কান চলচ্চিত্র উৎসব, প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বেশ কয়েকবার এ উৎসবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা। এ বছর অংশগ্রহণের পরিধি বেড়েছে। এবারের উৎসবটি বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম। কারণ এই প্রথমবার বাংলাদেশের অফিসিয়াল স্টল রয়েছে এ উৎসবে।
ড. মাসুদ পথিক : চলচ্চিত্রের তীর্থভূমি, বিশ্ব চলচ্চিত্রের তীর্থভূমি বলা হয় কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে কানকেও সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ উৎসবের সম্মান দেওয়া হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে প্রতি বছর এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। ‘সিনেমার অলিম্পিক’ হিসেবে খ্যাত এ উৎসব প্রতি বছর মে মাসে সারাদুনিয়ার চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টি থাকে দক্ষিণ ফরাসির এই উপকূলে। যার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। বছর ঘুরে বাংলাদেশেও ভেসে আসে সেই হাওয়া।
বেশ কয়েকবার এ উৎসবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের সিনেমা। এ বছর অংশগ্রহণের পরিধি বেড়েছে। এবারের উৎসবটি বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম। কারণ এই প্রথমবার বাংলাদেশের অফিসিয়াল স্টল রয়েছে এ উৎসবে। কানের বাণিজ্যিক বিভাগ মার্শে দ্যু ফিল্মে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টল বসে। উৎসবটির বাণিজ্যিক বিভাগ মার্শে দ্যু ফিল্মে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরতে এ আয়োজন। ৭৬তম আয়োজনে এই বিভাগে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
চলতি বছরে কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৬তম আসরের সমাপনী অনুষ্ঠিত হয় গত ২৭ মে। এবারের আসরের সেরার পুরস্কার ‘পাম ডি’অর’ জিতে নিয়েছে জাস্টিন ট্রিয়েটের ছবি ‘এনাটমি অব এ ফল’ এবং গ্র্যান্ড প্রিক্স পেয়েছে জোনাথন গ্লেজারের ‘দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট’ ছবিটি। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের দেশ ফ্রান্সে আয়োজিত একটি চলচ্চিত্র উৎসব দক্ষিণ এশিয়ার ছোট একটি দেশ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন? সে-সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক কান সম্পর্কে দু-চার কথা।
কান চলচ্চিত্রের মূল উৎসব অনুষ্ঠিত হয় পালে দে ফেস্তিভাল্স এ দে কোঁগ্র নামক ভবনে। এ উৎসবের জন্য এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ভবনটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মিশেলে এক প্রসাদপ্রম। বার্ষিক এ অনুষ্ঠান আমন্ত্রণভিত্তিক। ডাক না পেলে সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে যেসব বিভাগ থাকে সেগুলোর মধ্যে পুরস্কার দেওয়া হয় দুটিতে। এর মধ্যে ‘কম্পিটিশন’ তথা মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে দেওয়া হয় সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন স্বীকৃতি পাম দ’র তথা স্বর্ণ পাম।
প্রথমত; প্রতিটি কর্মসূচি শুরুর পূর্বে উৎসবের পরিচালনা পর্ষদ জুরি নিয়োগ করে। তাদের দায়িত্ব হলো কোন চলচ্চিত্র কান পুরস্কার পাবে তা নির্ধারণ করা। আন্তর্জাতিক শিল্পীদের জুরি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের কাজ ও তাদের কাজের প্রতি অন্যদের শ্রদ্ধার ভিত্তিতে।
পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য একজন সভাপতিসহ বিভিন্ন চলচ্চিত্র ও শিল্পকলার ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গঠিত এই জুরি বোর্ড প্রতিযোগিতায় কে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার পাবে, তা নির্ধারণ করে। সিনেফনডেশন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের একজন সভাপতিসহ চারজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত এই জুরি বোর্ড একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পুরস্কার ও সিনেফনডেশনের জন্য ৩টি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্ধারণ করে।
উন সার্টেইন রিগার্ডের জন্য একজন সভাপতিসহ সাংবাদিক, চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত এই জুরি বোর্ড উন সার্টেইন রিগার্ড পুরস্কারের জন্য একটি চলচ্চিত্র নির্ধারণ করে এবং আরও দুটি চলচ্চিত্রকে বিশেষ সম্মাননা দিতে পারে। ক্যামেরা ডি’অরের জন্য ক’জন সভাপতিসহ চলচ্চিত্র পরিচালক, কলাকুশলী এবং ফরাসি ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সমালোচকদের নিয়ে গঠিত এই বোর্ড যে কোনো বিভাগে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করে।
