ই না ম আ হ ম দ চৌ ধু রী: বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন মহাত্মা গান্ধীর তিরোধানে বলেছিলেন, “আগামী প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে যে তাঁর মতো রক্তমাংসের গড়া একজন মানুষ কোনোকালে পৃথিবীর বুকে পদচারণা করেছিলেন।” সত্য, সাম্য ও ন্যায়ের ধ্বজাধারী কালজয়ী বিপ্লবী কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, “হিমালয় (পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত) তিনি কখনও দেখেন নি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেই তাঁর হিমালয় সন্দর্শন হয়েছিল।” বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ ছিল একটি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। বাস্তবিকই পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানবিক উচ্চতার আরেকজন জননায়কের দেখা মেলে না যিনি সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির প্রতিবাদী হয়ে, মাতৃভাষার ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ধ্বজাধারী হয়ে একটি জাতিসত্তার সৃষ্টি করেন। সকলের প্রতি ভালোবাসা ও অহিংসার বাণী নিয়ে চরম রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার অসাধ্য সাধন করেছিলেন। ভাবলে গৌরব মিশ্রিত একটি অনুভূতির সৃষ্টি হয় যে এমন একটি মহামানবের ব্যক্তিগত সান্নিধ্য লাভের বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
সন, ১৯৫৩। আমি তখন ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি। একুশে ফেব্রুয়ারি কলেজ প্রাঙ্গণে আমাদের উদ্যোগে স্থানীয় মালমশলা দিয়েই কর্তৃপক্ষের তুমুল বাধা সত্ত্বেও একটি শহিদ মিনার নির্মিত হলো। পুষ্পস্তবক অর্পণ করে উদ্বোধন করলাম। কলেজ কর্তৃপক্ষ রুষ্ট হয়ে ‘শৃঙ্খলাবিরোধী’ কাজের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। ২ এপ্রিল কলেজ ছাত্র-সংসদের উদ্যোগে তদানীন্তন ব্রীটানিয়া হলে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী চেতনা-বিধৃত একটি গীতি-নকশা এবং কবি-সাহিত্যিক বন্ধুবর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর কালজয়ী গান- ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’, আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে জনসমক্ষে প্রথম পরিবেশিত হলো। গীত হলো ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’, আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়’ এবং ঐ জাতীয় বিপ্লব ও বিদ্রোহভিত্তিক গান। পুলিশ রিপোর্ট হলো অনুষ্ঠানে হয়েছে সরকার-হটানো এবং জেল-ব্রেকিংয়ের আহ্বান। গভর্নিং বডির জরুরি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রনেতা ইকবাল আনসারী খান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ভিপি মশির হোসেন এবং জিএস-কে (অর্থাৎ আমাকে) কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করা হলো। প্রত্যাহার দাবিতে শুরু হলো ক্লাস বয়কট ও আন্দোলন। এক পর্যায়ে আমরা দেশের প্রধান বিরোধী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তদানীন্তন রমনা রেস্ট হাউসে দেখা করলাম। তা ছিল তখন বিরাট উত্তেজনা ও শ্লাঘার ব্যাপার। সব শুনে তিনি বললেন, ‘সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে পিটিশন দাও। সুরাহা না হলে কোর্টে যাওয়া যাবে। প্রদর্শিত অভিযোগে এই বহিষ্কারাদেশ ধোপে টিকবে না।’ সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখা হলো এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন নেতৃসুলভ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। আমি চিনতাম না, কিন্তু সহসঙ্গী দু-একজন বলে উঠলেনÑ এই তো শেখ মুজিবুর রহমান (তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু অভিহিত নন) বিশ^বিদ্যালয়ে নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের দাবি আদায়ের সফল আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা হতে সুখ্যাত। তাকে ঘটনাটি বলা যায়। তিনি আগ্রহসহকারে আমাদের বৃত্তান্ত শুনলেন। বললেন (এই মর্মে) ‘তোমাদের কথা অবশ্য আমি আগেই শুনেছি। কর্তৃপক্ষ মাত্রাধিরিক্ত অন্যায় কাজ করেছেন। তোমাদের জোর আন্দোলন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে। অন্য কলেজের ছাত্রদেরও সহযোগিতা চাও। আমরা সমর্থন দেব।’
আমরা বিপুলভাবে উৎসাহিত ও উদ্দীপিত বোধ করলাম। আরও জোরালোভাবে শুরু হলো আন্দোলন। বিস্তৃতিতর পরিবেশে। বস্তুতপক্ষে শেখ মুজিবের ঐ বলিষ্ঠ উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো ছিল এক অর্থে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। কিছুকালের মধ্যেই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহৃত হলো। জীবনের প্রারম্ভেই এই মহান নেতার (পরবর্তীতে জাতির পিতার) এমন একটি উদ্দীপক সাক্ষাৎ হয়ে দাঁড়াল আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ অর্জন।
পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ১৯৫৪-৫৫ সালের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ভিপি এএমএ মুহিত (পরবর্তীতে সচিব এবং অর্থমন্ত্রী) জিএস মাহবুব আনাম এবং জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছিলাম আমি। ঐ এবং পরবর্তী দশকের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শেখ মুজিবের ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ বা নেতৃসুলভ ভূমিকা। গবেষক লেখক সৈয়দ আবুল মকসূদ তার কাগমারী সম্মেলন বিষয়ক গ্রন্থে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বন্ধুবর জহির রায়হান ও আমার নাম উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি হয়েছিলাম আমি এবং জিএস জহির রায়হান। মনে পড়ে, তখন শেখ মুজিবের মধ্যস্থতায় কাগমারী সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ২ লাখ টাকা প্রদান এবং বহুবিধ সহায়তা করেছিলেন। ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে যখন চৌ এন লাই ঢাকা এলেন তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসীন। ঢাকার ছাত্ররা চাইল তাকে অভ্যর্থনা দিতে। সময়াভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মধ্যস্থতায় ঠিক হলো যে অতিথির মোটর শোভাযাত্রা যখন বর্তমান টিএসসি’র পাশ দিয়ে যাবে ঐ সময় তিনি সামান্য ক্ষণ যাত্রাবিরতি করবেন। তখন ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমি তাকে একটি স্বাগত অভিনন্দন সূচক মানপত্র দিয়েছিলাম এবং চৌ এন লাই সংক্ষিপ্ত উৎসাহব্যঞ্জক প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন। তখন দেশে বিদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রভূত সম্মান ও স্বীকৃতি। এ জন্যই সম্ভবত ১৯৫৭ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে এসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির কিছুটা নতুন মোড়ের ব্যাখ্যা দেবেন বলে স্থির হলো। জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘ নির্দেশিত কাশ্মীরের ‘disputed status’ এবং গণভোটের সিদ্ধান্তের বরখেলাফে ভারতভুক্তির একটি ঘোষণা ভারত সরকার দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হতো যে সরকার স্থির করলেন এ-প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যামূলক ভাষণ দেওয়ার জন্য হেলিকপ্টারে এমএস হল টেনিস কোর্টে অবতরণ করবেন এবং তার সঙ্গে থাকবেন মাত্র একজন ছাত্রদের জন্য সর্বগ্রহণযোগ্য নেতা। আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুতপক্ষে তার উপস্থিতির জন্যই পূর্ণ শান্তিশৃঙ্খলার মধ্যে পররাষ্ট্রনীতি ও কাশ্মীরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্রদের ঐ বিরাট সমাবেশ করা সম্ভবপর হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তার বিখ্যাত ০ + ০ + ০ = ০ থিয়োরি বিশ্লেষণ করে বুঝালেন শুধুমাত্র দুর্বল বা অকার্যকর রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সখ্যতা করলে কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্তিতে শূন্যই থেকে যায়। তাই বিশ্বমঞ্চে আত্ম-প্রতিষ্ঠা ও স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন শক্তিধরদের সঙ্গেও সখ্যতা ও জোট স্থাপন। [পৃ. ৩১, Sheikh Mujib, Liberation War and Bangladesh by Abdul Khaleque, বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্ট্র সচিব এবং আইজিপি]
১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিস পাকিস্তানে যোগদানের পরে আমার প্রথম পোস্টিং হলো সিরাজগঞ্জের এসডিও (বর্তমানে জিলা) মহকুমা হাকিম। খুবই রাজনীতি সচেতন ও কর্মচঞ্চল জায়গা। যোগদানের কিছুদিনের মধ্যেই প্রদেশের জনপ্রিয় গভর্নর আজম খান (যিনি ১৯৬৫ সালে বিডিভিত্তিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু এবং অন্যদের সঙ্গে থেকে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের সমর্থিত প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলেন)-এর পরিবর্তে এলেন গভর্নর মোনেম খান। কিছুদিনের মধ্যেই সম্ভবত সলঙ্গাতে একটি ডাকাতির কেসে সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (অস্থায়ী সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ)-কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। জামিনের আবেদন হলে আমি নিজেই শুনানি নিয়ে যুক্তি-সমন্বিত স্বলিখিত একটি দীর্ঘ আদেশে তাকে জামিন দিলাম। গভর্নর মোনেম খান তাতে খুব রুষ্ট হয়ে আমাকে ফোন করে তার তীব্র উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমি তাকে জানাই আইন অনুসারে আমি যথাযথ কাজ করেছি বলেই আমার বিশ্বাস। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের আড়িপাতার কল্যাণে খবরটি তড়িৎ গতিতে রাষ্ট্র হয়ে গেল এবং গুজব হলো এসডিও-কে অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তা হয়নি; বরং আমার লাভ হলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গেলাম। মনে আছে, তখন শহরের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এসে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। আওয়ামী লীগের নেতা ড. জসিম উদ্দিন সাহেব, ড. নিয়োগী প্রমুখ বললেন নেতা শেখ মুজিব এই ন্যায়োচিত সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিচারকের প্রশংসা করেছেন। উৎসাহিত বোধ করলাম। ন্যায়ের প্রতি দৃঢ় সমর্থন প্রদান বঙ্গবন্ধুর একটি মহৎ চারিত্রিক গুণ ছিল। আমার জীবনেও একাধিকবার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি অন্যায়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন সবখানে, আর ন্যায়বিচার, সুকর্ম এবং জনকল্যাণমূলক কাজ যারা যখন করেছেন, তাদের সমর্থনে ও প্রশংসায় সব সময়ই ছিলেন সোচ্চার। আবদুল খালেক [প্রথম স্বরাষ্ট্র সচিব এবং আইজিপি, প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ. ৩৭] উল্লেখ করেছেন “Public officials who were just and honest enjoyed his respectful address and words.” তার এই বলিষ্ঠ নীতিনিষ্ঠা এবং মানবিক ঔদার্য্যরে জন্য এলাকা-পেশা-জাতি-ধর্ম-দল-নির্বিশেষে সকলেরই তিনি ছিলেন আন্তরিকভাবে পরম শ্রদ্ধাভাজন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন (পৃ. ১৯৩), গরিব সরকারী কর্মচারীরা কখনও চায়না আমার কোনো অসুবিধা হোক। