Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderকোনো শিশুকে যেন জীবন দিতে না হয়

কোনো শিশুকে যেন জীবন দিতে না হয়

এই যে শিশু হত্যা, নারী হত্যা, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা- এই হত্যার বিচার না করার একটা আইন করে রাখা হয়। যে কেউ খুনিদের বিচার করতে পারবে না। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। অর্থাৎ আমি আমার মা-বাবা-ভাই যাদের হারিয়েছি তাদের বিচার চাইতে পারব না। মামলা করতে পারব না।

উত্তরণ প্রতিবেদন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ-অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আমরা স্বজনহারা বেদনার কান্না শুনতে চাই না। আমরা যুদ্ধ চাই না, কোনো সংঘাত চাই না। যুদ্ধ চাই না, ধ্বংস চাই না, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চাই না, আমরা শান্তিপূর্ণ বিশ্ব চাই, শান্তি চাই। আর শেখ রাসেলের মতো আর কোনো শিশুকে যেন জীবন দিতে না হয়। আমরা চাই প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, উন্নত হোক।
গত ১৮ অক্টোবর জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৯তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘শেখ রাসেল দিবস ২০২২’-এর উদ্বোধন এবং ‘শেখ রাসেল পদক ২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজের বাবা-মা, স্বজন হত্যার বিচার চাইতে না পারার বেদনার কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমরা কেউ বিচার চাইতে পারব না! এখানে আমার একটা প্রশ্ন- আজকে আন্তর্জাতিকভাবে কত কিছু হয় মানবাধিকারের কথা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ কত কিছু হয়।
কিন্তু কই তখন কেউ তো আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমার দল ও বাংলার জনগণ ছিল। কিন্তু যারা ঘাতকের সঙ্গে ছিল, ঘাতকদের সহযোগিতা করেছিল বা চক্রান্তের সঙ্গে ছিল বা ঘাতকদের পুরস্কৃত করেছে, বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে- এই অন্যায়-অবিচারগুলো তো নিজ চোখে দেখেছি। আজ মানবতার কথা, মানবাধিকারের কথা- এত গালভরা কথা শুনি কেন? আমার এই প্রশ্নের জবাব কী কেউ দিতে পারবে?
প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি সম্পাদিত ‘দুরন্ত প্রাণবন্ত শেখ রাসেল’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রের ট্রেলারও প্রদর্শিত হয়।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদের মহাসচিব কেএম শহীদুল্লাহ ও শিশু বক্তা আফসা জাফর সৃজিতা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিজয়ীদের মধ্যে ‘শেখ রাসেল পদক ২০২২’ বিতরণ করেন।
শেখ রাসেল দিবস ২০২২ উপলক্ষে দেশব্যাপী কুইজ, ক্রীড়া, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে শেখ রাসেলের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি এবং আইসিটি বিভাগ কর্তৃক নির্মিত শেখ রাসেল দিবস ২০২২ উপলক্ষে একটি থিম সং পরিবেশিত হয়। পরে শিশুদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে এইসব লোক যারা হত্যাকারী, হত্যাকারীদের মদদদাতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ব্যাপারে তখন কোনো কথা নেই। আমার অধিকার, আমার মানবাধিকার- আমার বাবা-মায়ের বিচার চাওয়ার অধিকার তো আমারই ছিল না। সেখান থেকে তো আমরা বঞ্চিত ছিলাম। যারা যে সকল বিচারক সেদিন বিব্রত হয়েছিলেন, তারা এখন অনেকেই বড় বড় দার্শনিক হয়ে গেছেন। আমি তো সবই দেখি কিন্তু কিছু বলি না।
বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, সত্যকে মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা এবং দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের বিচার হবার মাধ্যমে আজকে জাতি তার থেকে মুক্তি পেয়েছে। আর বারবার আঘাত আসার, হত্যা চেষ্টার পরও এই দিনটি দেখবেন বলেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন তাকে বাঁচিয়ে রাখেন। অনুষ্ঠানে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে রাসেলের জন্ম, দুরন্ত শৈশব এবং মৃত্যুকালীন ঘটনার মর্মন্তুদ স্মৃতি রোমন্থন করেন প্রধানমন্ত্রী।
