‘ইডেন গার্ডেনসের টেস্ট ম্যাচের গল্পটা না হয় তুলেই রাখলাম। ১১৭ টেস্ট পরীক্ষার আসনে বসা বাংলাদেশের জয়-পরাজয়ের অনেক গল্পই হয়েছে। আসুন এবার ম্যাচ নয়; স্রেফ ইডেনের ‘নায়ক’ ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েই গল্প সাজাই। ইডেন গার্ডেনসে তার ব্যস্ত একদিনের ক্রিকেট সূচির গল্পের সাক্ষী আমরাও হয়ে যাই।’
আরিফ সোহেল: একটু ফিরে তাকাই ২০০০ সালে। ফিরে যাই বাংলাদেশের টেস্টে অভিষেক ম্যাচের শুভক্ষণে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্রতিপক্ষ হিসেবে এসেছিল ভারত। সেই ম্যাচেও প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলীও, ভারতের অধিনায়ক। ১৯ বছরের ব্যবধান; এবার ইডেন গার্ডেনসের কথা। এখানেও অভিষেক, দিবা-রাত্রির ম্যাচ আর গোলাপি বলের। বাংলাদেশ-ভারত, এখানেও প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশে আবারো সৌরভ গাঙ্গুলী। ইতিহাসের সেতুবন্ধনের কাকতালটা বোধহয় এভাবেই হয়।
ইডেন গার্ডেনসের টেস্ট ম্যাচের গল্পটা না হয় তুলেই রাখলাম। ১১৭ টেস্ট পরীক্ষার আসনে বসা বাংলাদেশের জয়-পরাজয়ের অনেক গল্পই হয়েছে। আসুন এবার ম্যাচ নয়; স্রেফ ইডেনের ‘নায়ক’ ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েই গল্প সাজাই। ইডেন গার্ডেনসে তার ব্যস্ত একদিনের ক্রিকেট সূচির গল্পের সাক্ষী আমরাও হয়ে যাই।
টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের আরেকটি প্রথম সাক্ষী হলো কলকাতার ইডেন গার্ডেনস। সেখানে সাক্ষী হয়ে থাকলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। বাংলাদেশ-ভারতের দিবা-রাত্রির ঐতিহাসিক টেস্টে ঘণ্টা বাজিয়ে শুভ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ঘণ্টাধ্বনিতেই মাঠে গড়িয়েছে গোলাপি বলের টেস্ট।
বিশ্বে যে কয়জন ক্রীড়াপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক রয়েছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেরা বলা যেতে পারে। আমরা না বললেও কিছু আসে যায় না। কারণ বিসিসিআই প্রধান বাঙালিবাবু সৌরভ গাঙ্গুলীই বলেছেন, ‘আপনাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আনবিলিভ্যাবল। আমাকে উনার অনেক অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও প্রণাম। মানে; আমি আসলেই বিস্মিত একজন প্রধানমন্ত্রী এখানে বলবে, “আমি সারাদিন বক্সে বসে খেলা দেখব। আমি হোটেলে যাব না”; এটা ভাবা যায় না। উনাকে আমার তরফ থেকে অনেক অনেক ভালোবাসা দিবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন মার্চ মাসের ১৭ তারিখ আমি বাংলাদেশে আসব।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের মানুষও তাই ভাবেনÑ আপাদমস্তক ক্রীড়াপ্রেমী।
শুধু বাংলাদেশই নয়; পৃথিবীর দেশে দেশে সুযোগ পেলেই ক্রীড়া আসরগুলো একান্ত ভক্তের মতো উপভোগ করতে ছুটে গিয়েছেন। সেখানে রাষ্ট্রীয় বড় পরিচয়ও কিছু আড়ালে চলে গেছে তার ক্রীড়াবান্ধব মনোভাবের কাছে। তার সর্বশেষ প্রকাশ পেয়েছে গোলাপি বলের ইডেন গার্ডেনসে। ক্রীড়াঙ্গনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ-ভারতের গোলাপি বলের প্রথম দিবা-রাত্রির ঐতিহাসিক টেস্ট দেখতে উড়ে গিয়েছেন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। গত ২২ নভেম্বর এই সফরে সঙ্গী হিসেবে আরও ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এমপি, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি, শেখ হেলাল এমপি, নাইমুর রহমান দুর্জয় এমপি, ভারতের ক্রিকেট কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকার, ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীসহ বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণকারী উভয় দেশের খেলোয়াড়রা এ-সময় মাঠে উপস্থিত ছিলেন।
ভারতের মাটিতে প্রথম গোলাপি বলের ম্যাচ স্মরণীয় করে রাখতে নানা আয়োজন করেছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। তারই অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় টেস্ট উদ্বোধন করার জন্য। বিশেষ করে বিসিসিআই সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীর পাশাপাশি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামে যাওয়ার পর ম্যাচের টস হয়। টস শেষে গোলাপি পোশাক পরা ছোট বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে প্রবেশ করে দুই দলের খেলোয়াড়রা। মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে ভারতীয় দলের খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বাংলাদেশ দলকে পরিচয় করিয়ে দেন অধিনায়ক মুমিনুল হক। মুমিনুলের কাছে বাংলাদেশ দলের ব্যাপারে খোঁজখবর নেন তিনি। তাছাড়া মুশফিকুর রহিমের মাথায় হাতও বুলিয়ে দেন শেখ হাসিনা। মাঠে কলকাতার পুলিশ বাহিনীর একটি বিশেষ ব্যান্ডদল তাদের পারফরমেন্স পরিবেশন করে। অন্য আয়োজনের মতো পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়নি। মাঠে অর্কেস্ট্রার সুরে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘জনগণমন’। এরপর স্থানীয় সময় ১২টা ৫৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ১টা ২৫ মিনিট) ভিভিআইপি গ্যালারিতে রক্ষিত ঘণ্টায় লাগানো রশি ধরে টান দিয়ে প্রথম দিবা-রাত্রির গোলাপি বলের এই ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘণ্টা বাজার পরই বল মাঠে গড়ায়। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমেছিল বাংলাদেশ। মাঠে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সেশনের খেলা উপভোগ করেন। ভিভিআইপি গ্যালারির বিশেষ বক্সে শেখ হাসিনার পাশেই বসা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ-সময় ইডেন গার্ডেনে শেখ হাসিনাকে দেখা গেছে খুবই সপ্রতিভ, প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছল।
