী কারা।
৮. বাংলাদেশকে স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রসঙ্গে : বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষে বলছেন : “আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরোধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়ার জন্য সাহায্য করুন। জয় বাংলা।”
লক্ষণীয় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং জাতিসংঘের সদস্য করবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন সকল মুক্ত দেশকে। মুক্তিকামী মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানটি সবার উদ্দেশ্যে নয়। আর স্বীকৃতির প্রয়োজনটা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উভয় কারণে। আর জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়ে অন্যান্য অনেক লাভের মধ্যে বড় মাপের যে লাভটি হয়েছে তা পরবর্তীকালে সুপ্রমাণিত তা হলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ বাংলা ভাষায় ভাষণের পরে বঙ্গবন্ধু কার্যত হয়ে গেলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের দূত, শোষিতের গণতন্ত্রের প্রতিভূÑ বিশ্ববন্ধু।
৯. কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু? বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এ বিষয়ের নির্দেশনা ছিল সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বললেন : “আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।”…
“আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।”
বাংলাদেশের মানুষের জন্য উন্নত-জীবন নিশ্চিত করাটাই স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ‘জীবনের একমাত্র কামনা’। আর এ কামনা বাস্তবায়নে তিনি যে কাঠামোর দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা হবে ‘গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক’, যে দেশে সবাই সুখে থাকবেÑ শান্তিতে থাকবে।

উপসংহার
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণের প্রতিটি শব্দ-বাক্য গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ভিত্তি সৃষ্টি ও তা সুদৃঢ়করণ উদ্দিষ্ট স্পষ্ট পথনির্দেশ। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ-ভাবনা, রাজনীতি চিন্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভাবনার পরস্পর সম্পর্কিত এক সমগ্রিক রূপ (যড়ষরংঃরপ ভড়ৎস)Ñ এ ভাষণে স্পষ্ট প্রতিভাত। এ ভাষণে স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু একদিকে চেয়েছিলেন মানুষের অধিকার ও ক্ষমতায়নভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে যেখানে নির্মূল হবে ‘ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, আশ্রয় অভাববোধ, শোষণ, বঞ্চনা’, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে প্রতিটি মানুষের জন্য ‘উন্নত জীবন’ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, যেখানে উত্তরোত্তর দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’, যেখানে দেশ হবে অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানুষে সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণÑ আর এসবের সমষ্টিগত রূপই হলো ‘বঙ্গবন্ধু-দর্শন’। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ভাষণটি আসলে ‘বঙ্গবন্ধু-দর্শন’-এর ঘনীভূত প্রকাশ। আমাদের দায়িত্ব হবে ‘বঙ্গবন্ধু-দর্শন’ ধারণ করা, আত্মস্থ করা, চর্চা করা এবং মানবকল্যাণে এ দর্শন বাস্তবায়নে নিজেকে নিঃশর্ত সম্পৃক্ত করা।

[প্রবন্ধটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটির ২৮ জানুয়ারি ২০২০-এর সেমিনারে পঠিত]

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য