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য জনাব মতিয়ূল ইসলাম (তাঁর সরকারে বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব) ‘Recollections of a civil servant’ গ্রন্থে (পৃ. ১৯৮) উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালে কি করে তদানীন্তন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার উর্দুভাষী জনাব আলাউদ্দিন বহু প্রলোভন নিপীড়ন সত্ত্বেও ‘দেশদ্রোহিতার’ অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য লায়ালপুর সেন্ট্রাল জেলে চলমান ট্রাইব্যুনালে দেননি। এর জন্য জনাব আলাউদ্দিনকে বহু নিগ্রহ, তখন এবং পরবর্তীকালেও ভোগ করতে হয়েছিল। তিনি প্রকাশ্যেই বঙ্গবন্ধুর অন্যায়-বিরোধিতা ও নীতিনিষ্ঠার সপ্রশংস সমর্থন করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বহু বাঙালি পুলিশ এবং ডিসি ঢাকা শামসুল হক, ডিসি টাঙ্গাইল জালাল আহমদ, এসপি টাঙ্গাইল বদিউজ্জামানসহ আরও অনেকের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন (প্রাগুক্ত. পৃ. ১৯৮)। ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি পশ্চিম পাকিস্তানের তারেক খান বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন এই মর্মে যে তিনিই গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী। নির্বাচনের পরে ফেব্রুয়ারি ’৭১-এ তিনি ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তীতে তিনি এক সময় পেশোয়ারে স্বাধীন বাংলাদেশের অনারারি কন্সাল নিযুক্ত হন। ফরিদপুরের এককালীন ডিসি, সিএসপি সিদ্দিকীর নিরপেক্ষ প্রশাসন এবং জামিন দেবার ব্যাপারে সাহসিকতা ও আইন-নিষ্ঠার প্রশংসা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-উত্তরকালেও একাধিকবার করেছেন। মনে পড়ে, ব্যাংককের জাতিসংঘ এসকাপে এসএএমএস কিবরিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে পাকিস্তান থেকে অংশগ্রহণকারী সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াকু, উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম নেতা বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, “তাঁর ও তাঁর পরিবারের বর্বরোচিত হত্যাকা- ইতিহাসের পরমতম শোকাবহ ট্র্যাজেডি। ঢাকায় ভারতের প্রথম উপ-রাষ্ট্রদূত এবং পরবর্তীতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জেএন দীক্ষিতকে একাধিকবার বলতে শুনেছি মানুষ হিসেবে ও নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তুলনাহীন।
১৯৭১ সালের ১১ বা ১২ মার্চ। সিএসপি এসোসিয়েশনের পূর্বাঞ্চল শাখার সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের এসএম হাসান (আইসিএস-সিএসপি)। মাননীয় মেম্বর, বোর্ড অব রেভিনিউ। জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন মাদ্রাজের করীম ইকবাল, সিএসপি, যিনি একজন বাঙালি মহিলার (সিএসপি শামীম আহসানের বোন) পানি গ্রহণ করেছিলেন। এসোসিয়েশনের আহূত জরুরি সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে “সিএসপি অফিসারদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকার পরিচালনায় নিয়মতান্ত্রিক সহযোগিতা প্রদান ও কর্তব্য পালন। বর্তমানে দেশে একটি সর্বগ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন হয়েছে এবং গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্লামেন্টে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক দলের নেতাই অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানই সরকার গঠন করবেন। এই পরিবর্তনকালীন সময়ে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান এবং রাষ্ট্রীয় কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালন অফিসারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ ব্যাপারে তারা সচেতন এবং কর্তব্য পালনে সদা প্রস্তুত রয়েছেন।” সিদ্ধান্তের কপি প্রেসিডেন্ট, মার্শাল ল’ কার্যালয়, গভর্নর এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার কাছে পাঠানো হলো। বঙ্গবন্ধুর কাছে এক কপি রুহুল কুদ্দুস সাহেব নিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল। সঙ্গে আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত দেখে খুবই প্রীত ও সন্তুষ্ট বোধ করেন। এটা ছিল নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হিসেবে তার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ। তিনি বললেন, আমি তো তোমাদের ওপর নির্ভর করব। তাকে বলা হলো “স্যার, আপনার মৌখিক নির্দেশই তো এখন সারাদেশ চলছে।” এবং সত্যিকারভাবেই তখন তাই-ই ছিল। সব অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক, সংস্থা, কল-কারখানা, রেল-বাস, দোকান-পাট সবই বন্ধ হতো, খুলতো তারই নির্দেশে। প্রশাসনের সব স্তর এবং সমাজের সর্বাঙ্গের সঙ্গে একটি আশ্চর্য সুন্দর আস্থা, সম্মান ও অনুগত্যের সম্পর্ক তিনি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তার ব্যতিক্রমী সর্বত্যাগী অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের জন্যে।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন পিআই-এর বিশেষ বিমানে এবং লন্ডন থেকে ব্রিটিশ সরকারের প্লেনে দিল্লি হয়ে ঢাকা এলেন। এর আগে ৩ জানুয়ারি করাচির এক বিরাট জনসভায় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি সম্পর্কে সর্বসম্মত ইতিবাচক মতামত যাচাই করে ৭ তারিখ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানালেন। দুদিন লন্ডন থেকে ১০ তারিখ দিল্লি এলেন বঙ্গবন্ধু। সেদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারি প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য হিসেবে দিল্লিতে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক আগমন ও অভ্যর্থনা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। দিল্লিতে সেই স্বল্পকালীন বিরতির সময়ে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ এবং দেশপ্রেমের প্রত্যক্ষদর্শীর নজির দিচ্ছি। ব্রিটিশ প্লেনে দিল্লি পৌঁছার পর তিনি খবর পেলেন তার ও সহ-সঙ্গীদের ব্যাগেজ ঐ প্লেন থেকে নামিয়ে একটি ভারতীয় প্লেনে উঠানো হচ্ছে এবং সেই প্লেনে তিনি ঢাকা যাবেন। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, তা কেন? ব্রিটিশরা তো আমাকে ঢাকাতেই যাবার জন্যে প্লেনের ব্যবস্থা করেছে। মাঝপথে তা পাল্টাবো কেন? ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানালেন যে ঢাকার বিমানবন্দর ঐ ব্রিটিশ প্লেনের অবতরনের জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। বঙ্গবন্ধু তখন উপস্থিত বাংলাদেশের চিফ অব প্রটোকল ফারুক চৌধুরীকে বললেন, ওসব না জেনেশুনে কি তারা আমাকে পাঠাবে? খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা করো। দেখা গেল, ব্রিটিশ প্লেন অবশ্যই ঢাকা অবতরণ করতে পারবে। ব্যাগেজগুলো ব্রিটিশ প্লেনেই স্থানান্তরিত হলো। আয়োজন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু দিল্লির পরে কলকাতায় একটি জনসভায় ভাষণ দিয়ে ঢাকা যাবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, তা নয়। আমি প্রথমেই ঢাকা যেতে চাই। কলকাতা শিগগিরই আসব, পরে। তিনি সোজা ঢাকাই চলে এসেছিলেন তারই প্রতিষ্ঠিত নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রে অপেক্ষমাণ কোটি কোটি মানুষের কাছে। দিল্লিতে স্বল্পকালীন বিরতির সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য দীর্ঘ সময় ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন, তিনি আশা করছেন অদূর ভবিষ্যতেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘যখনই বলা হবে, ভারতীয় বাহিনী তখনই ফেরত যাবে’ এবং সেটাই ঘটেছিল ইন্দিরা গান্ধীর ১৭ মার্চ ঢাকা সফরের আগেই।
এ-প্রসঙ্গে আরও দুটো ঘটনা উল্লেখ করছি, যা জনাব মতিউল ইসলাম প্রাগুক্ত, (পৃ. ১০০, ১১৪, ১১৭) তার বইটিতেও উল্লেখ করেছেন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতের কলকাতা যান। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আলোচনাকালে ১৯৬৫ সালের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের Vested Properties প্রত্যর্পণের জটিল প্রশ্নটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল, ঐ সময়কার আইন ও রুলস রেগুলেশন দিয়ে যা করা হয়েছিল তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্যে পুনর্বিবেচনা বাস্তবসম্মত নয়। মিসেস গান্ধী এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেননি। ঐ সভা চলাকালীনই তখনকার একজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ উপদেষ্টা ডিপি ধর বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের বিধ্বস্ত রেলওয়ের পুনর্বাসনের জন্যে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তা দেখিয়ে তার অনুমোদন নেবার জন্যে পার্শ্ববর্তী কক্ষে তারা অবস্থান করছেন। মি. ধর বঙ্গবন্ধুকে ঐ কক্ষে যেতে আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু তখনই বললেন, আমার অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম আমার পক্ষ থেকে ঐ পরিকল্পনা পরীক্ষা করে আমাকে বলবেন। মি. ধর বঙ্গবন্ধুকে যেতে আবারও অনুরোধ জানালে বঙ্গবন্ধু বললেন, “অর্থ সচিবই আমাকে রিপোর্ট করবেন।” কী কারণে বঙ্গবন্ধু তখন যাননি তা পরিষ্কার নয়, তবে এটা ঠিক যে বিষয়টি সম্পর্কে অবশ্যই পূর্বে জ্ঞাত করাবার প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং পার্শ্ববর্তী কক্ষে যাবার আমন্ত্রণ মি. ধরের কাছ থেকে না এসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই আসা সংগত ও রীতিসম্মত হতো। এত তাৎক্ষণিক এবং যথাযথ ছিল বঙ্গবন্ধু বিচারবুদ্ধি ও আত্মসম্মানবোধ।
১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকালীন সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মি. রবার্ট ম্যাকনামারা বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। তখন বাংলাদেশের মুদ্রার অবমূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছিল। মিটিংয়ের অন্তিমকালে প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা কিছুটা পরামর্শের ছলে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেনÑ “প্রধানমন্ত্রী, আপনারা কবে টাকার অবমূল্যায়ন করবেন?” বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উত্তরÑ “মি. ম্যাকনামারা, আমার অর্থমন্ত্রী যদি তাজউদ্দীন না হয়ে আপনি হতেন এবং অবমূল্যায়নের সুপারিশ করতেন, তাহলে আমি আজই তা করতাম।” অন্য সবার সঙ্গে হেসে ম্যাকনামারা তখন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
এত ব্যস্ত রাজনৈতিক জীবনের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু চিরকাল খেলাধুলায় তুমুল উৎসাহী ছিলেন এবং ক্রীড়াকর্মের যথাসাধ্য পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। (শহিদ শেখ কামাল ও শহিদ শেখ জামাল যে গুণাবলি উত্তরাধিকার সূত্রেই যেন পেয়েছিলেন এবং তার যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আচরণেও যার যথার্থ প্রতিফলন দেখি)। আমার বাবা মরহুম গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী একজন নিবেদিত-প্রাণ ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার হওয়া ছাড়াও তিনি দীর্ঘকাল (ইপিএসএফ) ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট, টোকিও অলিম্পিকে (১৯৬৪) পাকিস্তানের চিফ অব মিশন ছিলেন। তার সম্পর্কে বিখ্যাত সাংবাদিক এবং ক্রীড়া প্রতিবেদক এবিএম মুসা ‘একজন নেপথ্য ক্রীড়াপ্রেমী স্মৃতিপটে গিয়াস উদ্দিন’ (পৃ. ১৩-১৪)-এ বলেন, “ষাটের উত্তাল রাজনৈতিক অঙ্গনের ঢেউ খেলার জগতেও বিস্তারিত হয়েছিল গিয়াসুদ্দিন চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াবিদদের স্বাধিকার, সমান মর্যাদা আদায়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই।” এবং বাবা বহুবারই এটা বলেছেন, “এ ব্যাপারে চিরকাল জোর সমর্থন ও অনুপ্রেরণা পেয়েছি রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন তরুণ নেতার কাছ থেকে এবং তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান।” জনজীবন ও রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের সর্বদিকেই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রখর নজর। যখন তিনি পঞ্চাশ দশকের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় একজন তরুণ মন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৬ সনে, তার উদ্যোগেই ব্রিটিশ অক্টোভিয়াস-স্টিল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা থেকে সরকার ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই নিয়ে নেয় এবং শুরু হয় এর আধুনিকীকরণ।
