স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চাষের জমি ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ার পরও প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু কৃষি গবেষণার মাধ্যমে। কৃষিজ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তিও বড় ভূমিকা রাখছে।
রাজিয়া সুলতানা: ১৯৭১ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তলাবিহীন ঝুড়ির অভিধা। খাওয়া নেই। থাকার জায়গা নেই। নেই অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাঁধে সারাদেশে মানুষের ভার। এমন বিষম ক্রান্তিকালে বিচক্ষণ নেতা প্রথমেই বেছে নিলেন কৃষিকে। ডাক দিলেন কৃষি বিপ্লবের। তাগিদ দিলেন উৎপাদন বাড়ানোর। শুধু তাগিদ নয়; সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদকে সাজালেন ঢেলে। সেখানেই যুক্ত হলো কৃষি গবেষকের দল। তাতেই সফল হলেন জাতির পিতা।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশে আবাদি জমির পরিমাপ রাতারাতি বাড়ানোর সুযোগ ছিল না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে; চলমান পদ্ধতিতে চাষ করে কৃষকরা উৎপাদন বাড়াতে পারছিলেন না। দূরদর্শী দেশনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমস্যা অনুধাবণ করতে পারলেন। সমস্যা সমাধানের জন্য কৃষিবিদদের দ্বারস্থ হলেন। তাদের দিলেন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার ওপর জোর দিতে বললেন। সাংগঠনিক ও প্রশাসনিকভাবে কৃষি গবেষণার জন্য ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)। এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করল। প্রতিষ্ঠার বছরই বঙ্গবন্ধুর মেধাদ্বীপ্ত উদ্যোগে গবেষকরা আবিষ্কার করলেন উচ্চ ফলনশীল জাত ধান। এই ধানের জাত দিয়ে সূচিত হলো বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিপ্লব। তারপর কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশের সবটাই ইতিহাস। আর পিছনে ফিরতে হয়নি। এ যাবত বারি প্রায় ২১১টি ফসলের ওপর গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ফলশ্রুতিতে বারি এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৬০২টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ৫৭৬টি ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সময়েই (২০০৯-২০২১) বারি বিভিন্ন ফসলের ৩০২টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ২৭০টি ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়াসহ মোট পাঁচ শতাধিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। ১৯৭১ সালে যেখানে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগানের জন্য বিদেশ হতে খাদ্য আমদানি করতে হতো; সেখানে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চাষের জমি ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ার পরও প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু কৃষি গবেষণার মাধ্যমে। কৃষিজ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তিও বড় ভূমিকা রাখছে। তবে এখানে সরকারের সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং পৃষ্ঠপোষকতা অনস্বীকার্য।
ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের অর্থনীতির বড় অংশই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জিডিপি’তে প্রায় ১৩.২৯ শতাংশ (২০২০-২১)। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অব্যাহতভাবে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি নিরাপত্তা ও অথনৈতিক উন্নয়নে জাতীয় চাহিদাকে সামনে রেখে কৃষি গবেষণার ওপর জোর দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কর্মপরিকল্পনা, সম্পাদন, সমন্বয়, নিরীক্ষণ ও মূল্যায়ন অত্যাবশ্যক। আর কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে কাজ করছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। তাদের গবেষণালব্ধ ফল প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের মাঝে জনপ্রিয় করার জন্য নিরন্তর কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের সাথে সাথে কৃষি গবেষণায় সাহায্য করছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ও চৌকস গবেষক দল।
বাংলাদেশসহ বিশে^র অনেক দেশেই ক্ষুধা নিবারণের প্রধান উৎস ধান। একমাত্র এন্টারটিকা ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই কম-বেশি ধান হয়। তবে পৃথিবীর ৯০ শতাংশের বেশি ধান উৎপন্ন হয় এশিয়ায়। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় প্রধান মেন্যু ধানজাত খাবার। মানুষের ক্ষুধা নিবারণ, পুষ্টি নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে এর বিকল্প নেই। বাংলাদেশে উৎপাদিত ফসলের প্রায় ৯৫ শতাংশই ধান। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ধান নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিকূল ও অনুকূল পরিবেশ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতিটি গবেষণা ফল হচ্ছে গড় ফলন বৃদ্ধি। সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে পুষ্টি উপাদান। উদ্ভাবিত হয়েছে রোগ ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী জাত। উন্নতি ঘটেছে প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আজ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। ধানে দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নেওয়ার পর কৃষিবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি এবার গমের দিকে, যা সত্তর দশকে ছিল একটি অপ্রচলিত ফসল। তবে কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ গম একটি হালকা সেচের ফসল। গমের জমিতে কীটপতঙ্গের আক্রমণ নেই বললেই চলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি কমে গেলে বোরো ধানের বিকল্প ফসল হবে গম। সবচেয়ে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ গম তাপ ও বায়োটিক রোগীর জন্য সংবেদনশীল। কৃষিবিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণায় তাপ, খরা, লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল ও রোগ প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। শুধু গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারিই গমের ৩৩টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। অন্যদিকে ভোক্তা সাধারণের খাদ্যাভাস পরিবর্তনের ফলে গমের চাহিদাও বেড়েছে অনেক গুণ। ফলে গম এখন একটি প্রচলিত ফসল হিসেবে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দানা-জাতীয় ফসল হলো ভুট্টা, যা বিশ্বব্যাপী মানব ও পশুর পুষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ভুট্টার ১৬টি হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলনশীল ১০০ শতাংশ জমিতে এখন ভুট্টার হাইব্রিড জাত উৎপাদিত হচ্ছে। এশিয়ার মধ্যে হেক্টরপ্রতি ভুট্টার ফলন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ, যা গবেষকদেরই অর্জন। গম এবং ভুট্টা বহুমুখী ফসল হওয়ায় সম্প্রতি এদের বারি থেকে আলাদা করা হয়েছে। গম এবং ভুট্টা নিয়ে গবেষণার জন্য বিডব্লিউএমআরআই-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অপ্রধান দানাদার ফসল যেমনÑ বার্লি, কাউন, সরগাম ইত্যাদির ওপর গবেষণা করে দেশের চরাঞ্চল, খরা ও লবণাক্ত এলাকায় চাষের জন্য উপযোগী জাতের উদ্ভাবন করেছে বারির গবেষকরা। ফলে চাষের আওতাধীন জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আজ দানাদার খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য গবেষণার হাত এড়ায়নি অর্থকরী ফাইবার ফসল পাট, ভোজ্যতেল ফসল, কন্দাল ফসল, চিনি ফসল, ডাল ফসল এবং মসলা জাতীয় ফসলও। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচনের পর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তোষা ও দেশীয় পাটের উচ্চ ফলনশীল ও ছত্রাক রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেছেন। পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি আয়ের ৪.২ শতাংশ আসছে পাট এবং পাটজাত পণ্য থেকে। তবে ভোজ্যতেলের অভ্যন্তরীণ বার্ষিক চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ তেলবীজ ফসল বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে তেলবীজ ফসলের উৎপাদন বাড়ানো ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে সফলতাও এসেছে। কন্দাল ফসলের ভোজ্য অংশগুলো পচনশীল। তাই বিজ্ঞানীরা এই ফসলের জাত উন্নয়নের পাশাপাশি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়েও গবেষণা করছে। বর্তমানে অনেক বেশি কন্দাল ফসল বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। চিনি ফসলের গড় ফলন ৪০ টন/হেক্টর, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই কম। সেইসঙ্গে প্রতিনিয়ত দেশে চিনির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে বসে নেই। প্রতিনিয়ত চিনি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, শস্য ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধী জাত উৎপাদনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রোটিনসমৃদ্ধ ফসল ডাল, যা প্রাণীজ প্রোটিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা যায়। ডাল অল্প চাষে বা প্রায় বিনা চাষেই আবাদ করা যায়। তথাপিও বাংলাদেশে ডালের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করেছেন কম উৎপাদনশীল জাত, রোগ ও কীটপতঙ্গের প্রতি সংবেদনশীল ও জলবায়ুর প্রভাব। এসব সমস্যা সামনে রেখে বিজ্ঞানীরা গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। আমাদের আর একটি অতি প্রয়োজনীয় ফসল মসলা ফসল। বিশ্বে প্রায় ১০৯টি মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদিত হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় মাত্র ৬টি। তাও আবার চাহিদার তুলনায় অনেক কম। প্রতি বছর মসলা ফসল আমদানি করতে হয়। সরকার ‘মসলা গবেষণা’ নামে আর একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে বিদেশ হতে আমাদের মসলা আমদানি করতে না হয়।
