আজ পৃথিবীর যে গভীর, গভীরতম অসুস্থ তার জন্য মানুষের কার্যকলাপই দায়ী। বুদ্ধিমান বলেই মানুষের মতো এমন নির্বোধ প্রাণী আর নেই। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের জন্যে সে হয়ে উঠতে পারে এক বিপন্ন প্রজাতি।
সাইদ আহমেদ বাবু: বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় নির্বাহের চাপ ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে গত ৬ নভেম্বর জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে মিশরের শার্ম আল-শেখ-এ শুরু হয় কপ-২৭ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিসের সংক্ষিপ্ত রূপ কপ) বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালে কপের প্রথম সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিতে কপের জলবায়ু সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। সবশেষ গত বছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপের ২৬তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মোট ১৩ দিনব্যাপী সম্মেলনের এবারের আয়োজনে ১৯৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এ সম্মেলনে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার লোক অংশ নেন, যার মধ্যে ২৪ হাজার কূটনীতিক এবং ১৩ হাজার পর্যবেক্ষক। এ আলোচনা চলে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত।
মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শুকরির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এবারের জলবায়ু কপ-২৭ এর নেতাদের সঙ্গে সম্মেলনে যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র অ্যান্ডোরার প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের এস্ফট জ্যামোরা-সহ ১১০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
এখানে উল্লেখ্য, সম্মেলনটি জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি) চুক্তি গ্রহণের ৩০তম বছরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ডেলিভারি ফর পিপল ফর প্লানেট এবং মূল আলোচনার বিষয়বস্তু অভিযোজন, অর্থায়ন, টেকসই জ্বালানি, নেট জিরো, লস অ্যান্ড ড্যামেজ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা।
বিশ্বনেতারা কী চান তা বৈঠকের শিরোনামেই পরিষ্কার কায়রো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭ নেতাদের কাছে এক বড় চ্যালেঞ্জ। বছর ঘুরতে চলল, মন্দা কাটল না। এক বছর ধরে উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক নীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েও মন্দাবাজারের মুখ ঘোরানো সম্ভব হয়নি। আমাদের ভাঙাগড়ার দায়িত্ব যাদের, তারা কি আমাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন? এই যুক্তিতে গত ৫ নভেম্বর স্পেনের মাদ্রিদে বিখ্যাত প্রাডো মিউজিয়ামে স্পেনের বিখ্যাত শিল্পী ফ্রান্সেসকো ডি গোয়ার দুটি বিখ্যাত চিত্রকর্মের ফ্রেম দুটির দেয়ালে দুই তরুণ-তরুণী +১.৫ সেন্টিগ্রেড লিখে দেয়। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর +১.৫ সেন্টিগ্রেড বৈশ্বিক উষ্ণতা বন্ধ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রাডো মিউজিয়ামের নিরাপত্তাকর্মীরা আসার আগপর্যন্ত তারা ছবি দুটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারা চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘জলবায়ুর প্রতি অবহেলা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে।’ এই পরিবেশবাদী গোষ্ঠী কেবল উদ্ভিদভিত্তিক পণ্য ব্যবহার করে- এমন কৃষিকে সমর্থন করে জলবায়ু সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলে দাবি করে। পরে পুলিশ এ দুই পরিবেশবাদীকে গ্রেফতার করে। পৃথিবীর জলবায়ু রক্ষায় ইউরোপে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বজনবিদিত। পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে ইউরোপের অনেক দেশ পরিবেশ রক্ষায় নানা নীতি প্রণয়নে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতি বছরই নভেম্বর মাসে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তবে, উন্নত দেশগুলোর অল্প কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণের অঙ্গীকার ছাড়া সম্মেলনের শেষটা খুব একটা আশানুরূপ হয় না বলে মত পরিবেশবাদী ও সমাজকর্মীদের।
মিশরের শার্ম-আল শেখ চলা সম্মেলনে কপ-২৭-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জলবায়ু সংকট মানব নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। ঝুঁকি মোকাবিলায় সকলকে এগিয়ে আসার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু সংকট অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি। যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু পরিবর্তন রোধকল্পে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে।’
এ বিষয়ে বাইডেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে সবুজ অর্থনীতি চালু করতে ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো বিশ্বকে এই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো কপ-টুয়েন্টি সেভেন সম্মেলনে গত ২০ নভেম্বর এ বিষয়ে ঘোষণা আসে। মিশরের শার্ম -আল শেখে ঐতিহাসিক এ চুক্তির প্রতি সমর্থন জানান ২০০ দেশের প্রতিনিধি। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর আগে, ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত সম্মেলন চলার কথা থাকলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় সময় বাড়ানো হয়।