অবিশ্বাস্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি East Pakistan Small Industries Corporationএবং Film Development Corporation স্থাপন করেন এবং জোরালো প্রচেষ্টায় ওসবের জন্য কেন্দ্র থেকে অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের) অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প যে একটি অপরিহার্য অঙ্গ এবং তার ভূমিকা হতে পারে অপরিসীম, এ বিশ^াস চিরকালই বঙ্গবন্ধুর ছিল। পৃথিবীর এক ব্যস্ততম প্রধানমন্ত্রী হয়েও শত কাজের মধ্যে ২১ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে একজন তাঁত-শিল্পী জনৈক প্রীতিরাণী দাসকে স্বহস্তে উৎসাহব্যঞ্জক লিখা চিঠি তার একটি জ্বলন্ত প্রমাণ (ফটোকপি সংযোজিত-১) অর্থনীতিতে সমবায়ভিত্তিক সমাজতন্ত্রে তার গভীর আশা ও আস্থা ছিল। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েও শেখ মুজিব সমবায় আন্দোলনে যে উৎসাহ দেখান, তা অভূতপূর্ব। বঙ্গবন্ধু অবশ্য স্বেচ্ছায়ই তখন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে পার্টির কাজে মনোনিবেশ করাকে শ্রেয় মনে করেন। এটাও ছিল উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
আমি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম শিল্প ও বাণিজ্য সচিব ছিলাম। ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই (ডিসেম্বর ১৯৭১) আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নিযুক্ত হই। যথেষ্ট সংখ্যক কর্মকর্তার অভাবে আমাকে বেশ কিছুদিন অতিরিক্তভাবে শিল্প মন্ত্রণালয়েরও কাজ করতে হয় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকানার পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোতে একটি ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ঐ সংস্থার সর্বোচ্চ পদাধিকারী বাঙালি কর্মকর্তাকে প্রশাসক নিযুক্ত করার অর্পিত দায়িত্ব ছিল আমার। মার্চ মাসের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র চট্টগ্রাম ও খুলনা যান। মন্ত্রণালয় থেকে আমি প্রেরিত হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত একাগ্রতার সঙ্গে সমস্যাসমূহের সমাধানের উদ্দেশ্যে অবহিত হতে চান। ২৯ মার্চ ১৯৭২ চট্টগ্রামে পোলো গ্রাউন্ডে এক সুবিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, দরিদ্র জনগণের অর্থনৈতিক মানোন্নয়নই তার সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে তিনি সাবধান করে দেন যে সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচি যেন কেউ বানচাল করার অপচেষ্টা না করে। ৩১ মার্চ ১৯৭২ খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের প্রদত্ত ভাষণে তিনি বিশেষ করে উত্তেজিত শ্রমিকদের সব ধরনের ধর্মঘট ও ঘেরাও পরিহার করার কঠোর নির্দেশ দেন। শৃঙ্খলা বজায় রেখে সবক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে হবে, এই ছিল তার আহ্বান এবং তা তারা মন্ত্রশান্ত ভূজঙ্গের মতো শুনে সোৎসাহে সম্মতি জানায়। (মার্চ ৩০ ও ৩১, ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক বাংলা) ভাষণে তার Persuasive মোহময়ী শক্তি ছিল অসাধারণ।
দেশাভ্যন্তরে এত জরুরি চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক নীতি ও বহির্বাণিজ্য ছিল তারই অনুসৃত বাস্তবধর্মী নীতির প্রতিফলন। “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নেই” কার্যক্ষেত্রেও এটা ছিল প্রদর্শিত। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল তো শুরুতে ছিল শূন্যের কোঠায়। বঙ্গবন্ধু তখন ‘বার্টার এগ্রিমেন্ট’ করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দিলেন। স্বাধীনতার প্রথম দু-তিন বছর আমরা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য বিনিময় চুক্তি করি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত (কলকাতা) এবং ১-৪ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নে অত্যন্ত সফল রাষ্ট্রীয় সফর করেন। ঐ দুই দেশের সঙ্গে আমাদের সাধারণ বাণিজ্য চুক্তিও হয়। সব চুক্তি সমঝোতাতে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশ ছিল, শুধু বাংলাদেশের স্বার্থ-সংরক্ষণ নয়; বরং প্রাপ্তি এবং সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার যেন নিশ্চয়তা বিধান হয়। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই ভাবনা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে তিনি যখন জাপানে সরকারি সফর করেন তখন প্রস্তাবিত যমুনা সেতু নির্মাণে জাপানের সহযোগিতা বিশেষভাবে কামনা করেন। জাপান একটি feasibility study করতে সম্মত হয়, প্রথমে পদক্ষেপ হিসেবে। পরবর্তীকালে ইআরডি সচিব হিসেবে যখন সেতুটার অর্থায়নের জন্য বিশ^ব্যাংকের সঙ্গে নির্মাণের অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করি, তৎপূর্ববর্তী আলোচনায় এই সমীক্ষা সহায়ক হয়।
বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনাতেই বঙ্গবন্ধু গঙ্গা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর সুষম পানি বণ্টন ও ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
