Sunday, September 24, 2023

কারিগর

মাহবুব রেজা:

এক
প্রথম দেখায় তার কাছে মনে হয়েছিল এ আর এমন কি! মাঝারি গড়নের, দেখতে মোটেও তেমন আহামরি গোছের নয়। এবড়ো থেবড়ো চেহারা। চোখে-মুখে নিদেনপক্ষে একটা এক্সপ্রেশন তো থাকে, সবার যে রকম থাকেÑ এর তাও নেই। গেসুর একবার মনে হলো, এফডিসির ভেতরে সকাল-বিকাল লাইন দিয়ে বসে থাকা পাঁচশ-এক হাজার টাকা দামের এক্সট্রারাও দেখতে-শুনতে এর চেয়ে এক গ্রেড ওপরে। গেসুর যে রকম পছন্দ করে এ তার ধারে-কাছেও না। গেসুর এই এক সমস্যা। সে সবাইকে মনে করে তার কাছের মানুষ। খালি কাছের মানুষ মনে করলে কোনো সমস্যা ছিল না, গেসু যে সবাইকে নিজের ঘরের বউ-বিবি-বান্ধবী মনে করে। আর এখানেই পেজগিটা লাগে। বন্ধুরা কতবার ওকে মানা করেছে এসব হাবিজাবি ভাবনা বাদ দিয়ে সোজা চিন্তা করতে, মেয়ে-মাইনসের কাছে যাইবি, মৌজ ফুর্তি করবি, হেরপর পাছার কাপড় মাথায় তুইলা বাড়িত ফিরবিÑ অগো লগে অত প্যাঁচাল পারনের দরকার কি? হউরের পো আমগো দেহো না?
গেসু বন্ধুদের কথা মাথায় তোলে না। সে ওদের মতো ‘কাটো গাছ খাও মাছ’ ফর্মুলায় নেই। গেসু নিজের তরিকামতো চলে।

গেসুর কিছু নখরা আছে। আকলিমা বেগমের বাড়ি গেলে তার মন বেশ ফুরফুরা থাকে। সাধারণত গেসু বাইরে থেকে নেশা-পানি করে মাতাল হয়ে আকলিমার বাড়িতে ঢোকে। তার আগে আকলিমাকে ফোন করে। খোঁজখবর নেয়। তার পূর্ব পরিচিত কেউ থাকলে সে খুশি হয়। নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলে ভাব জমাতে ইচ্ছে করে না তার। তার চেয়ে পুরনো মানুষই ভালো। পুরনো মানুষের ভেতর এক ধরনের মায়ার আঁধার জমা হয়ে থাকে। সে পায় কি না পায় তবু মায়ার আঁধার খোঁজে।
মাতাল হয়ে গেলে গেসু কবুতর হয়ে যায়, না হলে সে কেন জোড়ায় জোড়ায় কবুতর যে রকম করে বাকবাকুম-বাকবাকুম করতে থাকে। আকলিমার বাড়িতে গেলে গেসুর ইনিয়ে-বিনিয়ে রাজ্যের যত কথা বেরুতে থাকে। পরিচিত কাউকে পেলে তো কথাই নেই। কত যে কথা! কথা বলতে বলতে কখনও কখনও গেসু বাচ্চাকাচ্চাদের মতো কান্নাকাটিও করে। এসব দেখে অনেকেই অবাক হয় এই ভেবে, আজকালকার দিনে এ-রকম কাস্টমারও পাওন যায়! গেসুর পূর্ব পরিচিতরা ওর এইসব বিষয়-আশয়কে অবশ্য মেনে নিয়েছে। ঝামেলাটা হয় নতুন যারা এসেছে তাদের নিয়ে। এরা গেসুর এসব দেখে বিরক্ত যেমন হয় আবার অবাকও কম হয় না। তারা নিজেদের মধ্যে নিজেরাই হাসাহাসি করে, তাজ্জিব ব্যাপার! তাইলে তো বালাই কামের সময় রসিক নাগর কাম ফালায়া আমাগো লগে কইতরের লাহান বকবকম-বকবকম করে!
মেয়েদের সঙ্গে গেসুর এই রকম বকবকম-বকবকম করা স্বভাব আকলিমার একেবারেই পছন্দ নয়। গেসু কোনো ঘরে ঢুকলে অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলে। কাজের সময় অত সময় নষ্ট করলে ব্যবসার ক্ষতি। আকলিমা ভেতরে ভেতরে গেসুর ওপর বিরক্ত হলেও তাকে শক্ত কথা বলতে পারে না। গেসুর হাত অনেক বড়। থানা পুলিশ, এলাকার মাস্তান-বখাটেদের সঙ্গে গেসু বেশ মানিয়ে চলতে পারে। প্রয়োজনে মারামারি পর্যন্ত করতে পারে। থানায় গেসুর নামে মামলা আছে এন্তার। আকলিমা তাই গেসুকে খুব একটা ঘাটায় না, তবে আড়ে-ঠাড়ে কথা শোনায় ঠিকইÑ
‘তুমি খালি ঘরের মাইয়াগো লগে আজাইরা প্যাঁচাল পারো। এইসব বাদ দেও।’
‘ক্যা? প্যাঁচাল পাড়লে তোমার সমস্যা কী?’
‘না মাইয়ারা এইসব আজিরা প্যাঁচাল-উচাল পছন্দ করে না।’
‘ক্যালা? পছন্দ করে না ক্যালা?’
‘মাইয়ারা কয় কামের সময় অত বকবক করলে তো কামের সমসসা’Ñ আকলিমা ওর ময়দার বস্তার মতো দশাসই শরীরে চারদিকে কাঁপন জাগিয়ে হাসে,
‘কেন তুমি বুঝবার পারো না কি সমস্যা হয়?’
‘কোন বান্দির মাইয়া তুমারে এই ডায়লগ মারাইছে’Ñ বলে গেসু কয়েকটা বিশ্রী গালাগাল করে।
‘তুমি খেপো কিল্লাইগা?’
আকলিমার কথায় গেসুর মেজাজ আরেক প্রস্ত বিগড়ে যায়,
‘আমি মাইয়াগো লগে কথা কইলে কোন হালার হোগা জ্বলে? আমি গেসু কোনো হালার খাইও না, পরিও না। সব হালার পো চুতিয়ার চুতিয়া…

