কৃষিবিদ রাজিয়া সুলতানা : করোনা-কবলিত পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াবেই। সেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কৃষি। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায় বলতে হয়Ñ আমাদের দেশের জমি এত উর্বর যে বীজ ফেললেই গাছ হয়, গাছ হলেই ফল। তার রেশ ধরেই তার সুযোগ্য দূরদর্শী কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন- যাতে এক ইঞ্চি চাষের জমিও ফাঁকা না থাকে। এছাড়া তিনি ছাদকৃষির ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
একটু পেছনে ফেরা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর। সারা পৃথিবী যেন ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠল। আবির্ভাব হলো নভেল-১৯ করোনাভাইরাসের। জীবননাশী এই ভাইরাসের জন্ম চীনের উহানে। অল্প দিনের মধ্যেই যার করাল থাবা পড়ল সারাবিশ্বে। রূপ ধারণ করল মহামারির। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়ল ২০৯টি দেশে। কোথায়ও অস্বাভাবিক, কোথায়ও একটু কম মাত্রায় আঘাত হেনেছে করোনা। সারাবিশ্ব এখন একটি অজীবীয় বস্তু করোনা-১৯ নামক ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ। ইতিহাস রেকর্ড বুক থেকে শতভাগ নিশ্চিত করছে এ-ধরনের মহামারি মানেই ভয়াবহ বৈশ্বিক মন্দা। এখনও সারাবিশ্ব স্তম্ভিত, শঙ্কিত অজানা করোনাভাইরাসকে নিয়ে। বিজ্ঞানের সব চিন্তায়ও যথাযথ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে এখনও সক্ষম হয়নি। ভেঙে পড়েছে সারাবিশে^র অর্থনীতি। জনজীবন কর্মহীন লকডাউনের শিকার। অর্থাভাব, খাদ্যাভাব মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মরণ-বাঁচনের কাউন-ডাউন এখন সগৌরবে চলছে। তারপরও বেঁচে থাকতে হবে। কারণ করোনা মানেই মৃত্যু নয়- বরং এ এক দেহ-মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের নাম। এখানে প্রায় ৯৫-৯৮ শতাংশ করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষই জয়ী হয়। তাই এখন করোনা নয়, যাপিত জীবন বাঁচিয়ে রাখার অনুষঙ্গ উৎপাদন নিয়ে ভাবতে হবে। নামতে হবে কৃষি উৎপাদনের নতুন সাহসী যুদ্ধে। এই তো ২০১৩ সালের কথা। ওই বছর ডিসেম্বরে শুরু হয়েছিল ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণ। প্রকোপ মহামারি আকার ধারণ করেছিল পশ্চিম আফ্রিকার গিনি, সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ায়। ওই যাত্রায় মহামারি শেষ হয়েছিল ২০১৫ সালে। ওই সময় দেখা দিয়েছিল প্রচ- খাদ্যাভাব। আর একটু পেছনে তাকাইÑ ১৯১৮ ও ১৯১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ভয়ানক স্প্যানিশ ফ্লু। ১৮৯৪ সালে চীনের ক্যান্টনে প্লেগ। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে কলেরা ও গুটিবসন্ত। এ-ধরনের মহামারিতেই গ্রামের পর গ্রামের মানুষ উজাড় হয়ে যেত। সব মহাতা-বের পরই দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ। ফলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদেরও। বিশ্বাস রাখতে হবে সৃষ্টিকর্তার ওপর। এই করোনা নামক অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে আমরা অচিরেই মুক্তি পাব। তবে করোনার এই ছয়-সাত মাসের ধাক্কা সামলে ওঠা খুব সহজ মানছে না খোদ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। তাদের স্পষ্ট উচ্চারণÑ খাদ্য সংকটে পড়তে পারে সারাবিশ্ব। ফলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন সুজলা-সুফলা সোনার বাংলা খাদ্যের সমস্যায় না পড়ে তার মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। পাশাপাশি ন্যুব্জ হয়ে পড়া অর্থনীতিকে জাগিয়ে তুলতে কৃষি উৎপাদনকেই বেছে নিতে হবে। কারণ জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ১০-১১ শতাংশ। বাংলাদেশের দুঃসময়ে আমাদের বড় বন্ধু হয়ে দেখা দিয়েছে তৃণমূলের কৃষক-সমাজ। সে-কারণে বলা হয়েছে, “সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা/দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা।”
তাই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই করোনা মহামারির কারণে মন্দার হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মজুদ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা। ঋণ দিচ্ছেন মাত্র ৪ শতাংশ সুদে। করোনাকালীন সাধারণ ছুটির সময়েও কৃষি কার্যক্রম সক্রিয় রাখতে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন সব কর্মকর্তারা রয়েছেন স্ব-স্ব কর্মস্থলে। যাচ্ছেন সরাসরি মাঠ পর্যবেক্ষণে। জানাচ্ছেন করোনার সতর্কতা, পাশে থাকছেন কৃষি কাজেও।
চলছে বোরো ধান কাটার ভরা মৌসুম। প্রতি বছরই বোরো ধান হতে প্রায় ছয় মাসের খাদ্য ঘরে আসে বাংলাদেশের। পাশাপাশি খুশির খবর হলোÑ এখনও সরকারের ভা-ারে মজুদ আছে প্রায় তিন মাসের খাদ্য। হাওর তথা সমস্ত দেশের বোরো ধান পেকে গেছে। লকডাউনের কারণে শ্রমিক সংকট রয়েছে। তাই শ্রমিক সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হাওর অঞ্চলের ধান কাটার জন্য জরুরিভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার সরবরাহ করা হয়েছে। হাওরে যেসব শ্রমিক যাচ্ছেনÑ তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক প্রভৃতি উপকরণ, নিরাপদ যাতায়াতের জন্য আলাদা গাড়ি, নির্বিঘœ গমনাগমন, ধান কাটা স্থল স্বাস্থ্যসম্মত রাখা ইত্যকার কাজে উপজেলা কৃষি অফিসাররা সরাসরি তদারকি করছেন। মানব শ্রমিক ও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে হাওরের বোরো ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। ন্যায্যমূল্যে চাল কিনবে সরকার; ওটাও ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে যাতে কোনো অনিয়ম না হয় তাই করা হবে লটারির ব্যবস্থা। সবকিছু সামাল দিতে বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এমপি নিজেই ছুটে বেড়াচ্ছেন কৃষকদের প্রয়োজনীয় এলাকায়।