বাংলাদেশ-ভারতের ‘ঐতিহাসিক’ গোলাপি বলের টেস্টের উদ্বোধক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সফরে কথা বলেছেন লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গেও। ইডেন টেস্ট ম্যাচের প্রথম সেশনের খেলা দেখার পর হোটেলে ফিরে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। তিনি সন্ধ্যায় পুনরায় স্টেডিয়ামে ফিরে আসেন। প্রথম দিনের খেলা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়ামে বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। রাত ১০টায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশ্যে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ফ্লাইটটি রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে।
সকালে কলকাতায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৌঁছলে তাকে স্বাগত জানান কলকাতার মেয়র এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নগর উন্নয়ন এবং পৌরসভা বিষয়ক মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, বাংলাদেশে কর্মরত ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাস ও ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলী। সেখান থেকে শেখ হাসিনা সোজা চলে যান দক্ষিণ কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েই তিনি যান ইডেন গার্ডেনসে। সফরকালে মিডিয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের (বাংলাদেশ) পাশে ছিল। যুদ্ধের সময় এই কলকাতাই বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, তা আমরা কোনোদিন ভুলিনি। মুক্তিযুদ্ধে ভারতবাসীর অবদান চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ-কথা বলেন তিনি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমি সৌরভ গাঙ্গুলীর দাওয়াতে কলকাতা এসেছি। দুই দেশের মধ্যে গোলাপি বলে প্রথম খেলা হচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আমি সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। এদেশের (ভারত) মানুষের প্রতি সব সময় আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। আমি যখনই এদেশে আসি আমার খুবই ভালো লাগে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই যে আমরা দুটো প্রতিবেশী দেশ, সব সময় আমাদের সম্পর্ক চমৎকার। এই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সব সময় সম্পর্ক বজায় থাকুক সেটাই আমরা চাই।’
‘গোলাপি বল’ দিয়ে প্রথমবারের মতো পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচ আয়োজনকে কেন্দ্র করে পুরো ইডেন গার্ডেনসকে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত করা হয়। ফেয়ার প্লে প্ল্যাকার্ডবাহী শিশু থেকে শুরু করে স্কোর বোর্ড এমন কী ম্যাচের টস কয়েনটিও গোলাপি বর্ণের ছিল। এই টেস্ট ঘিরে কলকাতা ছিল রীতিমতো গোলাপি জ্বরে আক্রান্ত। পুরো ইডেন গার্ডেনসকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল গোলাপি আভার নববধূ সাজে। শহরের সর্বত্রই ছিল গোলাপির ছোঁয়া। কলকাতার বিভিন্ন স্থাপনাতেও করা হয়েছিল গোলাপি আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। মাঠের কর্মতৎপর মানুষগুলোও ছিল গোলাপি জামা পরিহিত। খেলার ব্রেক টাইমে ফ্লাডলাইট স্ট্যান্ডে জ্বলে উঠেছে গোলাপি আলো। স্টেডিয়ামের সব স্তম্ভ মুড়ে দেওয়া হয়েছে গোলাপির বর্ণিল রঙে। প্রদর্শিত নৌকার সাজেও ছিল গোলাপির রংখেলা।
পাদটীকা : বাংলাদেশের এটা ছিল ভারতে প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। টি-টোয়েন্টি সিরিজ প্রথম ম্যাচে ভারতকে কাঁপিয়ে জয় দিয়ে শুরু করলেও সিরিজের ফল ভারতের অনুকূলে ২-১। পাশাপাশি দুই টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে বাংলাদেশ। দুটিই ইনিংস ব্যবধানে হার। এই সিরিজ দিয়েই বাংলাদেশের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেকও ঘটেছে। আর ইডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে গোলাপি বলে প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্ট। যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এই টেস্টে বাংলাদেশ এক ইনিংস ৪৬ রানে হেরেছে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যায়। ভারত ৩৪৭ রানে ডিক্লিয়ারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ অল আউট হয়েছে ১৯৫ রানে।