- মাসুদ পথিক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দলটির গোড়াপত্তন হয় ২৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এবার আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিতে বেশ কিছু মাইলফলক উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা আজ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের পথচলায় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অবদান পরিপূরক না-হলেও অনেক আদর্শিক সাদৃশ্য রয়েছে।
* বাংলা চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির গোড়াপত্তন আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর হাতেই। দেশভাগ এবং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর এ অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে হটিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায়, শেখ মুজিবুর রহমান হন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। এ সময় ঢাকায় একটি স্থায়ী ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করেন আবদুল জব্বার খান, ড. আবদুস সাদেক, নূরুজ্জামান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু তাদের একটি পরিকল্পনা পেশ করতে বললে তারা তা করেন। ১৯৫৬ সালে সরকার প্রদেশে চলচ্চিত্র শিল্প প্রসারের লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। পরের বছর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে এখানে একটি সংস্থা গঠনকল্পে ১ কোটি টাকা বরাদ্দের উদ্যোগ নেয়। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দের দাবি তোলেন প্রাদেশিক চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান নাজীর আহমদ। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা তখন পূর্ব পাকিস্তানে একটি চলচ্চিত্র সংস্থা গঠনের পরামর্শ দেন। এ বিষয়টি নাজীর তখন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নজরে আনেন। তিনি সব শুনে সত্বর ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ প্রতিষ্ঠার বিলের একটি খসড়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির নির্দেশ দেন। তখন প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন শেষ হতে মাত্র দুদিন বাকি। এ অবস্থায় শিল্প দপ্তরের উপ-সচিব আবুল খায়ের ও নাজীর আহমদ তাড়াতাড়ি এফডিসি বিলের কাগজপত্র তৈরি করেন। এরপর ওই বছরের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিন বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিল উপস্থাপন করেন।
* আমাদের রক্তধারায় নানা ধাপে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান পেরিয়ে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধ দিয়েছে স্বাধীনতা, দিয়েছে মুক্তির সোপান। শিল্প-সাহিত্যের অপার, অগাধ মশলা আর প্রেরণার স্ফুলিঙ্গ। গত ২৬ মার্চ আমরা উদযাপন করলাম জাতীয়ভাবে স্বাধীনতার ৫০ বা সুবর্ণজয়ন্তী। এবারে কড়া নাড়ছে চেতনার দরজায় বিজয়ের ৫০ বা সুবর্ণজয়ন্তী। পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও পূর্ণ করল ৭৩তম বার্ষিকী। দীর্ঘ এই সময়ে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র ব্যাপক বিবর্তন ঘটেছে।
* আওয়ামী লীগের অবদান চলচ্চিত্র শিল্প কতখানি, তা পর্যালোচনায় বেশ কিছু দিক উঠে এসেছে।
শিল্পকলার সর্বকনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখাটির নাম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের যাত্রা ইতিহাসে আজ অবধি নানা বিষয়ে নির্মিত হয়ে আসছে।
প্রেম-বিরহ, দেশপ্রেম, রহস্য ও গোয়েন্দাসহ অতিপ্রাকৃত ভৌতিক, আদি ভৌতিক, জাদু বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা প্রভৃতি। তথাপি মানুষই এখন এর মূল কেন্দ্রবিন্দু। অতএব, মানুষের ইতিহাস, বীরত্বে বহুকৌণিক আলে ফেলে সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী হচ্ছে। সম্প্রতি প্রযুক্তি দখল করে নিয়েছে সিনেমার একটি বড় অংশ। কিন্তু এত কিছুর ভিড়েও যুদ্ধ-সংগ্রামের ইতিহাস যেন ভিজ্যুয়াল দালিলিক রূপ পেয়েছে সিনেমার কল্যাণে।
পৃথিবীর বড় সব বিপ্লব, যুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রামের ওপর রচিত হয়েছে সাহিত্য। কবিদের কবিতায়, নাট্যকারের নাটকে, গল্পকারের গল্পে কিংবা উপন্যাসে গাঁথা হয়েছে এবং বিপ্লব-সংগ্রামের নানামাত্রিক বয়ান। এর পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান অনস্বীকার্য।
* শিল্পের সবচেয়ে আধুনিক মাধ্যম সিনেমাও এক্ষেত্রে কম যায়নি। এসব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বড় অনেক সিনেমা। নির্মিত সব চলচ্চিত্রই যে মান বিচারে নিখুঁত হয়েছে তা নয়। তবে যা নির্মিত হয়েছে সবটাই আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টা। কেননা প্রগতি, উন্নয়ন, একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্রের ব্যাপক গতি আসে। তখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে পরিচালকরা উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
