Wednesday, October 4, 2023

কৃষিই দেখাচ্ছে আশা

রাজিয়া সুলতানা: প্রকৃতির অপার সুন্দর একটি দেশ বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজের সমারোহ। নদীবিধৌত, ষড়ঋতুর নৈসর্গিকতা ছুঁয়ে যায় এ দেশকে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। গোয়াল ভরা গরু। গোলা ভরা ধান। আরও কত কী! কিন্তু যে ফুল যত সুন্দর তার কাঁটাও একটু বেশি। তাই তো এত নয়নাভিরাম দেশে বারবার হানা দেয় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন, পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এবার বাড়তি সংযোজন স্বাস্থ্য খাতের ওপর হামলা কোভিড-১৯ খ্যাত করোনাভাইরাস। প্রতিকূলতা আছে থাকবে। সমাধান তো করতেই হবে। সমাধানের পথে পিছপা হননি প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা। সব পরিস্থিতিতে সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার প্রয়াস নিয়েছেন। উদ্যোগ নিয়েছেন প্রণোদনার, করেছেন পুনর্বাসন, দিয়েছেন স্বল্প সুদে ঋণ। এই ধারা আরও শানিত করে প্রতি বছরের বাজেট। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। করোনাকালীন সময়ে একমাত্র অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে কৃষি। তাই তো আমাদের কৃষিবান্ধব সরকার কৃষিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অর্থাৎ বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে কৃষি খাতকে। তবে এবারের বাজেটের সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি হবে আরও শক্তিশালী। সারাবিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ এলাকায় বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের কিছু অংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় প্রায় ২৩০টি নদী। মূলত এজন্যই অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ একটু বেশি। বাংলাদেশে সাধারণত তিন ধরনের বন্যা সংঘটিত হয়। মৌসুমি বন্যা, আকস্মিক বন্যা, জোয়ার-সৃষ্ট বন্যা। মৌসুমি বন্যা (জুন থেকে সেপ্টেম্বর), আকস্মিক বন্যা সাধারণত এপ্রিল বা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় সৃষ্ট হয় আকস্মিক বন্যা। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক আকস্মিক বন্যা। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা (১৮ শতাংশ) বন্যায় প্লাবিত হয়। অতীতে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশে বন্যা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তবে স্মরণকালের বন্যা ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালের। অর্থাৎ দেখা যায়, প্রতি ১০ বছর পর বাংলাদেশে একটি বড় বন্যা হয়। করোনাকালীন সংকটকালেও রেহাই পায়নি বাংলাদেশÑ বন্যা, আম্পানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে। এবারের বন্যা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। একদিকে করোনা মোকাবিলায় ঘরে থাকার প্রজ্ঞাপন, অন্যদিকে গরু-বাছুরসহ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া। অর্থাৎ মানা যাচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। তবে সব দিক বিবেচনায় রেখে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ খ্যাত কৃষিরতœ শেখ হাসিনা।
চলছে মৌসুমি বন্যা। ইতোমধ্যে দেশের ১৩ জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলোÑ সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরগুনা, পিরোজপুর, মাদারীপুর। বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি বন্যা ও জলাবদ্ধগ্রস্ত। করোনাকালীন দুর্যোগে অর্থনীতির প্রায় সব সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়েছে। বেঁচে ছিল অর্থনীতির একমাত্র চালিকাশক্তি কৃষি। এই কৃষিকে বেগমান করতে তাই তো প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে এক ইঞ্চি চাষের জমি ফাঁকা না থাকে। তাই তো সরকার এগিয়ে এসেছেন কৃষি প্রণোদনা, স্বল্প সুদে ঋণ ও কৃষিবান্ধব বাজেট নিয়ে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে খাদ্য ও কৃষিতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এছাড়া করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রণোদনা সুবিধার আওতায় ৪ শতাংশ রেয়াদি সুদে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কৃষি ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। এই ঋণ জামানত ছাড়া কৃষিকাজে সরাসরি নিয়োজিত প্রকৃত কৃষক, ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, বর্গাচাষিসহ অন্যদের ফসল বন্ধকীকরণ চুক্তির মাধ্যমে প্রদান করা হবে। এছাড়া ফুল, ফল, মৎস্য চাষ ও পোলট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা বিশেষ প্রণোদনা স্কিম গঠন করা হয়েছে। ফলে কৃষি খাতে মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণপ্রবাহ সৃষ্টি হবে। এই ঋণের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে করোনা, আম্পান ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের কৃষি খাত।
