ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর সফল বাস্তবায়নের পর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বেই আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যোগ দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে যাব আরও উচ্চতার শিখরে। বাস্তবায়ন হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
সালাহউদ্দীন আহমেদ আজাদ: বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বহুল আলোচিত একটি বিষয়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসলে কী? আসুন এর সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আলোচনা করা যাক। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ফোন এখন আর আগের মতো বোকা নয়। এই ফোন এখন ‘স্মার্ট’ বা বুদ্ধিমান, কারণ এটা অন্যের সাথে কথা বলা ছাড়াও ছবি তোলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারসহ অনেক কাজ করতে সক্ষম। সাথে সাথে ঘড়ি, চশমা ইত্যাদিও এখন স্মার্ট হয়ে গেছে, যেমন- স্মার্ট ওয়াচ ও স্মার্ট গ্লাস। এখন উন্নত বিশ্বে একটি সম্পূর্ণ বাড়িও স্মার্ট এবং কোনো কোনো শহরও হয়ে গেছে স্মার্ট সিটি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন, সংক্ষেপে ফোরআইআর (4IR) কিংবা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০, হচ্ছে কয়েকটি প্রযুক্তির সমন্বয় যেমন- আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ওয়েরেবল টেকনোলজি (পরিধেয় প্রযুক্তি), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), থ্রি-ডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইত্যাদি। বিভিন্ন প্রযুক্তির সমন্বয়ে গঠিত এই শক্তিটি ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে পড়ছে। কোনো অপরিচিত জায়গায় যেতে হলে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না, গুগল ম্যাপ আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ফেসবুক আপনার বা আপনার বন্ধুদের ছবি খুব সহজেই চিনতে পারে এবং আপনাকে ট্যাগ করতে বলে। আপনি ভোট দিতে গেলে মেশিনের ওপর আপনার আঙ্গুল বসালে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে এটা আপনার জাতীয় পরিচয়পত্র স্ক্রিনে তুলে ধরে। এগুলো হয় আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-এর সাহায্যে। এআই এতই শক্তিশালী যে এটা মানুষের মস্তিষ্ককেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। পৃথবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, স্পেইস এক্স, টেসলা মোটরস, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মালিক ইলন মাস্ক এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর একটি উক্তি করেছেন; তিনি বলেন, “যদি এআই-এর একটি লক্ষ্য থাকে আর মানব সভ্যতা এর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে এআই মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করে ফেলবে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই।” উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমরা যখন রাস্তা নির্মাণ করি তখন সেখানে কোনো পিঁপড়ার ঢিবি থাকলে আমরা তা ধ্বংস করে ফেলি। আমরা কিন্তু পিঁপড়াকে ঘৃণা করি না; কিন্তু আমাদের সভ্যতার উন্নয়নের জন্য রাস্তা নির্মাণ পিঁপড়ার ঢিবির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” ইলন মাস্ক এআই-এর ওপর একটি প্রকল্প শুরু করেছেন, যার নাম ওপেন আই (OpenAI)।
ফোরআইআর ও বাংলাদেশ
করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির ব্যবহার ফোরআইআর-কে আরও বেগবান করেছে এবং এটা এখন আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও প্রস্তুত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বা ফোরআইআর-এ অংশ নিতে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ক্ষমতা ও প্রভাব দুই-ই আগের ৩টি শিল্প বিপ্লব থেকে বেশি। এই বিপ্লবে সবকিছুই ঘটছে খুব দ্রুতগতিতে। ফোরআইআর যে শুধু প্রযুক্তি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে তা নয়, এর প্রভাব পড়বে শিক্ষা, কৃষি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে। এটা একটি সার্বজনীন চ্যালেঞ্জ, তাই সব মন্ত্রণালয়কে একসাথে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (ফোরআইআর) সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। তিনি বলেন, সরকার চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সময়োপযোগী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
ফোরআইআর-এর সুবিধা
* ফোরআইআর পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে অটোমেশন ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিল্প ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসবে।
* মানুষের সার্বিক জীবনধারার উন্নয়ন হবে।
* চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিরাট পরিবর্তন আসবে সুস্থতায় বংশগত রোগ কমাতে আসবে নীরোগ জিন। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে ছুরি-কাঁচি ছাড়া লেজারের মাধ্যমে সার্জারি হবে। রোবটের মাধ্যমেও সার্জারি হবে, যা একজন ডাক্তার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। রোগীর চিকিৎসা হবে রিমোট মনিটরিং অর্থাৎ দূরবর্তী পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, ওয়েরেবল টেকনোলজি কিংবা পরিধেয় প্রযুক্তি (স্মার্ট ওয়াচ, স্মার্ট ক্লোদস, স্মার্ট শু, ইত্যাদি) মানুষের হৃদস্পন্দন, ব্লাড প্রেশার, শ্বাস-প্রশ্বাস, ব্লাড গ্লুকোজ, ক্যালরি গ্রহণ ইত্যাদি ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখবে।
* শিল্প-কারাখানায় উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। একজন মানুষের তুলনায় রোবট অনেক বেশি উৎপাদনে সক্ষম এবং তা হবে অনেক বেশি উন্নতমানের ও ত্রুটিহীন।
* ড্রোনের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ সহজ হবে এবং ই-কমার্সে এই সাফল্য ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যাবে।
* বর্তমান বিশ্বে জ্বালানি শক্তির চেয়ে ডাটা এখন অধিক মূল্যবান। ফোরআইআর বাস্তবায়ন হলে অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে উন্নতমানের, তথ্যবহুল ডাটা আদান-প্রদান সম্ভব হবে।
ফোরআইআর-এর ক্ষতিকর দিক
ফোরআইআর-এর প্রযুক্তিকে সামাল দিতে পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীলÑ উভয় দেশকেই কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। ২০২০ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর এক গবেষণায় বলা হয়, স্বয়ংক্রিয়তা বা অটোমেশনের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮০ কোটি অদক্ষ শ্রমিককে কর্মসংস্থানের বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৬০ শতাংশ, আসবাবপত্র শিল্পে ৫৫ শতাংশ, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য শিল্পে ৪০ শতাংশ, চামড়া ও জুতা শিল্পে ৩৫ শতাংশ এবং সেবা শিল্পে ২০ শতাংশ লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের দেশের অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করতে হবে এবং কারিগরি দিক থেকে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। যখন সবকিছু কানেকটেড হয়ে যাবে, তখন ডাটা হ্যাক করা এবং এই ডাটা খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা সহজ হয়ে পড়বে।
পরিশেষে
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির বীজ বপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যখন তিনি ১৯৭৫ সালে রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় একটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র চালু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত নিষ্ঠুর ঘটনার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং এদেশ ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ আবার নতুন করে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করে এবং বাংলাদেশকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
আমরা আশা করতে পারি, ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর সফল বাস্তবায়নের পর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বেই আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে যোগ দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে যাব আরও উচ্চতার শিখরে। বাস্তবায়ন হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক : স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক গবেষক