Wednesday, October 4, 2023
বাড়িদশম বর্ষ,সপ্তম সংখ্যা,জুন-২০২০কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উত্তরণ সমাজ বিবর্তন ও ২০২০-২১ জাতীয় বাজেট

কোভিড-১৯ মহামারি থেকে উত্তরণ সমাজ বিবর্তন ও ২০২০-২১ জাতীয় বাজেট

ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ: করোনাকালের আগে বাংলাদেশ দ্রুত আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি সাধন করছিল। বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়াই যথেষ্ট। জাতীয় উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয়, জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রভূত উন্নতি অর্জিত হয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ায় সফলতম দেশে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পরিম-লে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আমার বিশ্বাস, করোনাকাল অতিক্রম করে বাংলাদেশ অচিরে আবার সেই অবস্থানে ফিরে যাবে। অগ্রগামী দেশ হিসেবে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করবে। আবারও বিশ্বে নন্দিত হবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।
তাই অদূর ভবিষ্যতে ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রানে নবান্নে উৎসবে/সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়Ñ বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’ তবে এবার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয় তা হলোÑ দেশের সকল মানুষের ন্যায্য অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, সোনার বাংলা গড়ে তোলা। এটিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবি, সংবিধানে বিধৃত।
অগ্রগতির পথে ফিরে যেতে পারার প্রথম শর্ত হচ্ছে বাস্তবতা অর্থাৎ যে সমস্ত সংকট সৃষ্টি হয়েছে কোভিড-১৯-এর কারণে সেগুলো স্বীকার করে প্রকৃত অবস্থার যথাযথ মূল্যায়ন করে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। অবাস্তব উচ্চাকাক্সক্ষা নানা টানাপড়েন তৈরি করে এবং লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে আবির্ভূত হতে পারে।
করোনাকালে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে করোনা সংক্রমণে মৃত্যু ঘটছে ও স্বাস্থ্যসেবায় চাপ বাড়ছে। এই মহামারির প্রাদুর্ভাব হঠাৎই ঘটেছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল কোনো দেশই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে সব দেশকেই হিমশিম খেতে হয়েছে, হচ্ছে করোনার আক্রমণে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যাপক নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতায় ঘাটতি অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বিস্তর। বর্তমানে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই ঊর্ধ্বমুখী। এ পর্যন্ত দৈনিক ১৫-১৬ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। কাজেই প্রকৃত অবস্থা জানা যাচ্ছে নাÑ তার জন্য প্রয়োজন অনেক বেশি নমুনা পরীক্ষা। এই অনিশ্চয়তায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা কঠিন। তবে আশা করা হচ্ছে, মাস খানেকের মধ্যে করোনার অভিঘাত সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে নিম্নগামী হতে শুরু করবে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা এবং পরীক্ষার সংখ্যা দ্রুত বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, কেননা ইতোমধ্যে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে সংক্রমণ অনেক ব্যাপক হয়ে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আরও মনে রাখতে হবে, একবার নিয়ন্ত্রণে আনার পর আবারও এই মহামারির প্রকোপ ধেয়ে আসতে পারে।
অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে ৬৬ দিন অফিস-আদালত, দোকানপাট, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বন্ধ ও লকডাউন থাকার কারণে। বেকারত্ব ব্যাপকভাবে বেড়েছে, বিভিন্ন মূলায়নে দেখা যায় দারিদ্র্য ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ বা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। জীবিকা সংকটে পড়েছেন ৬ বা ৭ কোটি মানুষ। তাদের সরকারি ব্যবস্থায় খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এই মহৎ কাজে সরকারের সাথে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
কোভিড-১৯-এর ফলে যে সকল খাত নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : রপ্তানি, যা প্রধানত তৈরি পোশাক, আন্তর্জাতিক চাহিদা কমে যাওয়ায়; উন্নয়নে ব্যবহৃত আমদানি কমেছে; রেমিট্যান্সে অবনমন ঘটছে এবং এক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে উন্নতির সম্ভাবনা হতাশাব্যঞ্জক; কৃষিক্ষেত্রে ধান ও শাক-সবজির উৎপাদন ভালো হলেও হাঁস-মুরগি, মাছ ও প্রাণী সম্পদ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়েছে; গ্রামীণ ও শহুরে অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতের অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগ ও ব্যবসা খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে; এবং বিভিন্ন সেবা খাত হয়েছে সংকটাপন্ন, বিশেষ করে বিমান চলাচল, পর্যটন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও বিনোদন। সরকারের রাজস্ব আদায়ে এ-বছরই ঘাটতি হবে ১ লাখ কোটি টাকার মতো এবং আগামী বছর (২০২০-২১) এই সমস্যা আরও গভীর হতে পারে, বিশেষ করে যদি কোভিড-১৯ মহামারি অনেক দীর্ঘায়িত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অনেকখানি অর্জন করেছিল করোনা-পূর্বকালে। উল্লেখ্য, বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট মে মাসের (২০২০) ৩ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে, সরকারি ঋণ, সরকারি ও বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ, ঋণ গ্রহণের ব্যয় এবং বৈদিশিক দেনার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে স্থিতি বিবেচনায় নিলে ৬৬টি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান করোনাকালে নবম শক্তিশালী। এ পর্যন্ত ভালো খবর। তবে, এখানে কথা আছে। করোনাকাল বাংলাদেশে যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেশে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাদের চিহ্নিত করে জীবন বাঁচাতে; অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত অসংখ্য মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করতে; এবং অর্থনীতিকে চালু ও পুনরুজ্জীবিত করতে বর্ধিত সহায়তা ও প্রণোদনা দিতে সরকারি ব্যয় বাড়বে। সরকারি রাজস্ব কমে যাচ্ছে তাই সরকারি ঋণ বাড়বে (দেশি বিদেশি উভয়ই), রপ্তানিতে পতন এবং রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল সে-রকম বাড়বে না বা কমে যাবেÑ আমদানি কমে যাচ্ছ বলে বৈদেশিক মুদ্রার নীট স্থিতি স্বল্পমেয়াদে তেমন হয়তো কমবে না। যাই হোক, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এতদ্সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্যভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে দেশের অবস্থান দৃঢ় রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক লক্ষাধিক কোটি টাকার একটি ব্যাপকভিত্তিক সহায়তা ও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, প্রধানত বিগত ১৩ এপ্রিল (২০২০)। লক্ষ্য : জীবন রক্ষা এবং জীবিকার নিশ্চয়তাবিধান। স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে করোনা মহামারি নিরোধকল্পে; যে অসংখ্য মানুষের জীবিকা বিধ্বস্ত হয়েছে, তাদের জীবিকা নিশ্চিতকরণ; কৃষি (শস্য, মাছ, হাঁস-মুরগি, প্রাণী সম্পদ) এবং বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র শিল্প ও ব্যবসার জন্য সহজ শর্তে চলতি মূলধন ঋণ; কর্মসংস্থান সৃজন; এবং রপ্তানি শিল্পের জন্য প্রণোদনাসহ সহযোগিতা করার প্রয়োজন রয়েছে এমন প্রায় সব খাত এই প্যকেজের মধ্যে রয়েছে। এর মাধ্যমে করোনার অভিঘাত থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রয়োজন অনুসারে নতুন বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে এবং নিশ্চয়ই আরও হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নে গাফিলতি, শ্লথ গতি এবং দুর্নীতির কারণে সম্ভাব্য সুফলে ঘাটতি ঘটছে। দু-মাস হয়ে গেলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন এখনও শুরু করা হয়নি। অবশ্যই সময়মতো, কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের জন্য আগেই বাস্তবতার আলোকে ৩টি খাত চিহ্নিত করেন। এগুলো হলো : স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি ও কর্মসৃজন এবং কৃষি খাত। এর সঙ্গে শিক্ষা যোগ করলেই করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটের কাঠামোগত মূল দিক-নির্দেশনা সামনে চলে আসে।
যাই হোক, বাজেটের একটি দার্শনিক ভিত্তি থাকা বাঞ্ছনীয়। সহজ কথায় বলা যায়, বাংলাদেশের উন্নয়নের দার্শনিক ভিত্তি হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তার মানে, মানবকেন্দ্রিক বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই দর্শন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছাড়াও আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিধৃত আছে। করোনা আরও একবার জানান দিলÑ যিনি যেখানে থাকুন না কেন, যার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই হোক না কেন, কারও অনেক ক্ষমতা থাকুক বা কোনো ক্ষমতা না থাকুকÑ সব মানুষ সমান মানুষ হিসেবে, সবাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। এ-কথা ভুলে গিয়ে লোভ-লালসা দম্ভ ও বাহাদুরিকে পুঁজি করে বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাবানরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ, এমন কী অতি মানুষ মনে করে অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে থাকেন এবং নানাভাবে বঞ্চিত অগণিত মানুষের জন্য সমাজকে চরম অসহনীয় এবং অবমাননাকর করে তোলেন। এই সমাজ টেকসই নয়, হতে পারে না। তাই দিকে দিকে হানাহানি, কাড়াকাড়ি, যুদ্ধাস্ত্র প্রতিযোগিতা, প্রভাব বৃদ্ধি এবং সম্পদ বাড়াতে পরিবেশ ধ্বংসে লিপ্ততা বিশ্ব সমাজ এবং গোটা পৃথিবীকেই এক বিধ্বংসী হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করোনাভাইরাস উঁচু-নিচু সকলকেই অসহায়ত্তের এক সমতলে দাঁড় করিয়ে দিল। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবতার ছায়াতলে সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনে সকলের মনোনিবেশ করা উচিত। তবেই সমাজ সকলের জন্যই মঙ্গলজনক এবং টেকসই হবে।
এতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠন ও সকলের কল্যাণ সাধনের অঙ্গীকার নিয়ে। দেশের স্থপতির বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা-বক্তব্যে এই ধ্যান-ধারণার অনুরণন সুস্পষ্ট ও দৃঢ় ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরিদ্র-অন্তপ্রাণ। তিনি দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, করোনা-মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সামনে থেকে নেতৃত্বই শুধু দিচ্ছেন তা-ই নয়, নিজেও যুদ্ধ করছেন, নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। এসবই মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ একজন মানুষই করতে পারেন। তিনিই ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। দলটির ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এগিয়ে চলার পথে বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা এবং সমাধানের প্রস্তাব রাখা হয়।
বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারি যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে তা ব্যবহার করে অঙ্গীকারকৃত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে ব্যবস্থাবদল এখন সময়ের দাবি। ব্যবস্থাবদল প্রক্রিয়া শুরু করা যায় অতি দরিদ্র, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের অদরিদ্র জনগোষ্ঠীসমূহ ঘিরে। এসব মানুষ দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ। প্রচলিত অর্থাৎ নব্য উদারতাবাদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তারা নানাভাবে বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। এসব মানুষ দিনমজুর; গৃহহীন ভাসমান জনগোষ্ঠী; প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি ও কৃষি শ্রমিক (যারা শস্য, শাক-সবজি, ফল, মাছ, হাঁস-মুরগি উৎপাদন ও ব্যবসায় নিয়োজিত); গ্রামীণ ও শহুরে অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে অসংখ্য অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগে (শিল্প, ব্যবসা ও সেবা) নিয়োজিত এবং বেকার ও আধাবেকার, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কোটি সদস্য (নারী ও পুরুষ)। আরও যুক্ত হয়েছেন বিদেশ থেকে ফেরত আসা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত কয়েক লাখ অভিবাসী।
সরকারের সহায়তা ও প্রণোদনা ব্যবস্থায় এসব মানুষকে কোনো না কোনোভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জীবন ও জীবিকা রক্ষায় প্রয়োজনীয় শক্তি নিয়োগের পাশাপাশি উন্নয়ন ও সমাজ বিবর্তনে উপর্যুক্ত জনগোষ্ঠীসমূহকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হবে সোনার বাংলা গড়ার অভিযাত্রায়। এক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে এসব মানুষকে সক্ষম করে তোলা। এর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষা-ব্যবস্থা, শিক্ষা অবকাঠামো ও শিক্ষাদান সক্ষমতায় প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নতি সাধনে অগ্রাধিকারভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০১০ সালে প্রণীত একটি প্রগতিশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষানীতি রয়েছে। মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টি শিক্ষা-ব্যবস্থার একটি প্রধান লক্ষ্য, যা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সাধারণ মানুষের জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে। অর্থনীতি ও সমাজের চাহিদা অনুযায়ী যুগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে প্রণীত একটি দক্ষতা উন্নয়ন নীতি আছে। এটি বাস্তবায়নে তৎপরতা বাড়ানো জরুরি।
সোনার বাংলা গড়তে পুঁজি নয়, মানুষকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক বিকাশে মনোযোগ দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সকল সাধারণ মানুষের যাতে কর্মসংস্থান হয় সেই আঙ্গিকে উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ ও প্রণোদনা বিন্যাস করতে হবে। পরিবর্তিত এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে একের পর এক সোনার মানুষের কাফেলা, যারা অন্য সকলের সঙ্গে মিলে গড়ে তুলবে আধুনিক সোনার বাংলাÑ সাম্য চিত্ত বিত্ত সমভিব্যাহারে। আর এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রয়োজন যথাযথ ক্ষমতা ও জনবলে বলিয়ান স্থানীয় সরকার।
যেহেতু কোভিড-১৯ মহামারি ব্যবস্থাবদলের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং সোনার বাংলা গড়তে উপর্যুক্ত যেসব জনগোষ্ঠীকে উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত সহায়তা ও প্রণোদনা প্যাকেজে কম-বেশি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাই উল্লিখিত ব্যবস্থাবদলের কর্মসূচি সহজেই হাতে নেওয়া যায়।