জাতিসংঘ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় আকারের দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। গুণীজনদের মতে, করোনা-পরবর্তী সময়ে কৃষিই হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু অকস্মাৎ বন্যা। তাই বন্যা ও করোনা-পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। নদী ভাঙন এলাকায় দিয়েছেন ১০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ। কৃষি খাতে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা, কৃষি সেচে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর ২০ শতাংশ রেয়াত এবং কৃষকদের সর্বনিম্ন সুদে ঋণ প্রদান করা হবে। কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য প্রণোদনা দেওয়া হবে ৩ হাজার কোটি টাকা। এতে এবার কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমবে। উল্লেখ্য, সব কৃষিযন্ত্র কেনার ওপর হাওরাঞ্চলের কৃষকের জন্য ৭০ শতাংশ ভর্তুকি আগে থেকেই ছিল। অন্য এলাকার জন্য ছিল ৫০ শতাংশ। ঘোষিত বাজেটে কৃষি ও এর উপখাতে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা পাওয়া যায়। যেমনÑ গুঁড়া দুধ আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে, এতে সাধারণ খামারি পর্যায়ে তরল দুধের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির শুল্ককর বাড়ানো হয়েছে, ফলে দেশীয় চিনির দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে আখচাষিরা উপকৃত হবেন। প্রাকৃতিক মধুর আমদানি শুল্ক ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয়েছে। এতে দেশে উৎপাদিত মধুর দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সানফ্লাওয়ার ও সরিষার তেল আমদানিতে মূসক বাড়ানো হয়েছে, এতে সরিষা চাষিরা লাভবান হবেন।
তাছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ধরা হয়েছে। এর মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে কৃষি খাতে ৭ হাজার ৬১৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিশীলতা আনা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে পল্লি উন্নয়ন ও পল্লি প্রতিষ্ঠান খাতে ১৫ হাজার ১৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, নদী ভাঙন রোধ ও নদীর ব্যবস্থাপনার জন্য পানিসম্পদ খাতে ৫ হাজার ৬৫২ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নসহ দক্ষতা বৃদ্ধিতে গতিশীলতা আনয়নের জন্য জনপ্রশাসন খাতে ৫ হাজার ২৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ।
সরকার জনগণ তথা কৃষকদের দক্ষ করে তোলার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে জনগণসহ প্রান্তিক কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করছেন ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য। প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোÑ ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষিতে অভিযোজন, পরিবেশবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি, ফসলের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও মার্কেট লিংকেজ, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, উত্তম কৃষি পদ্ধতি, ফল বাগান পরিচর্যা, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় জৈব সার (খামারজাত সার, কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাইকো কম্পোস্ট ও কুইক কম্পোস্ট) উৎপাদন, খামার যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, সৌরশক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে সেচ পাম্প পরিচালনা, ই-কৃষি ও কৃষি-সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার, ছাদ বাগান ইত্যাদি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায়, দুস্থ ও গরিব জনসাধারণের মধ্যে মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন নির্দেশিকার আলোকে দেশের জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে সকল জেলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দেশের ৬৮টি জেলাকে এ, বি, সি ও ডি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে দিচ্ছেন ত্রাণ (চাল ও নগদ)। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য দিচ্ছেন শুকনা খাবার, শিশু খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী। শুধু জেলা প্রশাসক নন, সরাসরি কাজের তদারকি করছেন সচিবগণ নিজে। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে।
সরকার সবকিছু করে দেবে আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব, তা তো হবে না। বন্যার সময় উঁচু জমিতে, ভাসমান বা দাপোগ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। যাতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে জমিতে রোপণ করা যায়। বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের শস্য বপন করা উচিত। প্রয়োজনমতো সার, বালাইনাশক ও অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে হবে। বন্যার পর রবি ফসল ভালো হয়। কারণ বন্যার পানি পলির পরিমাণ বৃদ্ধি করে মাটিতে। পলিতে গাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যোপাদান থাকে। তাই বন্যার পর কৃষকদের রবিশস্যের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যেমনÑ বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয় সেসব জমিতে সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেমনÑ গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে হবে। তাহলে ফলনের পরিমাণ হবে আশানুরূপ। যদি সম্ভব হয় আমন ধান নষ্ট হয়েছে, চারার সংস্থান করা যাবে, তাহলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমনÑ বিইউ ধান-১, ব্রি ধান-৫৬, বিনা ধান-৭ এর চাষ করা উচিত। আবার কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য ভাসমান পদ্ধতি বা দাপোগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে কোনোভাবে যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে ওই বছর নতুনভাবে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্যও সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয়, তাহলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে দুটি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। যদি বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরও স্থায়ী হয়, তাহলে এসব জমিতে কোনোক্রমেই আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গরুর ঘাস হিসেবে মাসকলাই কিংবা পাতা জাতীয় স্বল্পমেয়াদি জাতের সবজি চাষ করা যেতে পারে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।
