যুদ্ধাপরাধী, খুনি ও জাতির পিতার খুনিদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি-জামাত বাংলাদেশের মাটিতে যেন আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে, মানুষের রক্ত চুষে খেতে না পারে- তার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
উত্তরণ প্রতিবেদন: চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুনি-যুদ্ধাপরাধীদের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জামাত, যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে আর ক্ষমতায় আসতে না পারে। এই বাংলার মাটিতে আবার যেন ওই যুদ্ধাপরাধী খুনির দল ক্ষমতায় এসে দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমরা দেব না। যুদ্ধাপরাধী, খুনি ও জাতির পিতার খুনিদের পৃষ্ঠপোষক বিএনপি-জামাত বাংলাদেশের মাটিতে যেন আবার ক্ষমতায় আসতে না পারে, মানুষের রক্ত চুষে খেতে না পারে- তার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
ভোট পাবে না বলে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চায় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ওরা (বিএনপি) জানে ইলেকশন হলে জনগণ তাদের ভোট দেবে না। তাই তারা ইলেকশন চায় না, তারা সরকার উৎখাত করে এমন কিছু আসুক যারা একেবারে নাগরদোলায় করে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে- এটাই তারা আশা করে। এটাই তাদের বাস্তবতা। তারা জনগণের তোয়াক্কা করে না। ওরা ভোটে যেতে চায় না। জিয়াউর রহমান যেমন জাতির পিতাকে হত্যা করে, সংবিধান লঙ্ঘন করে, সেনা আইন লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করেছিল, ওদের (বিএনপি) ধারণা ওইভাবেই তারা ক্ষমতায় যাবে। গণতান্ত্রিক ধারা তারা পছন্দ করে না।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী জনতার মহাসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতের মতো আগামী নির্বাচনেও নৌকায় ভোট দিয়ে দেশসেবার সুযোগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি চাইলে লাখ লাখ মানুষ দু-হাত তুলে, নৌকা মার্কার গগনবিদারী সেøাগান দিয়ে তাদের সম্মতির কথা জানান।
গত ৪ ডিসেম্বর বিকালে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে সৃষ্ট উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। বক্তব্যের আগে তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নে ২৯ প্রকল্প ও ৬টির ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। এর আগে সকাল থেকে মহানগরীসহ জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মীদের সমভিব্যহারে জনতার ঢল পলোগ্রাউন্ডমুখী হয়। ঢোল, তবলা ও বাদ্য বাজনা বাজিয়ে ব্যানার ফেস্টুন উড়িয়ে পলোগ্রাউন্ড লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় দুপুরের মধ্যেই। এরপর এর বিস্তৃতি হয় পলোগ্রাউন্ড চতুর্মুখী কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী সমাবেশস্থলে হাজির হলে বিপুল করতালির মাধ্যমে জনতা তাকে স্বাগত জানান। এর আগে জনসভাস্থলে পৌঁছার পর প্রধানমন্ত্রী বাইনোকুলারে বারবার জনসভায় জনস্রোতের চিত্র অবলোকন করেন। অবিভূত হয়ে যান উৎফুল্ল জনতার ঢল দেখে। স্মরণকালের বৃহত্তম এ জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতে চট্টগ্রামবাসীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘অনেরা ক্যান আছন, গম আছননি। তোঁয়ারারলাই আঁর পেট পুঁরে’ (আপনারা কেমন আছেন, ভালো আছেননি, আপনাদের জন্য আমার পেট পুরে)। এ সময় জনসমাগম থেকে বিপুল করতালির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাব দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম আমাদের সকল আন্দোলনের সূঁতিকাগার। দীর্ঘ সময় পর চট্টগ্রামে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। করোনাকালে আসতে পারিনি। বক্তব্যে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, চার জাতীয় নেতা, ৩০ লাখ শহিদানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করে বলেন, চট্টগ্রামের মরহুম জননেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী, এমএ আজিজ, এমএ হান্নান, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, মহিউদ্দিন চৌধুরী, এমএ ওহাব, মৌলভী সৈয়দসহ যাদের কাউকে আমি চাচা বলে ডাকতাম, আবার কাউকে ভাই বলে ডাকতাম। তারা আজ বেঁচে নেই। আমি তাদের সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এমপি, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এমপি, রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এমপি, মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এমপি, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমএ সালাম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এমপি, ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নদভী এমপি, চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এমপি, ফজলে করিম চৌধুরী এমপি, আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খানম, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, এমএ লতিফ এমপি, দিদারুল আলম চৌধুরী এমপি, নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাইনুল হাসান চৌধুরী প্রমুখ। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমানের যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশটি চলে।