এখন বাজেট ২০২০-২১-এর দিকে নজর দেওয়া যাক। বাজেট প্রতি বছরই তৈরি করা হয়। মূলত ধারাবাহিকতায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর কলেবর বেড়েছে কিন্তু বরাদ্দ বিন্যাসে তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না। কোনো খাতে কিছু বেশি কোনো খাতে কিছু কমÑ এই যা। এবার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ-সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোভিড-১৯ এর ছোবল থেকে জীবন বাঁচানো এবং এই মহামারির ফলে বিধ্বস্ত-জীবিকার কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় বিষয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণও অগ্রাধিকারের বিষয়। দুর্দশাগ্রস্ত অসংখ্য মানুষকে খাদ্য প্যাকেট হস্তান্তর বা নগদ অনুদানের মাধ্যমে দীর্ঘদিন সমর্থন দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাজেট ২০২০-২১-কে আখ্যায়িত করা হয়েছে অর্থনৈতিক উত্তরণের বাজেট ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা। স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, কৃষি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর সংগতভাবেই বাস্তবতার আলোকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে : করোনাকাল জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা এবং করোনা-উত্তরকালে পুনর্বাসন ও পুনর্জাগরণ।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে সংক্রমণ ও মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে। এছাড়া একবার নিয়ন্ত্রণে এলেও তা আবার ফিরে আসতে পারে, অনেক দেশে সে-রকম ঘটেছে, ঘটছে। তাই নমুনা পরীক্ষা, সংক্রমিতদের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করে পরীক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ এবং সক্ষমতা দ্রুত বাড়ানো জরুরি। কাজেই এই বরাদ্দ বাস্তবমুখী। তবে এই অর্থ দ্রুত যথাযথ কাজে লাগিয়ে লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার কোটি টাকার অধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ এবং বিগত বছরগুলোর মতোই। আশা করা হচ্ছিল, এই অঙ্ক আরও বেশি হবে এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করার প্রাথমিক কাজ শুরু করা হবে।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি শক্তিশালী করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এটা খুবই জরুরি ছিল। কোভিড-১৯ ভীতি ও লকডাউনের ফলে অর্থনীতি অচল হওয়ার ফলে উপরে উল্লিখিত যে অসংখ্য মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তাদের জীবিকা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে। কেননা যারা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। তদুপরি এই মহামারি যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে তত এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা সংকট অব্যাহত থাকছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকি, ঋণ ও অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পল্লি উন্নয়ন খাতেও নজর দেওয়া হয়েছে; কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ রাস্তাঘাট হাটবাজারসহ বিভিন্ন গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন। কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রস্তাবনা রয়েছে। বড় শিল্প ও ব্যবসার জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দে ও প্রণোদনায় ধারাবাহিকতার ছাপ রয়েছে। ২০২০-২১ বাজেটের আকারও বিগত বছরগুলোর মতো ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে এবং ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অঙ্কটি চলতি বছরের মূল প্রস্তাবনায় ছিল ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেটে ৫ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বিন্যাসে কিছু এদিক-ওদিক করার কথা বলাই যেতে পারে। তবে আসল কথা, বাজেটের সময়মতো কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, বিশেষ করে করোনায় বিধ্বস্ত সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেসব প্রস্তাবনা ও বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে। আর অবশ্যই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা এবং উচ্ছেদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করতে হবে।
তবু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ হলোÑ প্রস্তাবিত ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বিশাল রাজস্ব সংগ্রহে বড় রকমের ঘাটতির হাতছানি এবং বাস্তবায়নে দুর্বলতা। এই চ্যালেঞ্জ দুটি মোকাবেলার ক্ষেত্রে আগেভাগে সতর্কতার সঙ্গে সচেষ্ট থাকা জরুরি। তারপরও বড় প্রশ্ন থেকে যাবে।
শেষ করার আগে বলতে চাই, ব্যবস্থাবদলের যে ধারণার কথা বলা হয়েছে এই লেখায় এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু করার যে পারিপার্শ্বিকতা কোভিড-১৯ সৃষ্টি করেছে, সে-পথে হাঁটার সুযোগ সামনে থাকছে। তার জন্য অবশ্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন অনুকূল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের।

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য