১৭ নভেম্বর সম্মেলনের একদম শেষ পর্যায়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য তহবিল গঠনে সম্মত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। এজন্য চীন, সৌদি আরব বা সিঙ্গাপুরের মতো সামর্থ্যবান দেশগুলোকে অতিরিক্ত অর্থ ছাড়ের আহ্বান জানায়। তবে জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী বৃহৎ অর্থনীতির অনেক দেশই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে থাকায় বড় অংকের এই অর্থ কোথা থেকে আসবে সে প্রশ্নে আটকে ছিল সম্মেলনের ভবিষ্যৎ।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের মূল পর্বের উদ্বোধনী বক্তব্যে বিশ্ব নরকের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। মিশরের সম্মেলনে অংশ নিয়ে এ সতর্কবার্তা দেন গুতেরেস।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতিকে গুরুত্বসহকারে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো থেকে সাড়ে ৩ কোটি পর্যন্ত মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটতে পারে। তা সত্ত্বেও ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম তার সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফাইন্যান্সিংয়ের দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এবারও ক্ষতিপূরণ আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি পাওয়ার দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।
এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জ্বালানি সংকট, নিরাপদ খাদ্য আর জলবায়ুজনিত ক্ষয়ক্ষতির অর্থ জোগান নিয়েও আলোচনা হয়। বরাবরের মতো এবারও জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর বিপুল ক্ষতি আর হুমকিতে থাকার বিষয়টি জোরালোভাবে সম্মেলনে উঠে এসেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তা দেওয়ার জন্য কপ-২৭ সম্মেলন থেকে একটি বিশেষ স্কিম বা তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ‘গ্লোবাল শিল্ড অ্যাগেইনস্ট ক্লাইমেট রিস্কস’ নামের এই তহবিলের আওতায় ২০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সরবরাহ করা হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলো জোট জি-৭-এর সদস্যসহ কয়েকটি দেশে এই উদ্যোগে অর্থ দেবে। এ বিষয়ে ঘানার অর্থমন্ত্রী কেন ওফোরি-আত্তা সম্মেলনে বলেন, এটা দীর্ঘ প্রতীক্ষিত একটি উদ্যোগ ছিল।
ধনী বিশ্বই জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তুলনায় খুবই কম মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করা দরিদ্র বিশ্ব অত্যধিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দরকার অর্থায়ন। সম্মেলনে উপস্থাপিত একটি নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হলে (জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে) ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে।
দরিদ্র দেশগুলোকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য ২০২০ থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে যত দীর্ঘ সময় ধরে ব্যর্থ হতে থাকবে, উন্নত দেশগুলোর ওপর উন্নয়নশীল বিশ্বের আস্থা তত কমতে থাকবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দেশের পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামোর শত শত কোটি টাকার ক্ষতি মেটাতে বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে পৃথকভাবে অর্থ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এমপি।
প্রসংগত, কার্বন নির্গমন ঘটিয়ে জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। এরপরই আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাম। বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তাদেরই এর দায় নিতে হবে। স্বভাবতই ধনী দেশগুলো এ দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অবশ্য দেরিতে হলেও সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে ইইউ। শেষ পর্যন্ত জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব দিতে সম্মত হয়েছে। ইইউর পক্ষে ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফ্রান্স টিমারম্যানস সম্মেলনে তহবিল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ধনী দেশগুলো বরাবরের মতোই এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
জলবায়ু সম্মেলনে এবারও ক্ষতিপূরণের ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রাপ্তিতে এখনও রয়েছে অনিশ্চয়তা। সম্মেলনের শেষ দিকে এসে শুধু জার্মান ও আয়ারল্যান্ড ২১০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ু সহিষ্ণু অর্থনীতির কথা বলা হলেও তা মানছে না সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, ব্রাজিল ও রাশিয়াসহ অনেক দেশ। এ অবস্থায় বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বাংলাদেশসহ ৫০ দেশ।
প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী, ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ নামের তহবিল থেকে বিশ্বজুড়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে টিকে থাকা দেশগুলো সহায়তা পাবে। দীর্ঘ সময় ধরে কার্বন নিঃসরণকারী ধনী দেশগুলো এ তহবিলে অর্থ দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির জন্য ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থ আদায়ে তিন দশক ধরে দাবি জানিয়ে আসছে দরিদ্র দেশগুলো। কালের আবর্তে গত দুটি শতাব্দী ধরেই পশ্চিমি দুনিয়ার কয়েকটি দেশ অস্ত্র ও অর্থবলে অতিশয় বলীয়ান। তাদের ভোগ-বিলাসিতাও মাত্রাহীন। দুর্বল দেশগুলোকে শোষণ করেই তাদের ঐশ্বর্য ও সম্পদ বৃদ্ধি পায়।
নভেম্বর মিশরের শার্ম-আল-শেখ শহরে হয়ে যাওয়া সিওপি ২৭ ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। ১৮৭০ থেকে ২০১৯ অবধি যত কার্বন বাতাসে মিশেছে, তার ৬১ শতাংশ এসেছে পৃথিবীর ৬টি উন্নত দেশ আমেরিকা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জাপান এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে। সব মিলিয়ে তারা পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশকে ধারণ করে আছে।
চীনসহ পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর ভোগবাদই এই সংকটের জন্ম দিয়েছে, এই সত্য মেনে নিয়ে ধনী দেশগুলো নিজেদের সংযত করবে, এমন প্রত্যাশা করতে ভয় করে। এই সংকট থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে সবাই নিজে থেকে সংযত হবে- এমন স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে বলে মনে হয় না। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে বসুন্ধরা সম্মেলনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছিলেন, আমেরিকানরা তাদের জীবনশৈলী বদলাবে না। প্রাকৃতিক সংকট রুখতে ধনী দেশগুলো নিজেদের সংযত রাখতে পারবে কী? এবার কী হয় সেটি দেখার জন্য আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ দূষণের এ সমস্যা কোনো বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ সমস্যা সারাবিশ্বের। কোথাও কোথাও অবশ্য কোনো স্থানীয় সমস্যাকে বড় করে সামনে টেনে আনা হচ্ছে, এর ফলে এই পরিবেশ সমস্যার আন্তর্জাতিকতা প্রশ্নটা ঘোলাটে হয়ে আসছে। বিশ্বের সমস্ত দেশকে তাই স্থানীয় সমস্যার সঙ্গে সমস্যার বিশ্বব্যাপকতাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে।
জুনে ১৯৭২ স্টকহোমে অনুষ্ঠিত ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট-এ দাবি করা হয়েছিল : “পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ পরিবেশ সংরক্ষণ এবং তার উন্নয়নের ব্যাপারে যাতে উদ্বুদ্ধ হয় তার চেষ্টা করা দরকার। দরকার উপযুক্ত পথনির্দেশ। এ কাজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েই করতে হবে।” ওই অধিবেশনে এটাও স্বীকৃত হয়, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের মূলে মানুষের ভূমিকা যে কত রকম হতে পারে তার মূল্যায়ন খুবই শক্ত কাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ এবং রাজনৈতিক নেতাদের মিলিত উদ্যোগে এই মূল্যায়নের কাজটি করা দরকার। মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন ধরনের কার্যক্রম তৈরি করা দরকার, যাতে পৃথিবীর পরিবেশ আবার ভারসাম্য ফিরে পায়। ভোগী রাষ্ট্রগুলোর চুক্তির শর্ত না মানার পিছনে যে কারণগুলো রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো- রাষ্ট্রনায়কদের জনগণের সমর্থন আদায় করে ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভ। এছাড়া কোভিড এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে ক্ষুধা ও অসাম্য এত প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাকে সামাল দিতে গিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি রাষ্ট্রনায়কদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে।
জলবায়ু-সংক্রান্ত সমস্যায় চূড়ান্তভাবে জর্জরিত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। তাই তরুণদের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর অপরিণামদর্শিতায় ক্ষীণ হয়ে আসা ওজোন স্তর এখন মানুষ তথা প্রাণিজগতের ভবিষ্যৎ-অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
আজ পৃথিবীর যে গভীর, গভীরতম অসুস্থ তার জন্য মানুষের কার্যকলাপই দায়ী। বুদ্ধিমান বলেই মানুষের মতো এমন নির্বোধ প্রাণী আর নেই। হয়তো ভবিষ্যতে মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের জন্যে সে হয়ে উঠতে পারে এক বিপন্ন প্রজাতি। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের সন্দেহ নেই। পারমাণবিক এবং বিষাক্ত রাসায়নিক অস্ত্রসম্ভার যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর জল, মাটি, বাতাস বিষিয়ে তুলছে তার বিরুদ্ধে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়নের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এ সম্পর্ক লাভের ইঙ্গিতই বহন করে। দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে লাভ আমাদেরই। কেননা বায়ুদূষণ যেন আধুনিক মানুষের দোরগোড়ায় নেকড়ে বাঘ হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একে যেমন করেই হোক খেদাতে হবে। এ পৃথিবীটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যোগ্য বাসভূমি হিসেবে রেখে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সকলকে।
লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