মানবেতিহাস আর কখনও এমন করে থমকে দাঁড়ায় নি। আর কখনও আধুনিক সভ্যতাগর্বী মানুষ, ধনী কী গরিব, পূর্ব কী পশ্চিম, অত্যুন্নত কী হত-দরিদ্র, বৃহৎ কী ক্ষুদ্র, কালো কী ধলো, খ্রিষ্টান কী কনফুসিয়ান, হিন্দু কী মুসলমান, সম্মিলিতভাবে সমগ্র মানবজাতি আর কখনও এতটা অসহায়বোধ করেনি। গত বছর ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান প্রদেশে যখন এই ঘাতক ভাইরাস তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখনও মনে হয়নি, সমস্যাটি চীনের সীমান্ত ছেড়ে পৃথিবীজোড়া তাণ্ডব চালাবে। কিন্তু বৈরী প্রকৃতি তা-ই করে চলেছে।
মানুষ অসহায়বোধ করছে, কারণ এই ভাইরাস বা রোগ-জীবাণুটির কোনো প্রতিষেধক নেই; নেই কোনো সুনির্দিষ্ট ঔষধ। যদি প্রতিষেধক ও নিরাময়যোগ্য ঔষধ থাকত, তাহলে মানবজাতি ততটা আতঙ্কিত হতো না, অসহায়ত্ববোধ করত না।
মানবেতিহাসে লোক ক্ষয় ও ভয়াবহতার দিক থেকে আরও বড় বড় মহামারি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তবে সবগুলো মহামারি ছিল স্থানিক বা দৈশিক। এমন দুনিয়াজোড়া, একই সময়ে, একযোগে আক্রমণ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে এগিয়ে আছে। সেই তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে।
মানবজাতি অসহায়বোধ করলেও নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে নেই। সবাই চেষ্টা করছে যার যার সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে করোনা মোকাবেলা করতে। প্রতিষেধক রাতারাতি আবিষ্কার হবে না। তারপরও সংক্রমণ ঠেকানো এবং সংক্রমিতদের বাঁচানোই সকল জাতির অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা পরিসংখ্যান দেব না। কেননা ‘উত্তরণ’ প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকের হাতে পৌঁছানোর পর ঐ পরিসংখ্যান কতটুকু বাড়বে তার নিশ্চয়তা নেই। পরিস্থিতির ভয়াবহতা ঠেকানো এবং নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। মানুষ বাঁচানো, করোনার সংক্রমণ ঠেকানো আমাদের এক নম্বর কাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানসূচি স্থগিত ও সংক্ষিপ্ত করে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা এই মহামারি ঠেকানো এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য সমগ্র দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে এক অভিনব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনিই এই যুদ্ধের সিপাহশালার।
সরকার প্রথম থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না নিলে, এখন ঘরে ঘরে আহাজারি উঠত। সরকারের বিভিন্নমুখী ব্যবস্থার ফলে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যেমন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে, তেমনি আক্রান্তদের অধিকাংশ সুস্থ হয়ে ফিরছে। মৃতের সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে লকডাউন চালাচ্ছে। এমন বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে দীর্ঘ লকডাউন বা অফিস-আদালত, কল-কারখানা, পরিবহন বন্ধের আর্থিক ফলাফল মোকাবেলা করাও যুদ্ধের শামিল। মহামারিতে মৃত্যু ঠেকাতে গিয়ে ক্ষুধায় মৃত্যু ঠেকানোও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব নিয়মবিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করেছে, সেগুলো পালন করা কোনো আদেশ-নির্দেশ দিয়ে হবে না। এ-জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ বা চেষ্টা অপরিহার্য। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’- এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমাদের সামনে একটাই কর্তব্য : মানুষ বাঁচাও – দেশ বাঁচাও। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষের জয়কে অনিবার্য করে তোল। সমাজের বিত্তশালী মানুষ, উদ্যোক্তা-শ্রেণি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেনাবাহিনীর সদস্য, ডাক্তার-নার্স, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী, ধনী-দরিদ্র- আসুন সবাই – আমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াই। বাইরের সাহায্যের সম্ভাবনা এবার তেমন নেই। আসুন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে আমরা করোনা মহামারির বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে, সংক্রমণের বিরুদ্ধে, ক্ষুধার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই। ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ নিশ্চয়ই মানুষ জয়লাভ করবে। এই দুর্যোগ কেটে যাবে।