ভারতের একজন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব জেএন দীক্ষিত, যিনি শুরুতেই ঢাকায় তিন বছর ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন, তার প্রকাশিত বই Liberation and Bayond-এ লিখেছেন “শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাইতেন, তবে তিনি এও চাইতেন যে বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কারিগরি সম্পর্ক গড়ে উঠুক, যাতে বাংলাদেশকে ভারতের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল না হতে হয়।” বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বতন্ত্র সত্তা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ তার বিবেচনায় সর্বাগ্রে স্থান পেত।
১৯৭২ সালের মে মাসে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বার্ণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (UNCTAD-এর তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ তখনও জাতিসংঘের সদস্য হয়নি এবং চিলি তখনও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায় নি। তবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিকরণের জন্য UNCTAD (এবং GATT)-এর সদস্য পদলাভের বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তা বিবেচনা করে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তদানীন্তন বাণিজ্য মন্ত্রী এম আর সিদ্দিকী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আমি এবং টিসিবি’র উপ-প্রধান জনাব মোহসিন (পরবর্তীতে রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব) সমন্বয়ে একটি ডেলিগেশন চিলিতে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। শেষ মুহূর্তেও চিলির স্বীকৃতি না আসায় বাণিজ্যমন্ত্রী আর চিলিতে গেলেন না। তাই আমার নেতৃত্বেই ছোট ডেলিগেশনটি সান্তিয়াগো গেল। বয়ে নিয়ে গেলাম চিলির প্রেসিডেন্ট আয়েন্দেকে লেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের চিঠি। প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে অত্যন্ত সম্মান সহকারে বঙ্গবন্ধুর চিঠি পড়ে তার মহান নেতৃত্বের প্রশংসা করে বললেন, আমরা স্বীকৃতি জানাবার চেষ্টা করছি, সব প্রতিবন্ধকতা উতরে অদূর ভবিষ্যতেই তা করব বলে আশা করছি। সদস্য লাভের ব্যাপারে চীনকে ‘এপ্রোচ’ করার পরামর্শ তিনি দিলেন। পাকিস্তান ডেলিগেশনে আমার একজন প্রাক্তন সিএসপি সহকর্মীর সহযোগিতায় চীনা ডেলিগেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছুটা নাটকীয়ভাবেই সকলের সহযোগিতায় জাতিসংঘের সদস্য হবার আগেই সর্বপ্রথমে ইউএন সংস্থা ‘আঙ্গটাড’-এর সদস্য পদলাভ করলাম, যা আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে সম্প্রসারণের চেষ্টাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেল (বিস্তারিত বিবরণ অ্যাডর্ন পাবলিকেশন প্রকাশিত আমার বই ‘ধায় গাড়ী ধূম ছাড়ি’র ‘চিলি তীর্থে’ দ্রষ্টব্য) বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, একাগ্রতা এবং আন্তর্জাতিক সম্মানের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে অনেক উদাহরণের মধ্যে আরও দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। চীন যদিও তখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে এক ডেলিগেশনকে চীন প্রেরণ করেন। তার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা চীনে নিযুক্ত পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সার এই উদ্যোগে সম্ভব হয়েছিল। সে প্রতিনিধি দলে ছিলেন তিনজন বেসরকারি সদস্য (পাট ব্যবসায়ী মরহুম লুৎফুর রহমান এবং অবসরপ্রাপ্ত সিএসপি একেএম মুসাসহ আরেকজন) এবং একমাত্র সরকারি সদস্য রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রধান, আমি। আমার ওপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছিল চীনের বা চীনের কোনো সংস্থার (সবই সরকারি ছিল) সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির চুক্তি করা এবং তা সম্পাদনের পূর্ণক্ষমতা (Plenipotentiary)) রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আমাকে দেওয়া হয়েছিল। তখনও চীন বাংলাদেশকে সরকারি স্বীকৃতি দেয়নি। ঐ অবস্থায় এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সফর। কিন্তু দূরদর্শী বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ চিন্তাধারায় ভেবেছিলেন আমাদের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ যথাসাধ্য বাড়াতে হবে। যথাযথ আলোচনার পর ওদের দুটো কর্পোরেশনের সঙ্গে একটি রপ্তানি এবং একটি আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করি। ফিরে এলে এতে বঙ্গবন্ধু সপ্রশংস সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। নিজের দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে একক সিদ্ধান্তেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের স্বীকৃতির পর লাহোরে ও আইসি সম্মেলনে এবং ওআইসি-তে যোগদান করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিরাট সম্প্রসারণ সম্ভবপর করে তোলেন। পরে ইআরডি’র সচিব এবং তৎপরবর্তীতে জেদ্দাস্থ আইডিবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমি দেখেছি আইডিবি’র অর্থনৈতিক সহযোগিতা আমাদের উন্নয়ন কর্মকা-ের উল্লেখযোগ্য সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা সমস্যায় মিয়ানমারের আগ্রাসী আচরণ এবং গণহত্যার প্রতিবাদে ওআইসি সদস্য ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গাম্বিয়া ই আসে পুরোভাগে।