তিন মেয়াদের শাসনামলে সারাদেশের উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি বিশেষভাবে চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পগুলোর নাম উল্লেখ করেন। তার বক্তব্যে উঠে আসে চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড, কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালসহ বড় বড় প্রকল্পগুলোর কথা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার-লেন হয়েছে। এটিকে ছয়-লেনে উন্নীত করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল হবে। এর সমীক্ষা কাজ আমরা শুরু করে দিয়েছি। সন্দ্বীপে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ সংকটের গুজবে কান না দেওয়ার কথা বলে তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমান বৈশি^ক অবস্থার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, লন্ডন শহর এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এ শীতে গরম পানি ও বিদ্যুতের অভাব দেখা দিয়েছে। আমাদের তেমন হবে না। তবে আপনাদের সকলকে সাশ্রয়ী হতে হবে। সঞ্চয় করতে হবে। কোনো জমি অনাবাদি ফেলে রাখা যাবে না। যদি সকলের সহযোগিতা পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশ কোনো সংকটে পড়বে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে তার জনসভায় নির্বিচারে গুলি চালানোর কথা উল্লেখ করে বলেন, সেদিন পুলিশ গুলি চালিয়ে ২২ জনকে হত্যা করেছিল। দলের নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেছিল। যে পুলিশ কর্মকর্তা রকিবুল হুদার নির্দেশে এই গুলি চালানো হয়েছিল, বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাকে প্রমোশন দিয়েছে। সে কর্মকর্তাকে পুলিশ প্রধানও করা হয়েছিল।
বিএনপিকে খুনির দল অভিহিত করে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর অনেক সদস্যকে হত্যা করেছিল। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ২০০১ সালে নির্বাচনের পর হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ নির্বিশেষে কেউ রেহাই পায়নি।
বিএনপি-জামাতের অগ্নিসন্ত্রাসের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির দুই গুণ- ভোট চুরি আর মানুষ খুন। তারা ইলেকশন চায় না। তারা অগ্নিসন্ত্রাস, বাসে আগুন ও রাস্তা কেটে মানুষ হত্যা করেছিল। যানবাহনের আগুনে মারা গিয়েছিল অন্তত ৪০০ মানুষ। তিনি বলেন, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপি সারাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস চালিয়েছিল। আগুনে পুড়ে শতশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এ সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল। পুড়েছে অনেক যানবাহন। আওয়ামী লীগ সরকার এসব ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আহতদের চিকিৎসা দিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহন মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এই অগ্নিসন্ত্রাসের জবাব একদিন খালেদা-তারেককে দিতে হবে। মানুষ এ হিসাব একদিন নেবে। বিএনপি ধ্বংস করে আর আমরা সৃষ্টি করি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জিয়াউর রহমান যখন মারা যান তখন আমরা টেলিভিশনের খবরে শুনেছিলাম- তিনি একটি ভাঙা সুটকেস ও ছেঁড়া গেঞ্জি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবন সৃষ্টি করে তারেক রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা কীভাবে করল? সেই ভাঙা সুটকেস কি জাদুর বাক্স হয়ে গিয়েছিল?
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতার শেষদিকে বলেন, আমরা বিজয়ী জাতি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ ধারণ করি। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। জয় বাংলা সেøাগান নিষিদ্ধ করা হয়। বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার ইনডেমনিটি দিয়ে রুদ্ধ করে রাখা হয়। অথচ, আল্লাহ্র রহমতে জাতির পিতার ভাষণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি বলেন, আজ বিজয়ের মাসে আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আবারও বিজয়ী করার আহ্বান জানান। এ সময় জনতা হাত তুলে তাকে সমর্থন জানান। এর আগে জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আগামী সংসদ নির্বাচনে পুনরায় নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান। সংবিধান সংশোধন দিবাস্বপ্ন, সেটি ভুলে যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূত মাথা থেকে নামান। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে।