Wednesday, October 4, 2023
বাড়িউত্তরণ প্রতিবেদনজননেত্রী সাহারা খাতুন পরলোকে

জননেত্রী সাহারা খাতুন পরলোকে

উত্তরণ প্রতিবেদন : না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। গত ৯ জুলাই থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে এই প্রবীণ রাজনীতিকের বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকা-১৮ আসনের এই সংসদ সদস্য ৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২৫ মিনিটে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মারা যান। তিনি কিডনি ও শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় ভুগছিলেন। অসুস্থ সাহারা খাতুনকে গত ৬ জুলাই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে থাইল্যান্ডে নেওয়া হয়। জ্বর, অ্যালার্জিসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে অসুস্থ অবস্থায় গত ২ জুন সাহারা খাতুন ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার অবস্থার অবনতি হলে ১৯ জুন সকালে তাকে আইসিইউ-তে নেওয়া হয়। এরপর অবস্থার উন্নতি হলে তাকে গত ২২ জুন দুপুরে আইসিইউ থেকে এইচডিইউ-তে (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) স্থানান্তর করা হয়। ২৬ জুন সকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আবারও তাকে আইসিইউ-তে নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সাহারা খাতুন তৃতীয় মেয়াদ জাতীয় সংসদে ঢাকা-১৮ আসনের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। শেখ হাসিনার ২০০৯-১৩ সরকারে প্রথমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ছিলেন তিনি।

সাহারা খাতুনের রাজনৈতিক জীবন
বাংলাদেশের প্রথম নারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সফল রাজনৈতিক সংগঠকের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করতেন।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ ঢাকার কুর্মিটোলা গ্রামে বাবার বাড়িতে তার জন্ম। সাহারা খাতুনের বাবার নাম মরহুম আবদুল আজিজ ও মায়ের নাম তুরজান নেছা। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ইস্ট পাকিস্তান বোর্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। সিটি নাইট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তারপর জগন্নাথ কলেজে বিএ কোর্সে ভর্তি হন। পরে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ (ডিগ্রি) অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হলেও তিনি কোর্স শেষ করেন নি। ১৯৭৫-পরবর্তী সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন সাহারা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্রদের মধ্যে একটি নির্বাচনে তিনি ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেন। সেটি ছিল তার জীবনের প্রথম নির্বাচন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা যখন গঠিত হয়, তাতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের দিনেও তিনি সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন ১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ১৯৮১ সাল থেকে আইন পেশা শুরু করেন সাহারা খাতুন। প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। তিনি ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন ঢাকা-৫ আসনে প্রথমবার অংশ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কাছে হেরে যান। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসন থেকে প্রথমবারের মতো এমপি হন। ২০০৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পরে দেওয়া হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ঢাকা-১৮ আসন থেকে ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তিনি জয়ী হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি প্রথমে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে মহিলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক এবং একই সঙ্গে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-আইন সম্পাদক, পরে আইন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া স্বাধীনতার পরেই সাহারা খাতুন মহিলা সমিতির সদস্য মনোনীত হন। তখন ড. নীলিমা ইব্রাহিম সভানেত্রী ও আইভি রহমান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, ঢাকা আইনজীবী সমিতি, গাজীপুর আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনেরও আজীবন সদস্য। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিরও সদস্য। তিনি আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব ওমেন্সের ডিরেক্টর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাষ্ট্রপতির শোক
আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোক বার্তায় তিনি বলেন, সাহারা খাতুন ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন পরীক্ষিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে তিনি গণতন্ত্রের বিকাশসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিককে হারাল। তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রধানমন্ত্রীর শোক
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে সাহারা খাতুন গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আজীবন কাজ করে গেছেন। দলের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীদের পাশে থেকে সকল সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেছেন। শেখ হাসিনা আরও বলেন, তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন দক্ষ নারীনেত্রী এবং সৎ জননেতাকে হারাল। আমি হারালাম এক পরীক্ষিত ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাকে। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

কামাল লোহানী
আমার মৃত্যু যেন আত্মত্যাগের মাধ্যমেই শেষ হয়। এই ব্রত নিয়েই আমি রাজনীতি, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিচর্চা করেছি। ত্যাগের মাঝেই জীবনের সাফল্যের সন্ধানী এই মানুষটি হচ্ছেন লোহানী। স্বদেশ ও সমাজের প্রতি দায়বোধ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন। পেশাগত জীবনে সাংবাদিক হিসেবেও ছিলেন অকুতোভয়। গত ২০ জুন না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন এই ভাষাসংগ্রামী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক। চিরবিদায় নিলেন প্রগতিশীল চেতনার আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। এদিন সকাল সোয়া ১০টার দিকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। কামাল লোহানীর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। রেখে গেছেন এক ছেলে সাগর লোহানী এবং দুই মেয়ে বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষী।
২০ জুন দুপুরে তার শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর শেখেরটেকের কোয়ান্টম ফাউন্ডেশনে। সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী গোসল করানো হয়। এরপর নিয়ে যাওয়া হয় তার প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খান সনতলা। সেখানে জানাজা শেষে বাদ এশা কামাল লোহানীকে তার স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর কবরে সমাহিত করা হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে দেওয়া শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে কামাল লোহানী বিপুল অবদান রেখেছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তিনি ছিলেন একজন পুরোধা ব্যক্তি।


শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারালাম। একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা এবং দেশের সংস্কৃতি বিকাশের আন্দোলনে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে সাংবাদিক হিসেবে, সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে কামাল লোহানী ছিলেন এক অকুতোভয় যোদ্ধা। ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন যখন এক পথে মিলে গিয়েছিল তখন থেকেই তিনি এ দুই পথেরই যোদ্ধা। এদেশের ঐতিহাসিক নানা ঘটনার সঙ্গে রয়েছে তার যুক্ততা। ১৯৬১ সালে অন্য অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে তার ছিল দৃঢ় ভূমিকা। রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী পুরোপুরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতা
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালের অভিজ্ঞতা ও আগামীর ভাবনা
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য