সাধারণত বন্যা হচ্ছে বেশি চর এলাকায়। নজর দিতে হবে চর এলাকায়। চরই ‘কৃষির হিডেন ডায়মন্ড’। কারণ উঁচু ও ভালো কৃষি জমি প্রতি বছর কমে যাচ্ছে প্রায় ০.৭০ শতাংশ হারে। বন্যা, চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়া, বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, করোনা-পরবর্তী খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় জুতসই প্রযুক্তি হতে পারে ভাসমান চাষাবাদ বা হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে মাটির প্রয়োজন নেই। এমন কী সার, বালাইনাশক, কোনো প্রকার হরমোনও ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এই প্রক্রিয়ায় পাওয়া যায় সতেজ অর্গানিক শস্য। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় হাইড্রোপনিক একটি যুগোপযোগী উৎপাদন ব্যবস্থা। যার দ্বারা সহজে সতেজ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায়। তাছাড়া অন্য সময় এই পদ্ধতিতে খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি ও উন্মুক্ত জলাশয় মৎস্য চাষের পাশাপাশি শস্য চাষ করা সম্ভব। বছরজুড়ে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য ভাসমান চাষাবাদ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার টেকসই বিকল্পও হতে পারে। করোনাকালীন সময়ের সেøাগান থাকবে না কোনো পতিত জমি, ফাঁকা থাকবে না এক ইঞ্চি চাষের জমি, করোনা মোকাবিলায় একমাত্র কৃষিই ত্রাণকর্তা সব বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারে হাইড্রোফোনিক (ভাসমান পদ্ধতি) পদ্ধতির চাষাবাদ।
হাইড্রোফোনিক বা ভাসমান পদ্ধতি ব্যবহার করে অত্যন্ত স্বার্থকভাবে লাউ, কুমড়া, করলা, ঝিঙে, শিম, বরবটি, পেঁপে, বেগুন, বাঁধাকপি, টমেটো ও শসা উৎপাদন করা যায়। আবার কখনও কখনও কৃষকরা পুরনো ধাপ কিনে এর ওপর কুমড়া, শিম, পেঁপে, করলা, টমেটো, লাউ, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বা সাদাশাকের চাষ করে থাকে। ইতোমধ্যে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ প্রক্রিয়া বরিশাল বিভাগ থেকে সিলেট, যশোর, মানিকগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
শহরাঞ্চলেও মাটিবিহীন চাষাবাদ করা যায়। মাটির পরিবর্তে পানিতেই অবলীলায় জন্মানো যায় টমেটো, লেটুস, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রুকলি, শসা, ক্ষীরা, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা ফুল, বেগুন, বামন শিম, তরমুজ এবং ঘাস জাতীয় ফসল ইত্যাদি। এই পদ্ধতিতে সারাবছরই বাড়ির ছাদে, আঙিনায়, বারান্দা, খোলা জায়গায় পলি টানেল, টব, বালতি, জগ, বোতল, পাতিল, প্লাস্টিকের ট্রে, নেট হাউসে অনায়াসে সবজি, ফল ও ফুল উৎপাদন করা যায়।
করোনা বা বন্যা যা-ই হোক না কেন, এর পরবর্তী সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের বিশাল জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই এখনই সময় বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং খাদ্য উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। কৃষি খাতকে ঢেলে সাজানো। সর্বোপরি জনগণের উচিত সরকারের সকল কার্যক্রমকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা।
আসল কথা হলোÑ বর্তমানে জিডিপি’র ১৪ শতাংশই আসে কৃষি থেকে। জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বৈদেশিক রপ্তানি বাণিজ্যেও কৃষি খাতের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। করোনা, আম্পান, বন্যা ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি। তাই জাতীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি তথা অব্যাহত রাখার স্বার্থে বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। শস্যবীমা, পণ্যভিত্তিক উৎপাদন এলাকায় ওয়্যার হাউস ও হিমাগার, কৃষি পরিবহনের জন্য আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা, ট্রেনে ফ্রিজিং কম্পার্টমেন্ট যুক্ত, জৈব সারের নিবন্ধন সহজ করা, নতুন দরিদ্র কৃষক পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অনুদান প্রদান, নগর কৃষি, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সহায়তা করা, পারিবারিক কৃষির উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ, জৈব ও জৈব বালাইনাশকের ওপর ভর্তুকি প্রদান, কৃষি শ্রমিকদের পুনর্বাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টি আবশ্যক।
করোনাকাল একদিন থাকবে না। দেশ-সারাবিশ্ব আবার জেগে উঠবে আগের মতো। উন্নয়নে অগ্রগতির জোয়ার প্রবাহিত হবে। তবে গর্বের সাথে বলতে পারিÑ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের কৃষি খাতকে থামাতে পারেনি। দেশ আমাদের আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মজুদ রয়েছে পর্যাপ্ত খাদ্য। তাই তো কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর মতো বলতে ইচ্ছে করে-

“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।”

লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি
শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটি
raziasultana.sau52@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাকিবে গর্বিত বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাজয়ী মানুষের গল্প
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য