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। কৃষিবান্ধব সরকার কৃষকের স্বার্থে সার, সেচ, ইক্ষু চাষসহ কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ প্রদান করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি পুনর্বাসনে ১২০ কোটি টাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ক্ষতিপূরণ ও সমবায়ভিত্তিক চাষাবাদের জন্য ৫০ কোটি টাকা এবং ফসলে নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের জন্য প্রদর্শনী স্থাপন ও গ্রহণকরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে। করোনার ভয়াল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কোনো কৃষক যাতে অনাহারে না থাকে; তাই তৃণমূলের কৃষকদের আনা হয়েছে ত্রাণের আওতায়।
আমাদের দেশের কৃষক তথা কৃষিবিদ কৃষকরতেœর নির্দেশনানুযায়ী খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চাষযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আউশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৩ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সঠিক সময়ে বীজতলা তৈরি, রোপণ, সেচসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারি প্রণোদনা হিসেবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের মাঝে সার, বীজ প্রভৃতি বিনামূল্যে বিতরণের জন্য কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ছাদ-বারান্দাসহ বসতবাড়ির আঙিনা, সকল পতিত জমিতে শাক-সবজি, ফলমূল ও অন্যান্য ফসলের চাষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। সাধারণত প্রতিবছর ৩০ লাখ টন আউশ ধান উৎপাদিত হয়। আসন্ন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। সে-জন্য আসন্ন আউশ মৌসুমে বিএডিসি’র সেচের রেট ৫০ শতাংশ হ্রাসের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ৬ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন হাইব্রিড ও উফশি জাতের বীজ ইতোমধ্যে কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
সার্বিকভাবে করোনা-পরবর্তী সময়ের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সারাবিশ্ব করোনার করাল গ্রাসে আচ্ছন্ন। ফলে অন্যদেশ হতে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই নিজের দেশে যা আছে তা নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। কৃষির প্রতিটা সেক্টরেই (যেমনÑ কৃষি, প্রাণিজ সম্পদ এবং মৎস্য সম্পদ) সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে ভর্তুকি। বর্তমানে কৃষক দেয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ শতাংশ আর সরকার ৭০ শতাংশ। তবে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ বিতরণের ব্যবস্থা করতে পারলে কৃষকরা উপকৃত হবে। সেচ সুবিধা নিশ্চিতে কৃষক যে ৫০ শতাংশ চার্জ প্রদান করে তাও বিবেচনায় আনবেন আমাদের জনবান্ধব সরকার। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে দক্ষ করে তুলতে হবে। কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। বসতবাড়ির আশপাশে, জমির আইলে, রাস্তা-বেড়িবাঁধের ধার, পুকুরপাড়সহ সকল জমি উৎপাদনের আওতায় আনতে হবে। সকল অনাবাদি জমি চাষের আওতায়, এক ফসলি জমিকে পারলে দু-ফসলি জমিতে উন্নতিকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, সমন্বিত খামার বাড়ানো, প্রাকৃতিক উৎসের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত, সময়মতো রোগবালাই ব্যবস্থাপনাসহ উৎপাদনমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আমাদের কৃষিবান্ধব সরকার।
করোনা-পরবর্তী সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের বিশাল জনগণকে জনসম্পদে পরিণত করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এখনই সময় বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। আর অবশ্যই খাদ্য উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার বিকল্প নেই। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সর্বোপরি কৃষকের বাইরেও সাধারণ জনগণকে সরকারের সকল কার্যক্রমকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।
আবার ফিরে তাকানো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে আত্মনির্ভর করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ছিলেন যে কোনোভাবেই কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেনÑ বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি, তাই তো বারবার বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষণকে টেনে এনেছে। এই বাংলার মাটি বাংলাদেশের মাটি, যদি সোনার চেয়ে খাঁটি না হতো তাহলে এতদিন আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। বাংলার মাটি দুনিয়ায় কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাটিতে সোনালি ফসল ফলিয়ে সোনার বাংলা তৈরি করা সম্ভব। তিনি আরও বলেছিলেনÑ আমাদের গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে, কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। অধিক শস্য উৎপাদন করার জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য বিমোচনের তাগিদে কৃষি উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। স্বল্পমেয়াদি উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছিল। বর্তমান ক্রান্তিলগ্নেও জাতির পিতার কথা পুরো স্মরণ করতে চাইÑ ‘সবুজ বিপ্লব ব্যতীত দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়।’
লেখক : শিক্ষক; পিএইচডি গবেষক, প্ল্যান্ট প্যাথলজি
শেরে বাংলা কৃষি ইউনিভার্সিটি
raziasultana.sau52@gmail.com