সদিচ্ছা থাকার জন্যই সম্ভব হয়েছিল ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সৌদি আরবে প্রথম বিদেশ সফরের সময় তাকে সর্বদলীয় নাগরিক সম্বর্ধনা প্রদান করা। তখন (সম্ভবত এখনও) সৌদি সরকার কোনো সফররত বিদেশি রাজনীতিবিদ, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে গণসম্বর্ধনা জানানোর অনুমোদন দিত না। কিন্তু শেখ হাসিনার ব্যাপারে এর সম্মানজনক ব্যতিক্রম ঘটেছিল। আইডিবি’র নির্বাহী বোর্ডের এবং সৌদি সরকারের অনুমোদনক্রমে আমি (তখন আইডিবি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট) ঐ সভার আহ্বায়ক এবং সভাপতি হই। কষ্টসাধ্য ঐ সভার আয়োজন ও অনুষ্ঠান করতে পেরে আমি কৃতার্থবোধ করি। মনে পড়ে, সর্বদলীয় ব্যতিক্রমী ঐ বিরাট সভায় প্রয়াত বঙ্গবন্ধু এবং সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয়। অনুষঙ্গীদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়াও ব্যবসায়ী শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে সর্বজনাব সালমান এফ রহমান, কাজী জাফরুল্লাহ প্রমুখ, অনেকেই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত বক্তব্য পরবর্তীতে সৌদি-বাংলা সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে বিশেষ সহায়ক হয়।
যে কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা এবং জাতির মঙ্গল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। অন্য কোনো বিবেচনা তাকে অন্যায় বা অসমীচীনভাবে প্রভাবিত করতে পারত না। একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তদানীন্তন ঢাকার একমাত্র পাঁচ-তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চুক্তির মেয়াদ-অন্তে চুক্তির নবায়ন কিংবা নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন হয়। এই হোটেলের মালিক ছিল পাকিস্তান সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএসএল)। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগের যুগ্ম সচিব হিসেবে আমি পিএসএল-এর ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের সদস্য ছিলাম। চেয়ারম্যান ছিলেন পিআইএ প্রধান। পিএসএল-এ পিআইএ-র শেয়ার ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। আর বাকি ছিল কয়েকজন ব্যক্তি বিশেষের, যার মধ্যে ছিলেন প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান (ফ্রান্স অথবা আমেরিকার নাগরিক, সম্ভবত ইউএনএইচসিআর-এর প্রধান ছিলেন) এবং ইউসুফ হারুন। স্যার আবদুল্লাহ হারুনের পুত্র ইউসুফ হারুন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বছর চারেক বড় হলেও দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। বঙ্গবন্ধু কিছুকাল হারুন-পরিবারের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে জনসংযোগ উপদেষ্টা (বস্তুত, শুধু কাগজে-কলমে) ছিলেন। ইউসুফ হারুন তরুণ বয়সেই স্বাধীনতা-পূর্ব ব্রিটিশকালে করাচির মেয়র ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সিন্ধু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নিজেও একজন সংবাদিক এবং করাচির ‘ডন’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পাকিস্তানের ডিক্টেটর-প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তীব্র মতপার্থক্যের জন্য অ্যারেস্ট এড়াতে তিনি নিউইয়র্ক চলে যান এবং আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে তার সহমর্মিতা ছিল।
স্বাধীনতার পর পিআইএ-র সকল শেয়ার বাংলাদেশ সরকারের হয়ে গেল এবং সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বোর্ডের চেয়ারম্যান হলাম সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। পিএসএল-র নাম পরিবর্তন করে হলো বিএসএল। বোর্ডে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের শেয়ার সংগত কারণেই সংরক্ষিত হলো। বোর্ডে আমরা স্থির করলাম নতুন করে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার আহ্বান করে কাদের হোটেলের ম্যানেজিং এজেন্সি বা পরিচালনা ভার দেওয়া যায়, তা নির্ণয় করব। সরকারের অনুমোদন নিয়ে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে) আমরা আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলাম। অনেক খ্যাতনামা হোটেল কোম্পানি তাতে অংশগ্রহণ করল। যেমনÑ শেরাটন, হিল্টন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ভারতের ওবেরয় গ্রুপ এবং আরও কয়েকটি। ওবেরয় গ্রুপের চেয়ারম্যান নিজেও উপস্থিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন, “তোমরা অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে সরকারের স্বার্থ এবং হোটেলের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো।” আমরা তাই করলাম। বোর্ডের সদস্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সহযোগিতায় আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে টেন্ডার যাচাই-বাছাই করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিলাম যে চলমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল গ্রুপই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হবে। তাদানীন্তন বাণিজ্যমন্ত্রী এমআর সিদ্দিকীর সমর্থন নিয়ে আমরা প্রস্তাবটি নিয়মমাফিক অর্থ এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ে তাদের মতামতের জন্য পাঠালাম। সচিব পর্যায়ে তাদের সমর্থন নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলো। ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়োজন হতে পারে বিধায় চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবের সঙ্গে আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ফাইলটি যেন মনোযোগ সহকারেই দেখলেন। ব্যক্তিগত শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। তবে ম্যানেজিং এজেন্সি প্রদানের ব্যাপারে মন্ত্রী-পর্যায়ে অর্থ এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন।
