আমরা কেবল নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কষ্টে ভুগছে। পণ্যমূল্য পরিবহনের জন্যও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেখান থেকে খাদ্য বা তেল কিনতাম, যুদ্ধের কারণে কিনতে পারছি না। বিকল্প জায়গা খুঁজে বের করছি। সেখান থেকে যাতে আমরা খাদ্য, ডিজেল, তেল, সার আনতে পারি সেই ব্যবস্থা করছি।
উত্তরণ প্রতিবেদন: প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালের সুযোগ নিয়ে বিেরাধী দল রাজনৈতিক অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশ যখন এমন ক্রান্তিলগ্নে পড়ে তখন তাদের মাঝে (বিরোধী দল) ওই উদ্বেগ আমরা দেখিনি। বরং দেখেছি ওই সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ কীভাবে সৃষ্টি করা যায় সেটাই যেন তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাহলে অনুভূতিটা কোথায়? অনুভূতিটা থাকতে হবে দেশের জন্য। দেশপ্রেমটা থাকতে হবে। ক্রাইসিসের সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থাকে ঘোলাটে করা আর ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করার প্রবণতাটা পরিহার করতে হবে।
গত ২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সম্পূরক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা সব সময়ে ঐক্যে বিশ্বাস করি। যারা আসবেন তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করব। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
মুজিবুল হক চুন্নু তার প্রশ্নে বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দায় সকল রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন কি না জানতে চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বললেন? আমার প্রশ্ন এখানে? দেশ যখন এমন ক্রান্তিলগ্নে পড়ে তখন আমাদের যারা বিরোধী দল আছেন আমি সকলের কথা বলছিÑ তাদের মাঝে ওই উদ্বেগ আমরা দেখিনি। বরং দেখেছি এই সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক অশান্ত পরিবেশ কীভাবে সৃষ্টি করা যায়- সেটাই যেন তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটা করাটা কী সমীচীন হচ্ছে? সমীচীন হচ্ছে না। তাহলে ওই অনুভূতিটা কোথায়? অনুভূতিটা থাকতে হবে দেশের জন্য। দেশপ্রেমটাও থাকতে হবে।
সংসদ নেতা বলেন, ঐক্যবদ্ধ শুধু মুখে বললে হবে না। নিজের থেকে পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা কিন্তু সবাইকে নিয়ে কাজ করি। আমরা যখন উন্নয়নটা করি, কোন এলাকাটা আমাদের ভোট দিল বেশি আর কোন এলাকা দিল না- সেটা বিবেচনা করি না। জনমানুষের জন্য আমাদের উন্নয়ন। গণমানুষের কথা চিন্তা করে আমরা কাজ করি। ঠিক তেমনি দুর্যোগে মোকাবেলায় আমরা বসে থাকিনি। অনেকে তো সমালোচনা করে যাচ্ছেন। বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একমুট চালও দিয়ে বা হাত দিয়ে পানি থেকে কাউকে উদ্ধার করতে দেখিনি। তবে আমরা সব সময়ে ঐক্যে বিশ্বাস করি। যারা আসবেন তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করব। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বৈশ্বিক বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পণ্য বৃদ্ধির বিষয়ে আমি খোলামেলা কথা বলেছি। যদিও অনেকে আমার সমালোচনাও করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এভাবে কথা বললে মানুষ ভয় পেয়ে যাবেন। ভয় নয়, মানুষকে সতর্ক করার জন্য এটা বলেছি। শুধু সতর্ক নয়, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। তিনি বলেন, আমাদের মাটি অত্যন্ত উর্বর। আমরা ফসল ফলাব। খাদ্য উৎপাদন করব। আমরা ব্যবহার করব। আমরা সেটা করতে পারি। বাংলাদেশ পারে, আমরা অনেক ক্ষেত্রে এটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছি। সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কেবল নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ কষ্টে ভুগছে। পণ্যমূল্য পরিবহনের জন্যও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেখান থেকে খাদ্য বা তেল কিনতাম, যুদ্ধের কারণে কিনতে পারছি না। বিকল্প জায়গা খুঁজে বের করছি। সেখান থেকে যাতে আমরা খাদ্য, ডিজেল, তেল, সার আনতে পারি সেই ব্যবস্থা করছি। এমনকি এলএনজি আমদানির জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি এবং নিয়েছি।
গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই সঙ্গে স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা)। এই স্যাংশন দেয়ার ফলে বিশ্ববাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। সারাবিশ্বের অবস্থাই খুব টালমাটাল। তবে বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশ থেকে এখনও পর্যন্ত ভালো অবস্থায় আছে বলে মনে করি। তিনি বলেন, ইউরোপ, আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রতিটি জায়গায় জ্বালানি তেলের অভাব, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য ব্যবস্থা, সব জায়গায় লোডশেডিং। গ্রেট ব্রিটেনে বিদ্যুতের দাম ৮০ ভাগ বেড়েছে। তারা সবকিছু রেশন করে দিচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে যাতে প্রভাবটা না পড়ে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি। সবার কাছে আহ্বান জানাচ্ছি আমাদের খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। বারবার বলছি এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। যখন বিশ্বব্যাপী খাদ্যের অভাব, মূল্যস্ফীতি তখন আমাদের দেশে নিজেদের মাটি ও মানুষ নিয়ে চলার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছি।
বাজার থেকে পণ্য গায়েব বলে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তো আছেই। এই অসাধু ব্যবসায়ীরা নিজেদের আর্থিক লাভের কথা চিন্তা করে, মানুষের দুর্ভোগের কথাটা চিন্তা করে না। এজন্য তারা অনেক সময় পণ্য লুকিয়ে রাখে এবং কৃত্রিম উপায়ে জিনিসের দাম বাড়ায়। এতে অনেকের ইন্ধনও থাকতে পারে। তবে আমাদের মনিটরিং ব্যবস্থায় তাদের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা হয়, ধরা হয়। ইতোমধ্যে অনেক পণ্য কিন্তু খুঁজে বের করা হয়েছে এবং তা বাজারজাত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সব সময় সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। এভাবে কোনো না কোনোভাবে পণ্য লুকিয়ে রেখে মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ চলমান থাকবে।
দৈনিক প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির প্রতিবেদন প্রসঙ্গ টেনে বিএনপির রুমিন ফারহানার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, আমি আগেই বলেছি, ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার কিছু লোক থাকে। সেইসব লোকের কথাই মাননীয় সদস্য বলেছেন। যে পত্রিকাগুলোর নাম তিনি নিয়েছেন তার মধ্যে একটা পত্রিকা কিন্তু আমি কখনও পড়ি না। পড়ি না এই কারণে তারা সব সময় উল্টো দিকে থাকে। এরা কখনও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক তা চায় না।
একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তারা পছন্দ করে। পছন্দ করে এই জন্য যে তাদের একটু ভালো হয়, কোনোরকম কদর বাড়ে সে-জন্য। আর যে প্রতিষ্ঠানটির কথা বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠানটি কোন জায়গা থেকে হিসাব পায় জানি না। এই হিসাব তাদের কখনোই সঠিক হিসাব হয় না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশে দাম বেড়েছে সেটা তো অস্বীকার করছি না। আজকে সারাবিশ্বে যেভাবে পণ্যমূল্য বেড়েছে সেটা যদি দেখেন, সে তুলনায় বাংলাদেশে হয়নি। দাম বেড়েছে বলেই না আমরা ভর্তুকি দিয়ে স্বল্প মূল্যে যারা ক্রয় করার সক্ষমতা রাখে না তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছি।
সংসদ নেতা বলেন, হেডলাইন দিয়েছে সব দেশের থেকে বাংলাদেশে পণ্যমূল্য বেশি! কিন্তু ভেতরে যে ডাটা দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশ হিসাবে আসে না। বাংলাদেশ কয়েকটা দেশ থেকেই ভালো অবস্থায় আছে। তারা কারসাজিটা এভাবেই করে। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে কিছু কিছু পত্রিকা এখন এমনভাবে একটা হেডলাইন করে, যা বিভ্রান্তিকর। ভেতরে জাতি দেখুক সেটা সঠিক না। সঠিক তথ্য তারা দেয় না। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়। সিপিডির নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে প্রতিষ্ঠানটির কথা উনি (রুমিন ফারহানা) উল্লেখ করেছেন সে প্রতিষ্ঠান তো কোনো কিছুই ভালো লাগে না তাদের। তাদের ভালো লাগে কখন, যখন সেনাশাসন ছিল, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল তাদের একটু কদর বাড়ত। এই আশায় তারা বসে থাকে এটাই বাস্তবতা। তিনি বলেন, দেশের মানুষের দুঃখ কষ্ট লাগবে যা যা করণীয় আমাদের সাধ্যমতো করে যাব। পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ এবং স্যাংশনের জন্য প্রত্যেক জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। যুদ্ধ বন্ধ করার কথা আমি জাতিসংঘেও বলে এসেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে বলে এসব কথা বললে কোনো কোনো দেশ নারাজ হবে। কে নারাজ হলো জানি না। যুদ্ধের কারণে সারাবিশ্বের মানুষ ভুক্তভোগী। ইংল্যান্ডে বহু মানুষের মাছ-মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তিন বেলা খাবার খেতে পারে না। আমেরিকায় যারা একেবারে দরিদ্র, দারিদ্র্য বেড়ে গেছে। খাবার পাচ্ছে না, থাকার ঘর নেই, রোগের চিকিৎসা নেই। গৃহহীন মানুষের ভিড়। ইউরোপের অবস্থা এ ধরনের। শীত এসে যাচ্ছে তারা গরম পানি পাচ্ছে না। শেখ হাসিনা বলেন, এই যখন বিশ্বব্যাপী অবস্থা, বাংলাদেশের জনগণের জন্য কী করা সংসদ সদস্য হিসেবে উচিত সেটাই বলা দরকার। আর যে পত্রিকা আর যে প্রতিষ্ঠান ওই প্রতিষ্ঠানের সবাইকে আমার খুব ভালো চেনা আছে। আমাদের মতিয়া আপার ভাষায় বলতে হয়, একটা প্রতিষ্ঠান আছে তার প্রধানকে মতিয়া আপা নাম দিয়েছেন আসল নাম বাদ দিয়ে বলেছেন সেনাপ্রিয়। অর্থাৎ অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতিতে তাদের একটু দাম বাড়ে মূল্য বাড়ে, এটাই বাস্তবতা। আমরা জনগণের পাশে আছি, জনগণের সঙ্গে থাকব। তারা যেটা বলছে বলতে দিন। দেশের মানুষের কল্যাণে আমার যেসব কাজ সেগুলো আমি করে যাব। গণফোরামের দলীয় সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থায় ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার চরম আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য দেশের জনসাধারণের জীবনমান স্বাভাবিক রাখতে ও দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বাজারে খাদ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত রাখতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে উল্লেখ করে সংসদ নেতা বলেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জি টু জি পদ্ধতিতে ৫ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। আমদানির লক্ষ্যে ঋণপত্র খোলা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে এ সকল চাল ও গম দেশে প্রবেশ শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। নিরাপদ খাদ্য মজুদ গড়ার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান সচল রাখার প্রয়াসে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণভাবে ২২ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক নানারকম দুর্যোগ মোকাবেলা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। সরকারের সকল উদ্যোগের ফলে জনমনে অচিরেই স্বস্তি আসবে বলে মনে করেন তিনি।