কান উৎসবের আয়োজকরা বাইরের ৩টি সংগঠনের আয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। তাই এগুলো প্যারালাল বিভাগ। এর মধ্যে ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইট অন্যতম। আনন্দের বার্তা হচ্ছে, ২০০২ সালে এতে স্থান পায় তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। তার হাত ধরেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের নাম প্রথম মাথা উঁচু করতে পেরেছিল। আর তার ১৯ বছর পর ২০২১ সালে কানের ৭৪তম আসরে বাংলাদেশের আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ জায়গা করে নেয় ‘আঁ সার্তে রেগা’ বিভাগটিতে। শেষ পর্যন্ত এটি কোনো পুরস্কার না জিতলেও উৎসবে অনেকেরই নজর কাড়তে পেরেছিল। মূল প্রতিযোগিতার ঠিক পরেই সম্মানজনক বিভাগ হলো ‘আঁ সার্তে রিগা’। মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের মতোই আঁ সার্তে রিগায় সেরা চলচ্চিত্র, অভিনয়শিল্পী, পরিচালকসহ নানান পুরস্কার প্রদান করে আয়োজকরা। এর মাধ্যমে কানে অফিসিয়াল সিলেকশনের খাতা খুলল বাংলাদেশ।
২০০২ সালে ফিপরেস্কিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায় তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’। তবে ২০০২ সালে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক আহমেদ মুজতবা জামাল ফিপরেস্কির বিচারক ছিলেন। এরপর ২০০৫ ও ২০০৯ সালে আরও দুবার ফিপরেস্কির বিচারকের আসনে দেখা গেছে তাকে। এ বছর ফিপরেস্কির বিচারক হয়েছেন সাদিয়া খালিদ রীতি। তার মাধ্যমে ১০ বছর পর আবারও কান উৎসবের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকসের আমন্ত্রণ পেলেন বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র সমালোচক। বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম ফিপরেস্কির বিচারক হলেন। তার পরবর্তীতে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরে জুরি হিসেবে রেড কার্পেটে হেঁটেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিনিই এই অনন্য সম্মাননা পেলেন।
২০১৬ সালের কান ক্ল্যাসিকস বিভাগে অন্যভাবে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এতে প্রদর্শিত হয় খান আতাউর রহমান অভিনীত পুনরুদ্ধার করা ধ্রুপদী উর্দু ছবি ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৫৮)। এর দৃশ্যায়ন হয়েছিল ঢাকা থেকে ৩০ মাইল দক্ষিণে মেঘনা নদীর তীরে, এক জেলে পল্লিতে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আর এ সময়ের সঙ্গে অর্থবহ ও প্রাসঙ্গিক হিসেবে এটি দেখানো হয় কানে। বাংলাদেশে চিত্রায়িত এটাই প্রথম ছবি, যেটি কান উৎসবের ক্ল্যাসিকস বিভাগে স্থান পায়। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ই প্রথম তুলে ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষের জীবন-বাস্তবতা। জেলেদের নদীনির্ভর জীবনযাপন ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ের বিরল এক ছবি ভাবা হয় এটাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের চিত্রনাট্যে তৈরি হয় ছবিটি।
বাংলাদেশের উদীয়মান চলচ্চিত্রকারদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭০তম আসরে চালু হয় ‘ঢাকা টু কান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ইনিশিয়েটিভ অব বাংলাদেশের (আইএফআইবি) এই আয়োজনে নেতৃত্ব দেন নির্মাতা সামিয়া জামান। তিনি সংগঠনটির সভাপতি। তাকে সহযোগিতা করছে ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জিং ফিল্ম ট্যালেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইইএফটিএ)। এ কার্যক্রমে ২০১৭ সালে তরুণ নির্মাতা আবিদ মল্লিক ও লুবনা শারমিন আর ২০১৮ সালে রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত ও সুমন দেলোয়ার অংশ নেন। মার্শে দ্যু ফিল্মের প্রডিউচার্স ওয়ার্কশপে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্বাহী ও চলচ্চিত্র শিল্পের প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পেয়েছেন তারা।
সম্প্রতি বছরগুলোতে এ উৎসবে বহুমূল্য সাজপোশাক থেকে শুরু করে ছবির ঘটা নিয়ে নেতিবাচক প্রশ্ন উঠেছে! আবার কিছু কিছু তারকাদের বাড়াবাড়ি চোখে লেগেছে অনেকের। এ বিষয় নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলেছিলেন ভারতের পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। তিনি মনে করেন, একটি ছবিও প্রদর্শিত হচ্ছে না ভারতের, তারপরও এত জাঁকজমক করে ভারতীয়দের মেতে ওঠা কেন? অখুশি অভিনেত্রী নন্দিতা দাসও। তার দাবি ছিল, চলচ্চিত্র উৎসব না অন্য কিছু? মানুষ বোধহয় গুলিয়ে ফেলেছেন। এমন অনেক সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব দুনিয়া সব সিনেমাপ্রেমীদের মন জয় করে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমানে আছে স্বগৌরবে। ভবিষ্যতেও থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা করি। জয়তু কান চলচ্চিত্র উৎসব।