একটি দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে কৃষির প্রতিটি সেক্টরেই উপাদন বাড়াতে হবে। কৃষিবিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে বাদ পড়েনি উদ্যান ফসলও। যার মধ্যে রয়েছে ফল, শাকসবজি, শোভাবর্ধক ফুলেল ফসল ইত্যাদি। খাদ্যের মধ্যে একটি বিশাল জায়গা দখল করে আছে শাক-সবজি। যার মধ্যে রয়েছে ভিটামিন, মিনারেল ও আঁশ। রয়েছে নানা প্রকার খনিজ, যা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খুবই উপযোগী। খাদ্য-পুষ্টি বিজ্ঞান বলছে, একজন স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ২২০ গ্রাম শাক-সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু পাচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম (৪৪ গ্রাম)। কৃষিবিজ্ঞানীরা এবার উদ্ভাবন করেছে অফ সিজন প্রজাতির সবজি (আর্লি ও লেইট মৌসুম), যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ করছে। এর ফলে সবজির গড় ফলনও বেড়েছে। এখন লবণাক্ত জমি, পাহাড়ি এলাকা, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল, পানির ওপর, ছাদে, হাইড্রোফোনিক পদ্ধতিতেও শাক-সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে হেক্টরপ্রতি গড় ফলন বাড়ার সাথে সাথে মোট ফসলের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলকে বলা হয় সুষম খাদ্য। যার মধ্যে শরীরবৃত্তীয় সকল কাজের প্রয়োজনীয় উপাদান বিদ্যমান। আমাদের দেহে দৈনিক ৮৫ গ্রাম ফলের প্রয়োজন, পাচ্ছি ৬৫ গ্রাম। গবেষকগণ অধিক উৎপাদনশীল ফলের প্রজাতি, ফলের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ, অপ্রচলিত ফলকে প্রচলিত ফলে রূপান্তরসহ বিভিন্ন ধরনের গবেষণা পরিচালনা করে বিশ্বে ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বলা বাহুল্য ফল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম হলেও ফল উৎপাদনের হার বিবেচনায় শীর্ষে অবস্থান করছে।
কৃষির আর একটি বড় সেক্টর হলো পশু ও মৎস্য খাত। পশুপালনের মধ্যে রয়েছে গবাদি পশু ও পোল্ট্রি। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনে এ সেক্টরগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রাণীজ প্রোটিনের প্রায় ৩৬ শতাংশই আসে গবাদি পশু হতে। আর বাকি প্রোটিন আসে হাঁস, মুরগি ও মাছ হতে। বাংলাদেশ মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ আর দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। এ সেক্টর হতে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। শুধু মৎস্য সেক্টর থেকেই আসে ৪.০৪ শতাংশ। এই সাফল্য একদিনে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন গবেষণার ফলে সম্ভব হয়েছে। গবেষণার খাতগুলো ছিলÑ উৎপাদন বাড়ানো, মানসম্মত খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধান আর এগুলো থেকে আমরা যে পুষ্টি পাই, তা যেন নিরাপদ হয়। এসব পণ্যের বিপণন নিয়েও কাজ করছে গবেষক দল।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন উৎপাদন বাড়ানোর। আর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন মাটি, পানি ও জলবায়ুর। গবেষকরা এ বিষয়গুলো নিয়েও অবিরাম গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া শ্রমিক স্বল্পতা কৃষির আর একটি বড় সমস্যা। তাই তো কৃষিবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি। যাতে অল্প সময়ে কম শ্রমিক দিয়ে অধিক পরিমাণে কৃষিকাজ করা যায়। বাংলাদেশে এখন প্রায় ৯৫ শতাংশ জমিই চাষ করছে আধুনিক কৃষিজ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে।
একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে নিত্যনতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ওপর। আর সেই উদ্ভাবন নির্ভর করে গঠনমূলক ও বাস্তবধর্মী গবেষণার ওপর। এই গবেষণা কার্যক্রম কার্যকর এবং গতিশীল রাখতে বর্তমান সরকারপ্রধান বদ্ধপরিকর। কৃষিবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার বিজ্ঞানী বা গবেষকদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে গবেষণা প্রকল্পে নিশ্চিত করছে প্রয়োজনীয় অনুদান। কৃষি গবেষণায় শুধু কৃষি মন্ত্রণালয়ই নয়, যুক্ত হয়েছে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও। তারাও আর্থিক সহায়তা অনুদান নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে। দূরদর্শী সরকারপ্রধান কৃষিকে আমলে নেওয়ার পাশাপাশি কৃষি গবেষকদেরও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ফল আওয়ামী লীগ সরকার ঘরে তুলতে পেরেছে। বিশ্বজুড়ে যখন হেক্টরপ্রতি শস্যের গড় উৎপাদন ৩ টন, বাংলাদেশে তখন প্রায় সোয়া ৪ টন।
বাড়ছে জনসংখ্যা। কমছে চাষের জমি। পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। এ অবস্থায় জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বজায় রাখতে গবেষণার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। পাশাপাশি কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এখন সময়ের অন্যতম দাবি। আর গবেষণার মূলমন্ত্র ‘পানির মতো’ সহজ করে তুলে দিতে তৃণমূলের কৃষকদের হাতে, যা দেশের খাদ্যের প্রতিটি সেক্টরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সমৃদ্ধ করবে।
লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়