বাণিজ্যমন্ত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে আমি ফাইলসহ অর্থ এবং শিল্পমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করি এবং তাদের সম্মতিসূচক স্বাক্ষর গ্রহণ করি। তারপর আবার বঙ্গবন্ধু সমীপে প্রস্তাব সমন্বিত ফাইল দাখিল করলে তিনি সব দেখে-শুনে অনুমোদন প্রদান করেন। ঘটনাটির কিছু লম্বা বয়ান দিলাম এ-জন্য যে এ থেকে উপলব্ধি করা যায় বন্ধবন্ধু দেশের স্বার্থ সর্বোচ্চে রেখে পুরো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিকভাবে কী করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
প্রশাসনের এবং অর্থনীতির প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর তীক্ষè নজর ছিল। ১১ আগস্ট ১৯৭৫। আমি তখন রপ্তানি উন্নয়ন প্রধান। সংস্থাপন বিভাগ থেকে হঠাৎ ফোনে খবর পেলাম লন্ডনে ইকোনমিক মিনিস্টার হিসেবে আমার পদায়ন হয়েছে মহামান্য প্রেসিডেন্টের নির্দেশে। সংস্থাপন সচিব ছিলেন মাহবুবুর রহমান। তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি ফাইল দেখালেন। লন্ডনে ইকোনমিক মিনিস্টার পদায়নের প্রস্তাবের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট স্বহস্তে লিখেছেন (এই মর্মে) “ঐ পদে একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তার নিযুক্তি আবশ্যক। ইনাম আহমদ চৌধুরীকে নিযুক্ত করা হইল।” মনে পড়ে, কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং নির্দেশ নিতে তার সঙ্গে দেখা করি সচিব আবদুর রহিমের আয়োজনে ১৩ আগস্ট। ঐ সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে রপ্তানি বৃদ্ধি করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন এবং লন্ডনে অবস্থানরত শহিদ-জায়া বোন নাসিম হাইয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। পরের দিনই ইতিহাসের নৃশংসতম বর্বরোচিত হত্যাকা-ে আত্মবলিদান দিলেন জাতির পিতা। তার সঙ্গে শহিদ হলেন ঢাকাস্থ তার পরিবারের সব সদস্যও। রচিত হলো বাংলার ইতিহাসের কলঙ্কতম অধ্যায়।
নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। নিঃসন্দেহে তিনি বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র সার্বভৌম বাংলাদেশের স্রষ্টা, জাতির পিতা। কিন্তু এটা শুধু তার একটি পরিচয়। বৃহত্তর পৃথিবীর গ-িতে তার আরেকটি অত্যুজ্জ্বল পরিচয় রয়েছে। শেখ মুজিব মানুষের বন্ধু, সংগ্রামী মানুষের বন্ধু, শান্তিকামী মানুষের বন্ধু। বহুবার তিনি বলেছেন, শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, পরাক্রমশালীর আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে তার আজীবনের সংগ্রাম। সেখানে মানুষ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করছে, যেখানে মানুষ আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদ, বঞ্চনা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, সেখানেই আমরা দেখি নিঃস্বার্থ প্রতিবাদী লড়াকু শেখ মুজিবকে। জীবনের প্রারম্ভে, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনকালেই তিনি জীবনে সর্বপ্রথম কারারুদ্ধ হন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (পৃ. ১২) আমরা দেখি কী করে হিন্দু মহাসভার স্থানীয় সভাপতি সুরেন ব্যানার্জি, রমাপদ দত্ত এবং ওদের সহযোগী কতিপয় হিন্দু সরকারি কর্মচারী ষড়যন্ত্র করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টার বানোয়াট অভিযোগ এনে তাকে জেল বন্দি করেন। পরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে মামলার নিষ্পত্তি হয়। আত্মজীবনীতে আছে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বিমাতাসুলভ আচরণ ছাড়াও (পৃ. ২৩)। “হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও মুসলমানেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।” কিন্তু এসব সত্ত্বেও প্রতিবাদী তরুণ শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন সর্বতোভাবে অসাম্প্রদায়িক। বস্ততপক্ষে, সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, দ্বেষ, অবিচার, অন্যায়, শোষণ, মানবাধিকার হরনÑ এসবের বিরুদ্ধেই তো ছিল তার আপসহীন আজীবন সংগ্রাম। আমৃত্যু। কোনো প্রলোভন, অত্যাচার বা ভীতি প্রদর্শন তাকে কখনও লক্ষ্যচ্যুত করতে বা তার আদর্শের স্খলন ঘটাতে পারেনি। আমাদের সৌভাগ্য যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কিছু অনিশ্চিতকালের পরে তারই যোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা তারই নির্দেশিত পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
২৩ মে ১৯৭৪। বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়েছিল জুলিও কুরি শান্তি পদক। বলা হয়েছিল “বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ শুধু বাঙালির বন্ধু নন। বঙ্গবন্ধু সংগ্রামী মানুষের বন্ধু, শান্তিকামী মানুষের বন্ধু” (সভাপতির ভাষণের ফটোকপি সংযোজিত-২)। বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও ঔপনিবেশিক শোষকের ঘৃণ্য বেড়াজাল এবং পরাক্রমীর সর্বগ্রাসী নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে সাম্য ও সুবিচারের ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর সংগ্রামী দেশ ও মানুষকে একতাবদ্ধ হয়ে শান্তি ও প্রগতির পথে অগ্রসরমান হতে। বাস্তবিকই যতদিন পৃথিবীতে দরিদ্র, নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের, জনগোষ্ঠীর, জাতির মধ্যে মুক্তির আকাক্সক্ষা থাকবে, ততদিন অনুপ্রেরণা হয়ে, আলোকবর্তিকা হয়ে শেখ মুজিব পথ দেখাবেন। বিশ্ববাসীর হৃদয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত থাকবেন অভ্রভেদী গিরিরাজ হিমালয়ের মতো। শেখ মুজিবের মধ্যে ফিদেল কাস্ত্রো এই হিমালয়কেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
লেখক : সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক সচিব