Wednesday, October 4, 2023

চিরজীবী বঙ্গবন্ধু

রা শে দ খা ন মে ন ন:  পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ভোর। সেই ভোরেই পাশের রাস্তার বাসা থেকে আমার শ্বশুর হন্তদন্ত হয়ে এসে ঘুম থেকে জাগিয়ে যে খবরটি দিলেন, তা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। আমার শ্বশুরের বিবিসি শোনার অভ্যাস ছিল। সকালে বিবিসি-র সেই খবরে বঙ্গবন্ধু হত্যার যে সংবাদ দেওয়া হয়েছিল তা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সেটা যে সত্য তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তারপরও খবরের সত্যতা যাচাই করতে বাংলাদেশ বেতার খুলতেই খুনি মেজর ডালিমের সেই উন্মত্ত কণ্ঠের ঘোষণায় আরও স্পষ্ট হলাম যে বিবিসি সঠিক সংবাদই দিয়েছে। কিন্তু তারপরও বিমূঢ়তা কাটেনি। এই অবস্থায় কি করণীয় তাও বুঝতে পারছিলাম না। কারণ পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতাতেই জানতাম এ ধরনের পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক কর্মী-নেতাদের জন্য বিপজ্জনক- তা তিনি সরকার অথবা বিরোধী দল যেখানেই অবস্থান করুন না কেন। অল্প সময়ের মধ্যে এই বিপদের দিকগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যখন দেখলাম ‘বাংলাদেশ বেতার’ পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘রেডিও বাংলাদেশ’-এ। ‘জয় বাংলা’ পরিবর্তিত হয়ে গেছে ‘জিন্দাবাদ’-এ। ‘জয় বাংলা’কে নির্বাসন দিয়ে ‘জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন কোন ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে সেটা বুঝতে একজন রাজনৈতিক কর্মীর খুব অসুবিধা হওয়ার কথা না।
বেলা গড়াতে রেডিওতে তিন বাহিনীর প্রধানের খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের চার জাতীয় নেতা বাদে অধিকাংশ বাকশাল মন্ত্রীদের খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ এবং ঢাকাসহ দেশব্যাপী সামান্যতম তাৎক্ষণিক দৃশ্যমান প্রতিরোধের অনুপস্থিতিÑ এসব ঘটনায় এটা বোঝা গিয়েছিল যে দেশের পরিস্থিতি ১৮০ ডিগ্রি উল্টা দিকে ঘুরে গেছে। যারা বাকশাল নিয়ে অতি উৎসাহ দেখিয়েছে, অন্যকে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করেছে, তারাই এখন ঘোর বাকশাল বিরোধীতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থাতে যে কথাটি আমার মনে প্রথম এসেছিল, সেটা হলো ’৭৫-এর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের কথা। ইতোমধ্যে ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস হয়েছে। সংবিধানের ঐ চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে দেশে একটি জাতীয় দল থাকবে। অন্য সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হবে। সংসদ সদস্য যারা জাতীয় দলে- পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু যার নামকরণ করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল- যোগদান করবেন না তারা তাদের সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। শ্রমিক, কৃষক, নারী, ছাত্র, যুবÑ এ ধরনের সকল ক্ষেত্রেই একটি মাত্র গণসংগঠন থাকবে। অন্যগুলো বিলুপ্ত হবে। এ অবস্থায় আমাদের পার্টির মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে পার্টির গোপন অস্তিত্ব ও কাঠামো বজায় রেখে বাকশালের মধ্যে ফ্যাকশনাল কাজ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ নিয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হওয়ায় পরে সেটা পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত হয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ অথবা দেশব্যাপী পরিচিত ব্যক্তি বাকশালে যোগদান করবেন না। তবে দেশে একটিমাত্র আইনসংগত ট্রেড ইউনিয়ন থাকায় কারাখানার কর্মরত শ্রমিকরা সেই ইউনিয়নে থাকবেন।