দুই
নসু আকলিমার ঘরে ঢুকলে ওর মধ্যে এক ধরনের ভর কাজ করে। প্রায় সময়ই সে মেয়েদের সঙ্গে যেচে পড়ে কথাবার্তা বলে। কোথায় থাকা হয়, নাম কী, সংসারে কে কে আছে, প্রেম করছে কি না, বিয়েশাদি করেছে কি না, করলেও ছেলেমেয়ে ক’জনÑ এ-ধরনের রাজ্যের হাবিজাবি মার্কা কথাবার্তা সে বলে। তাতে কেউ বিরক্ত হয়। কেউ অবাক হয়। কেউ আবার চোখ তুলে নসুকে ভালো করে পরখ করে, যেন সে দেখারই একখান জিনিস!
একদিন এক মেয়ে তো নসুর মুখের ওপর মুখ ঝামটা মেরে বলেই বসল, ‘আকামের সময় এত কথা কইলে কী হয়! আইছেন কাম করতে, কাম কইরা ফুইটা পড়েন। তোমার নাম কী, তোমার চুলগুলা সুন্দরÑ এইসব বক্কর-চক্কর আর খাউজাইন্না মার্কা কথা ভালোবাসার মাইনসের লগে মারায়েন’Ñ বলে মেয়েটা প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠল।
মেয়েটার কথায় গেসু ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল, তুমি এইরহম কইরা কথা কও কেন স্বাতি?
গেসুর কথায় স্বাতি নামের মেয়েটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হেসে উঠল আর মনে মনে বলল, ব্যাটা ছাগলের বাচ্চা ছাগল তুই কোন স্বাতির লগে কথা কইতাছছ।
স্বাতির হাসির আড়ালে আসমা, হনুফা, বিউটি কিংবা আরও অনেকের মুখে হাসিটা ঝুলে থাকে।
গেসু কয়েকদিন আকলিমা খাতুনের কাছে ফোনে ঘ্যান-ঘ্যান করে বেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল আকলিমার ভা-ারে এখন আর আগের মতো কারিগর নেই। থানা পুলিশ, মাস্তানদের চাঁদা, এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেপেলেদের নেশা-পানির আবদার মেটাতেই আকলিমার ব্যবসার লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার দশা। শেষবার নসু যখন আকলিমাকে ফোন দিয়ে কারিগরের খবরাখবর জানতে চেয়েছিল তখন আকলিমা ফ্যাস-ফ্যাসে, অনেকটা ভাঙা-ভাঙা গলায় তাকে বলেছিল,
‘ব্যবসা আর আগের মতন নাই। ভালো কারিগরের বহুত অভাব।’
আকলিমার কথা বুঝতে পারেনি নসু।
‘কারিগর দিয়া আমি কী করুম? আমার দরকারÑ’
আকলিমা নসুকে আর কথা বলতে দেয় না। মাঝপথে নসুর কথাকে আটকে দিয়ে আকলিমা বলল,
‘আমি কারিগর না পাইলে তুমি কার লগে কাম করবা? আমার লগে?’ বলে আকলিমা খিলখিল শব্দে হেসে ওঠে। আকলিমার হাসিতে কি আছে না আছে সে বুঝতে পারে না, তবে হাসিটা যে তার গায়ে এসে সুড়সুড়ি তোলে সেটা গেসু খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
‘তুমি বহুত হারামি আছোÑ’ বলে গেসু আকলিমার কথার জবাব দেয়।
‘হারামি না কোন হালায় হেইটা কওÑ’
‘তয় আকলিমা তুমি হইলা এক লম্বরের হারামিÑ’ গেসু কানে মোবাইল চেপে ধরে হাসতে থাকে। ওপাশে আকলিমার শরীর কাঁপিয়ে হাসিটা অব্যাহত থাকে।
আকলিমার কথায় কারিগর শব্দের অর্থ নসুর কাছে পরিষ্কার হয়।