আবেগজড়িত কণ্ঠে ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, এই যে শিশু হত্যা, নারী হত্যা, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা- এই হত্যার বিচার না করার একটা আইন করে রাখা হয়। যে কেউ খুনিদের বিচার করতে পারবে না। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। অর্থাৎ আমি আমার মা-বাবা-ভাই যাদের হারিয়েছি তাদের বিচার চাইতে পারব না। মামলা করতে পারব না। আমি আর রেহানা (শেখ রেহানা) বিদেশে ছিলাম, আমাদের দেশে আসতে দেয়নি, ছয়টা বছর রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পর দেশে ১৯টি ক্যু হয়েছে, আমাদের ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হাজারো অফিসার-সৈনিক হত্যা করা হয়েছে, স্বজনরা তাদের লাশও পায়নি, গুম করে ফেলা হয়েছে। আমাদের আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী এদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে, কারাভোগ করেছে, মৃত্যুবরণ করেছে। কাজেই আর আমরা এই স্বজনহারা বেদনা, কান্না শুনতে চাই না।
আমরা চাই প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, উন্নত হোক। আমরা ৫ হাজার কম্পিউটার ল্যাব এবং ৩০০টি স্কুল অব ফিউচার উদ্বোধন করলাম। এর আগে আরও ৮ হাজার করেছিলাম, প্রায় ১৩ হাজার ডিজিটাল ল্যাব করা হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, সারা বাংলাদেশে আমাদের ছেলে-মেয়েদের আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দেওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা এটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। শিশুদের যে মেধা সে মেধা বিকাশের যেন সুযোগ হয়, শিক্ষা-দীক্ষায় তারা উন্নত হবে, প্রগতির সঙ্গে এগিয়ে যাবে, প্রযুক্তি শিক্ষা নেবে, বিজ্ঞান শিক্ষা নেবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আজকের শিশুরাই হবে আগামী দিনের কর্ণধার। বাংলাদেশের সকল শিশুর মেধা বিকাশের সুযোগ হোক। আজকে রাসেল নেই, আমরা তো সবই হারিয়েছি; কিন্তু বাংলাদেশটা যেন সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
’৭৫-পরবর্তী রিফিউজি হিসেবে থাকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯১ সালে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হয় সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসি। কিন্তু দেশে ফিরে এসে আমি যখন মামলা করতে যাই বা তার আগেও চেষ্টা করেছি।
কিন্তু সেই মামলা করা যায়নি কারণ আইনে বাধা। আমার প্রশ্ন আজকে তো অনেক মানবাধিকারের কথা বলা হয়। কারও অস্বাভাবিক মৃত্যুতে বিচার চাওয়া হয়, তাহলে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যারা আপনজন হারিয়েছি তারা কী অপরাধ করেছিলাম? কেউ বাবা-মা হারিয়েছে, সন্তান হারিয়েছে, ভাই হারিয়েছে, বোন হারিয়েছে তাদের অপরাধটা কোথায় ছিল?
বঙ্গবন্ধু-কন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পেরেছি তখনই, যখন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমি সরকার গঠন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছি তখনই।
সেই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে সেই বিচার করতে হয়েছে। যে বাতিলের পথেও অনেক বাধা ছিল। তিনি বলেন, আমরা জানি এবং শুনি ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ ঠিক সেটাই হয়েছিল আমাদের বেলায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার দুদিনের মাথায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই আবার নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। আর এই খুনিদেরকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স করে বিচারের হাত থেকে মুক্তি দিয়ে যায়। তাদের মুখেই আজকে গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়, ভোটের কথা, মানবাধিকারের কথা শুনতে হয়।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য