‘বাকশালে’ এই যোগদানের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আমাকে ও বন্ধু হায়দার আকবর খান রনোকে তার সাথে দেখা করার জন্য তার একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দিনকে- যিনি আমাদের সহপাঠী ও বন্ধু- দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আর সে অনুসারে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাসায় আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার নিজের লাইব্রেরি ঘরে বসিয়ে তিনি আলাপ করেছিলেন আমাদের সাথে।
বাইরে থেকে ফিরে একটু ফ্রেস হয়ে আসার জন্য ওপরে গিয়েছিলেন। এই ফাঁকে বন্ধু রনো তার লাইব্রেরির আলমারিতে সাজানো বইগুলো দেখছিল। ওপর থেকে নেমে লাইব্রেরিতে ঢুকেই তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চোখ টিপে রনোকে বললেন, ‘কি দেখছিস। লেনিনের বইও আছে, মার্কসের বইও আছে।’ তারপর কথা শুরু হলো। তিনি বললেন, ‘শোন। সিরাতুল মুশতাকিনের মানে বুঝিস? মানে হলো সিধা রাস্তা। আমি ঠিক করেছি সমাজতন্ত্র করে ফেলব। বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারার গল্প জানিস? আমি অলরেডি লেট। আর দেরি নয়। এবার সমাজতন্ত্র করে ফেলব। তোরা চলে আয় আমার সঙ্গে। আমি পাঞ্জাবি ক্যাপিটালিস্ট তাড়িয়েছি। তাই বলে মাড়োয়ারি ক্যাপিটালিস্ট অ্যালাও করব না। আমি ক্যাপিটালিজম হতে দেব না। আমি সোস্যালিজম করব। তোরা চলে আয় আমার দলে।’
আমাদের উত্তর ছিল- ‘সমাজতন্ত্রের জন্য তো আমরা ছাত্রজীবন থেকেই লড়াই করছি। এর জন্য আমাদের ডাকতে হবে না। যদি সত্যিই সমাজতন্ত্র করেন, আমরা থাকব। কিন্তু এখন যা চলছে তা সমাজতন্ত্র নয়। আপনি জানেন আমরা ভয়ও পাই না, প্রলোভনেও ভুলি না।’ তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তা তো জানি তোদের একটা নীতি আছে। তার জন্যই তো তোদের চাই।’ রনো বলল, ‘এভাবে যদি দেশ চলে তাহলে আমরা কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে নামব।’ তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘তোদের আগে আমিই নামব। যারা দেশটার সর্বনাশ করছে তাদের বিরুদ্ধে আমার আগে কে নামবে?’
এ-ধরনের অনেক কথাই হয়েছিল সে-রাতে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে যার মধ্যে ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, বাংলাদেশ-সোভিয়েত সম্পর্ক, মস্কোপন্থি কমিউনিস্টদের কারসাজি, ন্যাপ, ভাসানী, সিরাজ শিকদার- এ-ধরনের বিবিধ প্রসঙ্গে যা এখানে লিখতে গেলে পরিসর অনেক বড় হবে। আমরা তাকে বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, ‘আমরা বাকশালে যোগ দেব না। প্রকাশ্যেই থাকব। বাকি আপনার ইচ্ছা।’ তিনি শেষে বলেছিলেন, ‘যা, দেখ আমি কি করি। ওয়াচ অ্যান্ড সি।’
কিন্তু সেটার দেখার সুযোগ দেশবাসীর হয় নাই। ঘাতকের বুলেট তার বুক বিদীর্ণ করেছে। চরম নৃশংসতায় তারা সমস্ত পরিবারকে হত্যা করেছে। ঢাকা থেকে দূরে তার নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে তাকে তড়িঘড়ি দাফন করেছে। ভালোভাবে গোসল, কাফন, জানাজাও সেভাবে করতে দেয় নাই।
কিন্তু টুঙ্গিপাড়ার সাধারণ সেই কবর থেকে তিনি নিজ মহিমায় ভাস্বর হয়ে রয়েছেন প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। তার দৈহিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি চিরজীবী হয়ে আছেন এদেশের মানুষের মধ্যে।

লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং ১৪-দলের নেতা

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য