উত্তরণ প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত আত্মমর্যাদাশীল উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, পঁচাত্তর-পরবর্তী দীর্ঘ ২১টি বছর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানসহ তার নাম মুছে ফেলার নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা দিয়ে কখনও সত্য ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, আজকে তা প্রমাণিত সত্য। বুকের রক্ত দিয়ে যারা আমাদের রক্তের অক্ষরে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল, তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। লাখো শহিদের সেই আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যাবে না, বৃথা যেতে আমরা দেব না- এটাই আমাদের আজকের প্রতিজ্ঞা।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে না; আমরা প্রযুক্তিগত শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়েছি। আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন একটা জাতি হিসেবে আমরা দেশের মানুষকে গড়ে তুলতে চাই। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার সঙ্গে প্রযুক্তিগত জ্ঞান নিয়ে সারাবিশ্বে একটা সম্মানিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলব। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিববর্ষে দেশের প্রতিটি মানুষের ঘর বিদ্যুতের আলোতে আলোকিত করব, দেশের একটি লোকও গৃহহীন থাকবে না, সবার একটা ঠিকানা আমরা করে দেব।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সঙ্গে মুশতাক-জিয়ারা জড়িত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তানের শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি। স্বাধীনতার পর পরাজিত শত্রুরা এদেশীয় দালালদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল। খুনিদের মধ্যে অনেকেই ছিল যারা আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আশা-যাওয়া করত, আমার মা যাদের রান্না করে খাওয়াতেন- তারাও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। খুনি মুশতাক-জিয়ারা মদদ না দিলে এ-ধরনের ঘটনা ঘটত না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার নাম পর্যন্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না, মিথ্যা দিয়ে কখনও সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না- এটাও আজ প্রমাণ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনা সভার শুরুতেই ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। আলোচনায় অংশ নেন দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু এমপি, তোফায়েল আহমেদ এমপি, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও লেখক-গবেষক হায়দার আলী খান, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি এমপি, কার্যনির্বাহী সদস্য মেরিনা জামান কবিতা, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, আবু আহম্মেদ মান্নাফী এবং ভাষা শহিদদের স্মরণে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি তারিক সুজাত। আলোচনা সভা যৌথভাবে পরিচালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনে বীর শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতীতে বাংলাদেশকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। বাংলাদেশ মানেই তাদের কাছে ছিল দারিদ্র্যপীড়িত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা-জলোচ্ছ্বাস, গরিব দেশ হিসেবে। এখন আর কারও সেসব কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। মাত্র এক দশকেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল, মর্যাদাশীল দেশ। আমরা খাদ্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত, ঘূর্ণিঝড়-বন্যাসহ সব দুর্যোগ মোকাবেলা করতে শিখেছি।
মুজিববর্ষকে সামনে রেখে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুজিববর্ষে আমরা দেশের প্রতিটি ঘর আলোকিত করব। আর সব নেতাকর্মীদের ওপর দায়িত্ব হলো- নিজ নিজ এলাকায় কোনো লোক গৃহহারা আছে কি না, তা খুঁজে বের করা। বাংলাদেশের একটি লোকও গৃহহারা থাকবে না। গৃহহীনদের তালিকা তৈরি করুন, প্রত্যেককে ঘর করে দেওয়া হবে। সবার একটা ঠিকানা নিশ্চিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ এবং ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছি। আসুন, দৃঢ় সংকল্পে আবদ্ধ হই- মহান একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব। আর ভাষার আন্দোলনে রক্ত দিয়ে যারা রক্তের অক্ষরে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন, আর যাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি- সেই ত্যাগ কখনও বৃথা যায় না। মহান সেই আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দেব না এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা। আর এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব। মুজিববর্ষ সফল, সার্থকভাবে আমরা উদযাপন করব।
টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণ আমাদের বারবার ভোট দিয়েছে, তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। এটাই সব থেকে বড় পাওয়া। আজকে ২০২০ সাল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আমরা উদযাপন করতে যাচ্ছি। আমরা আজকে স্বাধীন জাতি। আর সব থেকে সৌভাগ্যের বিষয়, আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী আমরা উদযাপন করছি। যিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। একটা অস্তিত্ব দিয়ে গেছেন। আমাদের ঠিকানা দিয়ে গেছেন। আমাদের আত্মমর্যাদা দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ এক দশক ক্ষমতায় থাকার ফলে আজকে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের আর কেউ বাংলাদেশকে অবহেলার চোখে দেখতে পারবে না।
ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভূমিকা ও অবদানের কথা তুলে ধরে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ভাষার অধিকার এটা মানুষের অধিকার। আর এই উপমহাদেশে বাংলাদেশই হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেটা একটা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ইউরোপীয় অনেকগুলো রাষ্ট্র আছে ভাষাভিত্তিক; কিন্তু আমাদের দেশ এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র, যা প্রতিষ্ঠা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ ১৯৪৮ সাল থেকে জাতির পিতা যে সংগ্রামটা শুরু করেছিলেন, সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তার (বঙ্গবন্ধু) লক্ষ্যই ছিল এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে হবে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর নয়। তবে বঙ্গবন্ধু যেটা করেছিলেন তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকেই যে সংগ্রামের শুরু, সেটার মাধ্যমেই আমরা অর্জন করি আমাদের এই স্বাধীনতা। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে যান। আজকে আমরা একটা স্বাধীন জাতি।
স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত হলেও পাকিস্তানিরা তাদের এই আত্মসমর্পণ ভুলে যায়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে তারা পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল। ওই পাকিস্তানি সেনাশাসকরা তো বটেই, আমাদের দেশের কিছু দালাল ছিল। যারা এই ভূখণ্ড থেকে চিরদিন ওই পাকিস্তানিদের পদলেহন করেছে, তোষামোদ করেছে, খোশামোদ করেছে- তারা চাটুকারের দল ছিল। পাকিস্তানের দাসত্ব মেনে নিয়ে চলত। তারা ভুলতে পারেনি ওই পাকিস্তানি প্রভুদের। স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচয় দেওয়া থেকে তারা পাকিস্তানের প্রভুদের দাসত্ব করাটাই তাদের কাছে ভালো লাগত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদাররা যখন সারাদেশে গণহত্যা চালায়, তখনও এরা তাদের দোসর ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুনি ও পরাজিত শত্রুদের ধারণা ছিল, এভাবে হত্যা করলেই বুঝি বাঙালিকে দাবানো যাবে। কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা যে কথা বলেছিলেন- কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। সত্যিই বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেন, সেই সময় আমাদের জীবনে এলো ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। স্বাধীনতাবিরোধীরা পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, যারা আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া বা সেই মুশতাকসহ তাদের দোসর এবং জিয়াউর রহমান এদের মদদদাতা। তারা সঙ্গে না থাকলে কখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটত না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে তার নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা চলল। ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে দিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকেও মুছে দিল। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, আজকে তা প্রমাণিত সত্য।
২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি মানুষও যেন গৃহহারা বা গৃহহীন না থাকে সেজন্য প্রতিটি গ্রামে গ্রামে খোঁজ নিয়ে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার তার সরকারের পরিকল্পনার কথাও দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।