সম্পাদকের কথা : জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশ যখন ক্রান্তিলগ্নে তখন বিরোধী দলগুলো অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।’ প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চেহারাটা উন্মোচিত হয়েছে। বস্তুত, জাতীয় সংকট মোকাবিলায় ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার সকল রাজনৈতিক দলের কাছে যখন দেশবাসী সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছে, তখন এদেশে ঘটছে তার উল্টোটা।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝেই বলছি, ‘ক্রান্তিলগ্ন’ কেবল বাংলাদেশেই না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে সমগ্র বিশ্ব এরকম পরিস্থিতি আর কখনও মোকাবিলা করেনি। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক ছিল পুঁজিবাদী অর্থনীতির ‘মহামন্দা’র যুগ। সে-যুগের পরিণতিই ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। যে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল আড়াই কোটি মানুষ। আর যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারি এবং দারিদ্র্যের শিকার আরও কয়েক কোটি মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শুরু হয়েছে তেমনি এক বিশ্বজনীন সংকটের কূটাভাস নিয়ে। ‘কোভিড-১৯’ শব্দবন্ধটি ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে প্রকৃতির কাছে সমগ্র মানবজাতি কতটা অসহায়। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ ৬৭ হাজার, ভারতে ৫ লাখ ৩০ হাজার, যুক্তরাজ্যে ২ লাখ ৯ হাজার, ইটালি ১ লাখ ৭৯ হাজার, রাশিয়া ২ লাখ ৮২ হাজার এবং বাংলাদেশ ২৯ হাজার ৪২৪ জন এ পর্যন্ত কোভিডে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা একজন মানুষের জীবনকেও মহামূল্যবান মনে করি। তারপরও উপরের পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কত কম। কোভিডের ফলে গভীর সংকটের আবর্তে পড়েছে প্রতিটি দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও উৎপাদন ব্যবস্থা। এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা যখন উজ্জ্বলতর হচ্ছিল তখন শুরু হলো একুশ শতকের ‘মহামন্দা’। এই মহামন্দায় ঘৃতাহুতি দিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শক্তিধর ও উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো নিজ নিজ দেশের সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা না করে, রাশিয়াকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে গভীর থেকে গভীরতর করছে এই সংকটকে। সারাবিশ্বের সাধারণ মানুষ ষাটের দশকের ‘কিউবা সংকটের’ মতো দুই পরাশক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। দুনিয়াব্যাপী খাদ্যসহ পণ্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, শিল্প উৎপাদন ও বহির্বাণিজ্যে নতুন নতুন সংকটÑ সমগ্র মানবজাতিকে অভিনব অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। সংকটের গভীরতা সম্পর্কে দেশবাসীকে গতানুগতিক আপ্তবাক্য না বলে আগামী অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন, দেশবাসীকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করেছেন। দেশবাসীর কাছ থেকে কিছুই লুকাননি।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশে এই মূল্যস্ফীতির হার ৯.১০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির কথা গোপন না করে আমরা বলতে চাচ্ছিÑ উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব এবং আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক কোথায়?
প্রসঙ্গত প্রধানমন্ত্রী এ-কথাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, অন্যান্য অনেক শক্তিধর ও উন্নত দেশের তুলনায় সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থান। কতটা স্বস্তিদায়ক নিঃসন্দেহে আমরা বিশ্বমন্দার শিকার। আমাদেরও রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে যুক্তরাজ্যের বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রতিবেশী পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। উন্নত-সমৃদ্ধ দেশগুলোতে বাংলাদেশের তুলনায় দারিদ্র্যের, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী সংকটের কারণে আমাদের দেশবাসীর কষ্ট বেড়েছে, উন্নয়নের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। আমাদের শর্ত মেনে আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়েনি। বাংলাদেশ উন্নয়নের যে ‘রোল মডেল’ ছিল সংকট মোকাবিলায়ও সেই রোল মডেলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের শক্তির উৎস দূরদর্শী নেতৃত্ব, পরিকল্পনা এবং কোনো কিছু লুকোছাপা না করে দেশবাসীর প্রতি আস্থা রাখা।
পরিস্থিতির সম্ভাব্য গভীরতায় ঘাবড়ে না গিয়ে সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তার প্রশ্নোত্তরে সে-কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিরোধী দলের পানি ঘোলা করে মাছ শিকারের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গণমাধ্যমকেও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ঘটবে এক, আর সংবাদপত্রে লিখবে আরেকÑ এটা হতে পারে না, এ তো তথ্য সন্ত্রাস। ঐক্যের প্রশ্নে তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ঐক্যের পক্ষে, যে বা যারা আসবে তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করব।’
অতএব আমরা আশা করব, অতীতের হত্যা, ক্যু, সন্ত্রাসের ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলে বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে সাড়া দিয়ে ‘ক্রান্তিলগ্নে’ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করবে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্র বাদ দিয়ে সহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হবে। দেশবাসী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির যে-কোনো ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবে।