দুবাই প্যানেল আলোচনায় শেখ হাসিনা
আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সরকারি সফরে গত ৭ মার্চ রাতে আবুধাবিতে যান। পরদিন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে দুবাই এক্সপো-২০২০-এর মহিলা প্যাভিলিয়নে অনুষ্ঠিত ‘রিডিফাইনিং দ্য ফিউচার অব উইমেন’ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে যখন তার মতো মাতৃস্নেহে দেশ পরিচালিত হয়, তখন জনগণ অবশ্যই সে-রকম একজন নেতাকেই সমর্থন করবে। তিনি বলেন, ‘একটি বিষয় বোঝা উচিত যে নারীরা শুধু নারী নয়, নারীরা মা-ও। তাই আপনি (নেতা) যদি মাতৃস্নেহে দেশ পরিচালনা করেন, জনগণ অবশ্যই আপনাকে সমর্থন করবে। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার হত্যার পর তিনি যখন দেশে ফেরেন, তখন সেই খুনিচক্র ও যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায় ছিল। তিনি বলেন, কাজেই আমার যাত্রাটা খুব মসৃণ ছিল না। তিনি বারবার হত্যা প্রচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু এটিকে পাত্তা দেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি ভেবেছিলামÑ আমাকে মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। রাজনীতি ও সরকারে তাকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি তার পুরুষ সহকর্মীদের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, আমাকে অবশ্যই তাদের প্রশংসা করতে হবে। কারণ তারা আমাকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংসদের একটি অনন্য পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতা নারী। তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর প্রায় ২১ বছর সামরিক শাসকরা দেশ শাসন করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন তিনি সরকার গঠন করেন, তখন তিনি দেখেন, নারীদের কোথাও কোনো স্থান নেই। এরপর তিনি নারীদের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ স্নাতক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং অন্যসব জাতীয় পরিম-লের উচ্চপদে তাদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা। সামরিক শাসনামলে নারীদের স্থান সংকীর্ণ ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি নারীদের জন্য সবকিছু খুলে দিয়েছি।’ পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারে দুবাই এক্সপো-২০২০-এর বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন এবং ইউএই প্যাভিলিয়ন পরিদর্শন করেন।
পাশাপাশি, সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের মধ্যে বৈঠকে বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সম্মত হয়। দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারের এ বৈঠকে উভয় নেতাই নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দেন। এদিকে দুদেশের সহযোগিতা জোরদারে এদিন দুবাই এক্সিবিশন সেন্টারে দুই দেশের মধ্যে ৪টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। স্মারক ৪টি হলোÑ বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এবং আমিরাত সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের (ইসিএসএসআর) মধ্যে সহযোগিতা। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) ও দুবাই ইন্টারন্যাশনাল চেম্বারের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে স্মারক সই হয়েছে। বৈঠকে দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম দুই দেশের মধ্যে এমিরেটস ফ্লাইট পরিচালনার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার এখন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করছে। আমরা আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে আমিরাতের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফলভাবে করোনা মোকাবিলা করার জন্য আমিরাত সরকারের প্রশংসা করেছেন। শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমও এ-সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে বলেছেন, করোনা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীও ভালো করেছেন। শেখ হাসিনা দুবাইয়ের অসাধারণ উন্নয়নের জন্য আল মাকতুমের প্রশংসা করেন। দুবাই শাসক বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বললে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উন্নয়নের অনেক সুযোগ রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
১০ মার্চ বাংলাদেশ ও আমিরাতের ব্যবসায়ীদের আয়োজিত এক যৌথ ব্যবসা পরিষদে (জেবিসি) ভার্চুয়ালি দেওয়া এক বক্তব্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কগুলোতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, খাদ্যপণ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক বাজার এখন উন্নত বেসরকারি ইকুইটি ও ফিন-টেক সমাধান দিতে প্রস্তুত রয়েছে। প্রায় ১২ বছর আগে আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আমি এজন্য আপনাদের আমাদের অংশীদার হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বিনিয়োগের ভালো গন্তব্য উল্লেখ করে বলেন, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে তার সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের সবাইকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় সুযোগ লাভের দেশ।’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভূ-কৌশলগত অবস্থান এবং সকল প্রধান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ রুটের সাথে সরাসরি যুক্ত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জনবহুল ও ক্রমবর্ধমান দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের মিলনস্থলে রয়েছি। আমাদের একটি বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার তো রয়েছেই। পাশাপাশি আমাদের নিকটবর্তী অনেক দৃশ্যত সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে।’ তিনি বলেন, এসব সুবিধা বাংলাদেশকে বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে এবং আমাদের দেশ এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ পণ্য উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। আমরা চামড়া, পরিবেশবান্ধব পাট ও পাটজাত দ্রব্য, খাদ্য ও সবার ওপর আইসিটি ও আইটিইএস-এ (আইটি এনাবলড সার্ভিসেস) ভালো ও দক্ষ।’ বাংলাদেশের ৬৫০ হাজারের বেশি ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপার রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, এছাড়া বাংলাদেশ উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেটের জন্য পূর্ণ স্পেকট্রাম পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আমাদের হাই-টেক পার্কগুলো এখন প্রস্তুত রয়েছে। আমরা বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশকে তাদের নিজ দেশ হিসেবে বেছে নিতে, বিশ্বের সবচেয়ে ভালো দেশ হিসেবে তুলে ধরতে নীতিগত ও অবকাঠামো উভয় ক্ষেত্রেই তাদের সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা বহুমুখী সেতু, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প এবং এ-ধরনের মেগা প্রকল্পগুলো বাংলাদেশে অবকাঠামোগত বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে। শেখ হাসিনা বলেন, কৃষিতে তার সরকারের ব্যাপক ও নানা ধরনের উদ্ভাবন, কৃষি সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্সের কারণে বাংলাদেশের শ্রমাশ্রয়ী আয় অনেক দেশের তুলনায় দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এ সময় দুদেশের মধ্যে জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার জন্য এফবিসিসিআই এবং ইউএই চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
১১ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস আল খাইমায় বঙ্গবন্ধু ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষার উন্নয়নে দৃঢ়ভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। যে সমস্ত অঞ্চলে প্রবাসীরা রয়েছেন, ব্যবসায়ীরাসহ পরিবার-পরিজন ও সন্তানদের নিয়ে রয়েছেন সেখানে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুবিধায় বাংলাদেশি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা বহুদিন ধরে প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম। স্কুলগুলোর উন্নয়নের জন্য কিছু কিছু জায়গায় আমরা সহযোগিতা দিয়েছি।’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে সফর উপলক্ষে নাগরিক সংবর্ধনা ও রাস আল খাইমার বাংলাদেশ ইংলিশ প্রাইভেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে যখন আমি আরব আমিরাতে এসেছিলাম তখনও এখানে বাংলাদেশি স্কুল চালুর ব্যাপারে আলোচনা হয়েছিল। স্কুলটা যেন বন্ধ না হয় তার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তার জন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন সেখানে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।’ প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল বলেই ১৩ বছরে আপনারা পরিবর্তিত বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছেন। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশে কোনো জমি অনাবাদি রাখা না হয়Ñ এ আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিষয়টি প্রবাসীরা যেন তাদের পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের জানান। তিনি আরও বলেন, এটা করতে পারলে বিশ্বজুড়ে যতই অর্থনৈতিক মন্দা এবং খাদ্য ঘাটতি থাকুক না কেন আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। দেশের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, কেউ ইচ্ছা না করলে দেশে বেকার থাকার সুযোগ নেই। আবুধাবির আবাসস্থল থেকে শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে ৩টি ভেন্যুÑ দুবাইতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট, আবুধাবি থিয়েটার এবং রাস আল খাইমায় বাংলাদেশ ইংলিশ প্রাইভেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংযুক্ত ছিল।
লেখক : সহ-সম্পাদক, উত্তরণ