তিন
দুপুরের দিকে গেসু কোট-কাচারির উল্টো দিকে যে গলিটা সোজা রোকনপুরের ভেতরে ঢুকে গেছে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বাচপান কি দোস লালচাঁনের সঙ্গে কথা বলছিল। বাপদাদার ব্যবসা দেখে সে, গোয়ালঘাট লেনে হার্ডওয়্যারের দোকান চালায় লালচাঁন। মাঝে মধ্যে সেও গেসুর সঙ্গে আকলিমার ঘরে যায়।
লালচাঁনই কথাটা পাড়ল,
‘ঐদিকের কোনো খবর বার্তা আছে রে গিয়াস?’
‘আকলিমা বেগমের বাড়িতে নতুন কোনো জিনিস উঠল?’ সবার সামনে লালচাঁন কি গেসুকে এসব কথা বলতে পারে! রাস্তাঘাটে মহল্লার পরিচিত মানুষজন, ময়-মুরুব্বিÑ সে-কারণে সামনের বছর হজে যাবার নিয়ত করা লালচাঁন তাই ছল করে একটু কৌশলের আশ্রয় নেয়।
লালচাঁনের কথায় গেসু আর হাসি ধরে রাখতে পারে না। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে লালচাঁনকে বলল,
‘কোন্ দিককার কথা কস তুই?’
‘ক্যা? তুমি বুঝো না আমি কোন্ দিকের কথা কই?’
গেসু আর কথা না বাড়িয়ে লালচাঁনকে বলল,
‘ওর স্টকে বলে কারিগর নাইক্কা।’
গেসুর মুখে এ-কথা শুনে তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া উঠতি বয়সী এক ছেলে গেসুর দিকে ফিরে ফিরে তাকাল। ছেলেটাকে চেনে না সে। ছেলেটা কি একটু হাসলও!
‘কারিগর নাইক্কা! এইটা কি হুনাইলি?’
‘হ, অয় নিজেই কইলোÑ’
‘ক্যা? অয় নিজেই তো বড় কারিগরÑ’
‘তাইলে তুই বুঝি অর কাছেই যাছ?’
‘গেসু তুই যে কি কছ?’
‘আমি যা কই ঠিকই কইÑ’
‘তুমি হালায় একটা চোদনা, তুমি কি ভুল কইবার পারোÑ’ বলে সিগারেটে টান দেবে এমন সময় তার মোবাইলে বেজে ওঠে হিন্দি গান ‘শুন রাহা হায় তু রো রাহি’। লালচাঁন শ্রদ্ধা কাপুরের অজ্ঞান ভক্ত। আকলিমার ওখানে গিয়েও না-কি লালচাঁন কারিগরদের মধ্যে শ্রদ্ধা কাপুরকে খুঁজে বেড়ায়। নাজিরাবাজারের ব্যবসায়ী জুম্মন মিয়ার একমাত্র মেয়ে সীমার সঙ্গে আট বছর প্রেম করে ভাগিয়ে বিয়ে করেছে।
গেসু রোকনপুর থেকে বেরিয়ে কোট-কাচারির মোড়ে এসে দিল্লি মুসলিম হোটেলে এক কাপ চা খেল। তারপর ফোন করল আকলিমাকে।
গেসুর ফোন পেয়ে আকলিমার গলায় ভারি উচ্ছ্বাস খেলে যায়,
‘তুমি কিমুন আছো? কতদিন পর তুমি ফোন করলা! আমি জানি তুমি আমার উপরে রাগ কইরা থাকবার পারো নাÑ’
রায়সাবাজারের মোড়ে তখন দুপুরের রোদেরা ঝিলমিল করে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রয়। গেসু বেশ ধন্ধের মধ্যেই পড়ে যায়, সে আসলে কাকে ফোন দিয়েছে?

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য