* স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিকাশ ও চর্চার ক্ষেত্রে গতি পায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে ১৪-১৫টি চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশন। আর সংসদগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি চলচ্চিত্রের উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায়। আন্তর্জাতিকভাবে এদেশের নির্মাতা-কলাকুশলীদের পরিচয় করিয়ে দিতে এবং বাইরের চলচ্চিত্রকে এদেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকালে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় পোল্যান্ড চলচ্চিত্র উৎসব, ১৯৭৪ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলে বিদেশে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রতিনিধিত্ব করে। একই সঙ্গে পুরস্কারও পায়। ১৯৭২ সালের তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ পুরস্কার পায়। এটি পরে সিডালক পুরস্কারও অর্জন করে। ১৯৭৩ সালে সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ মস্কো, ১৯৭৪ সালে মিতার ‘আলোর মিছিল’ তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়।
* বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানি ও প্রদর্শনে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেন। দেশি চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ হয়। একই বছর ভারত থেকে শুধু বাংলা চলচ্চিত্র আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় চলচ্চিত্র কর্মীদের প্রতিবাদের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। একই সময়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমদানিকৃত উর্দু, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র এদেশীয় আমদানিকারক ও পরিবেশকরা ‘বাংলাদেশের সম্পত্তি’ হিসেবে প্রদর্শনের অনুমতি চাইলে বঙ্গবন্ধু তাদের সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
* চলচ্চিত্র রপ্তানিতে গতি আসে বঙ্গবন্ধুর আমলে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিদেশে রপ্তানি শুরু হয় তখন। বিভিন্ন ছবি রপ্তানি বাবদ ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ২ হাজার, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ১১ হাজার ও ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রবর্তিত সেন্সর আইন ও বিধি সংশোধন করা হয় বঙ্গবন্ধুর সময়কালে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সিনেমাটোগ্রাফ রুলস, ১৯৭২; দ্য সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট, ১৯৬৩।
* ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ সময়কাল বিধৃত হয়েছে দেশি-বিদেশি মুভি ক্যামেরায়। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা, প্রতিবাদ, জনসভা, সংবর্ধনা, অসহযোগ আন্দোলন, সাক্ষাৎকার, ৭ মার্চের ভাষণ চলচ্চিত্রের উপাদান হিসেবে উঠে আসে।
* রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা ও নেতৃত্বের পেছনে প্রচ- পরিশ্রম করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি চলচ্চিত্র উপভোগ করতেন। ‘রূপবান’ এবং ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ সিনেমা দুটি দেখে বঙ্গবন্ধু উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন।
* বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা আসতেন এবং বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। অন্যান্য দেশের নির্মাতাদের সঙ্গেও তার দারুণ সম্পর্ক ছিল। এদের মধ্যে রয়েছেন কিংবদন্তি ভারতীয় নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ও জাপানের নির্মাতা নাগিসা ওসিমা।
* পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনাও চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট এবং দায়বদ্ধ। তাই তিনি তার শাসনকালে ব্যাপকভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। রেখে চলেছেন। বিএফডিসি উন্নয়ন, অনুদান দেওয়া, পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে নতুন হল নির্মাণের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার বিনা সুদে ঋণ দিয়েছেন। এবং দেশের বাইরে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রসারের জন্য উৎসাহিত করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের অনুদানকে ত্বরান্বিত করে ১/২ থেকে ২০টি চলচ্চিত্রকে প্রতিবছর অনুদান দিচ্ছেন। ঢাকার অদূরে চলচ্চিত্রের জন্য ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমি বরাদ্দ দিয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রকে ব্যাপকভাবে প্রাণিত করে চলেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শ্যাম বেনেগালের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (মুক্তি প্রতীক্ষিত) নির্মাণ করাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী লক্ষ্য রেখে এই প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে তার জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র।
লেখক : কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা