Thursday, November 30, 2023
বাড়িSliderকমলা রঙের ভূত

কমলা রঙের ভূত

নিজের গায়ের রং নিয়ে অনেকদিন ধরে বিষণ্নতায় ভুগছিল কমলা রঙের ভূতটা। এ নিয়ে ভূতরাজ চিন্তিত ছিল। একদিন ওকে হাওয়া বদলের জন্য পাঠিয়ে দিল পৃথিবীতে। কিন্তু ওর পোড়া কপাল! পৃথিবীর এমন এক দেশে ও নেমে এলো যে, এখানে রঙের ছড়াছড়ি।

দর্পণ কবীর: রং দেখলেই গা জ্বালাপোড়া করে কমলা রঙের ভূতটার। ভূতদের কোনো রং হয় না, অথচ ওর নিজের রং কমলা। ভূত রাজ্যে ও নিজে একমাত্র ভূত, যার সারা গায়ে কমলা রং! ওকে দেখে ভূতেরা হাসে, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। কেউ কেউ অপমানজনক কথাও বলে ফেলে। নিজের গায়ের রং নিয়ে অনেকদিন ধরে বিষণ্নতায় ভুগছিল কমলা রঙের ভূতটা। এ নিয়ে ভূতরাজ চিন্তিত ছিল। একদিন ওকে হাওয়া বদলের জন্য পাঠিয়ে দিল পৃথিবীতে। কিন্তু ওর পোড়া কপাল! পৃথিবীর এমন এক দেশে ও নেমে এলো যে, এখানে রঙের ছড়াছড়ি।
কমলা রঙের ভূতটার একটা পারিবারিক নাম আছে, তা হলো- কুমো। ভূতরাজ্যে এই নামে ওকে কেউ ডাকে না, ওখানে ওর নাম হয়েছে ‘রংফড়িং’। ভীষণ শ্লেষ মিশ্রিতকণ্ঠে এই নামে ডাকে অন্য ভূতেরা। বিষণ্নতা রোগ নিরাময় করতে কুমো বাংলাদেশে নেমেই বুঝতে পারল এখানে আরও বিষণ্ন হয়ে থাকতে হবে ওকে। এখানকার মানুষগুলো ভীষণ আবেগপ্রবণ, একটা কিছু হলেই তারা হৈ-হুল্লোড় করতে থাকে। সবচেয়ে পীড়াদায়ক আচরণ হচ্ছে, তারা এই রং, ওই রঙের পতাকা নিয়ে মাতামাতি করে খুব। তাদের মধ্যে দলবাজি করার চরিত্রও প্রকট। এই যে বিশ্বকাপ ফুটবলের নামে এখানে যা হচ্ছে, তা পাগলামির চেয়েও কয়েক ধাপ বেশি। একদল মানুষ যদি আকাশি রঙের পতাকা নিয়ে হৈচৈ করছে, আরেক দল আবার হলুদ রঙের পতাকা নিয়ে উল্লাসে মাতোয়ারা। পাল্টাপাল্টি কথা, তর্কাতর্কি তো লেগেই আছে, কদাচিৎ অপ্রীতিকর ঘটনারও জন্ম দিচ্ছে তারা। অন্য দেশের সমর্থন নিয়ে নিজের দেশের মানুষরা বিভক্ত হয়ে যেন লড়াই বাধিয়ে ফেলছে! কী একটা অবস্থা! এরা আগে না-কি সাদা-কালো এবং আকাশি রঙের জার্সি নিয়েও ফুটবল খেলার মাঠে অনেক লড়াই করেছে। পাল্টাপাল্টি রং নিয়ে এখানকার মানুষগুলোর রণাঙ্গন তৈরি করার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না কুমো। ও বাংলাদেশে এসে যেন গোলক ধাঁধায় পড়েছে। একটা গোলাকার বল নিয়ে বাইশজন মানুষের দৌড়াদৌড়িতে কী লাভ- এরও কোনো কারণ ঠাওর করতে পারছে না ও। মানুষগুলো গোলাকার বলটাকে শুধু পায়ে পায়ে রাখছে কেন- এটাও ওর কাছে অপার রহস্য। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে ঘোরের মধ্যে ডুবে থেকে কী আনন্দ পাচ্ছে- এটা খুব জানার ইচ্ছে ওর। ফুটবল খেলা কী- এটা জানার জন্য ওর মধ্যে প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো।
কুমো আকাশের দিকে মুখ উঁচিয়ে জোরে একটা ফুঁ দিতেই ভূতরাজ্য থেকে ওর সঙ্গে আসা হযবরল ভূত দৃশ্যমান হলো। হযবরল ভূত এত কুচকুচে কালো যে, খোলা চোখে দেখা খুব কষ্টদায়ক। কুমো হযবরল-কে শনাক্ত করে বলল,
‘এই বল তো, পৃথিবীর মানুষগুলো ফুটবল খেলা নিয়ে এত মাতামাতি করে কেন? এটা কেমন খেলা? একটা বলের পেছনে সবাই দৌড়ায় কেন? ওদের প্রত্যেককে একটা করে বল দিলেই তো হয়!’
হযবরল ভূতটা চিঁচিঁ শব্দ করে হাসল। হাসি থামার পর বলল, ‘এই খেলার নিয়ম এবং সৌন্দর্য হচ্ছে একটা বলের দখল এবং প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে বল পাঠানো। পোস্টে বল পাঠানোকে গোল বলে। বাইশজন খেলোয়াড়কে ২২টি বল দিলে তাহলে আর খেলা হবে না।’
‘আচ্ছা, খেলোয়াড়গুলো রঙিন জামা পরে খেলে কেন?’
‘ওরা রঙিন পোশাক পছন্দ করে। সাদা বা কালো রঙের জার্সি পরেও কিছু দলের খেলোয়াড় খেলে থাকে। একেক দলের একেক রঙের জার্সি থাকে।’
কুমো একটু ভাবল। ভেবে ও বলল,
‘ভূতরাজ্যে ফুটবল খেলা চালু করা যায় না?’
হযবরল ভূতটা ফের চিঁচিঁ শব্দ করে হাসলো। কুমো একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘কথাটি হেসে উড়িয়ে দিলে হবে না। মানুষ যদি বল খেলে আনন্দ পায়, আমরা কেন পাব না? ভূতরাজ্যে তো আনন্দের কিছু নেই!’
কুমোর কথার জবাবে হযবরল ভূত ঠাট্টার কণ্ঠে বলল,
‘আমরা মানুষের মাথার খুলি দিয়ে বল খেলতে পারি। সমাধিস্থল থেকে মৃত মানুষের খুলি নিয়ে ভূতরাজ্যে ফিরব তাহলে।’
কুমো আঁতকে ওঠা কণ্ঠে বলল,
‘না, না, মানুষের মাথার খুলি নয়! বল নিয়ে যাব।’
‘বল!’
‘কেন বল সঙ্গে নিয়ে আমাদের রাজ্যে ফিরতে পারব না?’
জানতে চাইল কুমো। হযবরল ভূতটা ওর টেকো মাথা চুলকে বলল,
‘তুমি হচ্ছো ভূতরাজের পুত্র। ভূতরাজকে বললে হয়তো বল নিয়ে যেতে অনুমতি দেবেন। আমি তাকে এ-কথা জানাব। তার অনুমতি না পেলে বল নিয়ে যেতে পারবে না।’
‘তা জানি। তুমি কথা বলে নিয়ো। আমি একটা বল নিয়ে ফিরতে চাই।’
‘ঠিক আছে। কথাটা জানাব ভূতরাজকে। তবে তোমাকে একটা কথা মনে রাখতে হবে। পৃথিবীবাসীর কেলেন্ডার হিসেবে তুমি আর ৩০ দিন থাকতে পারবে এখানে। এর মধ্যে তোমার বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে হবে। তুমি সুস্থ হলে ভূতরাজ নিশ্চয় তোমার আনন্দের জন্য বল নিয়ে যাবার প্রার্থনার প্রতি সদয় হবেন।’
‘আচ্ছা, আমার যদি আরও বেশিদিন পৃথিবীতে থাকতে ইচ্ছে করে!’
‘থাকতে পারবে, তবে ভূতরাজ্যে ফিরতে পারবে না। আমিও তোমার সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতে পারব না। ৩০ দিন পর আমি ভূতরাজ্যে চলে যাব। তখন তোমাকে কে দেখবে? বিপদে পড়লে কে পাশে দাঁড়াবে? কার সঙ্গে কথা বলবে তুমি?’
হযবরল ভূতের কণ্ঠে কেমন মমত্ব ঝরে পড়ে। কুমোর মনটা আদ্র হয়ে যায়। ও বলে, ‘আমাকে এমন শক্তি দাও, যাতে আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি। ওদের সঙ্গে থেকে বল খেলাটা শিখতে পারি। এরপর বল নিয়ে তোমার সঙ্গে ভূতরাজ্যে চলে যাব।’
‘কিন্তু মনে রেখ, মানুষের মধ্যে মায়া আছে। এটা মানুষের অদ্ভুত গুণ। তুমি যদি এই মায়ায় জড়িয়ে পড়ো, তখন কী হবে? এমন হলে কিন্তু তুমি ভূতরাজ্যে ফিরতে চাইবে না। আগেও পৃথিবীতে অনেক ভূত এসে মানুষের মায়ার ঘোরে ভূতরাজ্যে ফিরে যায়নি।
‘আমি তোমার এ-কথা মনে রাখব। মানুষের মায়ায় জড়িয়ে যাব না। শুধু ওদের সঙ্গে বল খেলার ব্যবস্থা করে দাও।’
হযবরল ভূত গম্ভীর হয়ে রইল কিছুক্ষণ। কুমো জানে, ওকে ফেরাবে না সে। হযবরল ওকে খুব পছন্দ করে। অনেকদিন ধরে হযবরল ওকে লালন-পালন করছে। ভূতেরও মায়া আছে। কথাগুলো ভাবছিল কুমো। ওর ভাবনাকে ভেঙে হযবরল বলল,
‘ঠিক আছে তোমার ইচ্ছা পূরণ করছি। তোমাকে বিশেষ শক্তি প্রদান করছি। তুমি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবে, খেলতে পারবে, কথা বলতে পারবে। শুধু নিজেকে ‘ভূত’ পরিচয় দিয়ো না। ওরা অবশ্য বিশ্বাস করবে না, আবার বিশ্বাস করলে তোমার রক্ষা নেই!’
‘আহা, তুমি কত ভালো ভূত। আমাকে অনেক ভালোবাসো, জানি। আজ যদি অমাবশ্যার রাত হতো, তোমাকে আমি রাতের তাবৎ অন্ধকার তুলে দিতাম।’
কথাটা বলে কুমো নিজের দু-পা আকাশের দিকে উঁচিয়ে সাম্বা নৃত্য করতে লাগল। পৃথিবীর ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে এই নাচের খুব প্রচলন আছে। ওরা অবশ্য আকাশের দিকে পা তুলে নাচতে পারে না। মানুষের পা মাটিতে থাকে। কুমোর অদ্ভুতুরে নাচ দেখে চিঁচিঁ শব্দ করে হযবরল ভূত হাসতে লাগল।
গ্রামের নাম বিজয়পুর হলেও এই গ্রামের মানুষরা ফুটবল খেলায় কেবল পরাজয় দেখে। প্রতিবছর এই গ্রামে ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আর প্রতিবছরই কিশোর ছেলেরা হারের অভিজ্ঞতা লাভ করছে। গত ছয় বছর যাবত ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে বিজয়পুরের ছেলেরা গণ্ডা-গণ্ডা গোল খেয়েছে। ওদের ললাটে যেন বিজয় বলতে কিছু নেই। আশেপাশের গ্রামের ছেলেরা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপা নিয়ে গেল। বিজয়পুরের দাপুটে ফুটবলাররা চোখের জলে ভাসে। এই গ্রামের মানুষরা ওদের খেলোয়াড়দের ‘দাপুটে’ বিশেষণটা ধরে রেখেছে। তারা আক্ষেপ করে বলেন,
‘ছেলেরা খারাপ খেলছে না, শুধু একজন দক্ষ স্ট্রাইকারের অভাব!’
গ্রামের বয়স্ক লোকগুলো তো এই আক্ষেপ থেকে একচুলও নড়বেন না। এমন কী ছেলেদের ফুটবল কোচ সত্যানন্দ ঘোষও এ-কথার সঙ্গে এ বছর সুর মিলিয়েছেন। বিজয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক সত্যানন্দ ঘোষ কোনো কিছুতেই ইতিবাচক মন্তব্য করেন না। তার খুঁতখুঁতে স্বভাব। তিনি গত শুক্রবার হাটে চেয়ারম্যান হাকিম আলীর কাছে অতি আবেগে বলেই ফেললেন,
‘এবার আমাদের ছেলেরা শুধু গোল খাবে, তা নয়! ওরা গোলও দেবে, দেখে নেবেন, চেয়ারম্যান সাহেব! ওদের হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। দলে নতুন নতুন ফুটবলারও যুক্ত হয়েছে। কয়েকজনের স্কিল খুব ভালো। শুধু আক্রমণ ভাগটা জুঁতসই হচ্ছে না। তারপরও আমি এবার আশাবাদী।’
সত্যানন্দ ঘোষের কথা অবহেলিত দমকা হাওয়ার মতো, এলো এবং মিলিয়ে গেল যেন। চেয়ারম্যান হাকিম আলী তার কথা শুনে মুচকি হেসেছিলেন। চেয়ারম্যানের সঙ্গে থাকা কয়েকজন বয়স্ক মানুষ ও চামচা ‘বেশ রসিকতা শুনছেন’ এমন ভাব চোখের তারায় ফুটিয়ে হেসেছিলেন। সত্যানন্দ ঘোষ অপ্রস্তুত বোধ নিয়ে চলে এসেছিলেন সেদিন। এ দৃশ্যটা বিজয়পুর একাদশের অধিনায়ক রূপম একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু ওর খারাপ লাগেনি। ওরা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে, অথচ খেলায় জিততে পারছে না। ওরা মাঠে প্রাণপণ লড়াই করে; কিন্তু গোল পায় না। এখন ওদের নিয়ে কেউ প্রশংসা করলে তা হেসে উড়িয়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক। রূপম যখন সত্যানন্দ ঘোষ স্যারের ওদের নিয়ে প্রশংসা করার কথা বন্ধুদের বলছিল, তখন একটা লিকলিকে ছেলেকে নিয়ে বিজন এসে হাজির হলো। রূপম দেখল ছেলেটির গায়ের রং অদ্ভুত, কমলা রঙের ছাপ যেন! অস্বাভাবিক লম্বা। বিজন ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল,
‘রূপম, এই ছেলেটি নিজের বাড়ি থেকে অভিমান করে আমাদের গাঁয়ে এসে পড়েছে। কাল ওর সঙ্গে পরিচয় হলো নদীর পাড়ে। ও না-কি ভালো ফুটবল খেলতে পারে। আমাদের টিমে খেলতে চায়। স্কুলের মাঠের কোণে বসেছিল রূপম, শফিক, হায়দার, পিন্টু, তাপস ও মৃদুল। মাঠে বল নিয়ে প্র্যাকটিস করছে ওদের টিমের অপর খেলোয়াড়রা। ওরাও প্র্যাকটিস করবে। প্র্যাকটিসের আগে মাঠের কোণে বসে গল্প করছিল ওরা। বিজনের কথা শুনে ওরা হেসে ফেলল। তাপস বিদ্রুপকণ্ঠে বলে ফেলল,
‘অভিমানী ছেলেটির গায়ে কমলা রং মেখেছে কে রে? না-কি ওর জন্ডিস হয়েছে?’
এবার ছেলেটি মুখ খুলল। ও বলল,
‘তোমাদের একজন দক্ষ স্ট্রাইকার দরকার। আমি কিন্তু মাঠের যে কোনো প্রান্ত থেকে গোলপোস্টে বল পাঠিয়ে দিতে পারি। কাজটা পায়ের, বুদ্ধি ও প্রতিভার। গায়ের রং দিয়ে তোমরা কী করবে?’
ছেলেটির কথাটা ভালো লাগল রূপমের। তবে ওর কথাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মাঠের যে কোনো প্রান্ত থেকে গোল করার মতো ক্ষমতা কারও নেই। রূপমের মনের কথাটা যেন পড়ে ফেলল ছেলেটি। ও ফের বলল,
‘আমার একটা পরীক্ষা নাও। দেখ, আমি কেমন অসাধারণ ফ্রি-কিক করতে পারি। আমি যে কোনো স্থান থেকে ফ্রি-কিক করব, বলটা গিয়ে রংধনুর মতো বাঁক নিয়ে গোলপোস্টে গিয়ে ঢুকবে। এছাড়া খেলতে গেলে দেখবে, আমি আরও কী করতে পারি। পরীক্ষা করে দেখ।’
‘আচ্ছা, তাহলে পরীক্ষা দাও, দেখি!’
বলল রূপম। ওরা ছেলেটিকে মাঠে নিয়ে গেল। মধ্যমাঠে বল রেখে রূপম বলল, ‘এখান থেকে ফ্রি-কিক মারো। দেখি গোলপোস্ট অবধি বল পাঠাতে পারো কী না।’ রূপমের কথা শুনে বিজন ছাড়া অপরাপর সকলে কলকলিয়ে হাসতে লাগল। ছেলেটি তাচ্ছিল্যের হাসি গায়ে মাখল না। ও বলটাতে একটা কিক মারল আর বলটা আকাশের দিকে একটু উঠে রংধনুর মতো বাঁক নিয়ে চলে গেল গোলপোস্টের ভেতর। বিস্ময়ের ধাক্কায় উপস্থিত সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ছেলেটির মুখে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন খুব সাধারণ একটা শর্ট ছিল- এমন ভাব ওর চোখে-মুখে। এরপর মধ্যমাঠ থেকে ও আরও পাঁচবার ফ্রি-কিক মারল এবং বল একইভাবে রংধনুর মতো গোলপোস্টে গিয়ে ঢুকল। মাঠের কর্নার থেকেও তিনবার বল মেরে গোলপোস্টের জালে পাঠাল ছেলেটি। এমন দৃশ্যে বিজয়পুর একাদশের খেলোয়াড়দের মুখে রা নেই। ওরা যতটা হতভম্ব হলো, এর চেয়ে বেশি হলো আনন্দিত। একজন জাদুকরি স্ট্রাইকার এত সহজে পেয়ে গেলে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই। মাঠে প্র্যাকটিস ম্যাচ শুরু হলো দুটি গ্রুপে। ছেলেটি যে গ্রুপে খেলল, ও নিজ গ্রুপের পক্ষে ১২টি গোল করে ফেলল। সবগুলো গোল অসাধারণ। প্র্যাকটিস ম্যাচ থামতে ছেলেটিকে রূপমসহ অপরাপর আবেগে জড়িয়ে ধরল। বিজন চিৎকার করে বলতে লাগল,
‘আমরা একজন ম্যারাডোনা পেয়েছি!’
কেউ বলল ‘পেলে’, কেউ বলল ‘মেসি’, কেউবা বলল, ‘রোনাল্ডো’। রূপম বলল,
‘ও হবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার’, বলে রাখছি আমি!
বিজনের মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো। ওর সঙ্গেই তো এই ছেলেটির প্রথম পরিচয়। ও ছেলেটিকে এনে দিতে পারায় কেমন গর্ব অনুভব করতে লাগল। কাল থেকে টুর্নামেন্ট শুরু হবে। ঠিক একদিন আগে এমন একজন স্ট্রাইকার খুঁজে পেল ওরা। বিজন মনে মনে বলল, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!’
হঠাৎ রূপমের মনে হলো ছেলেটির নাম জানা হয়নি। এটা মনে হতেই ভীষণ লজ্জিত হলো ও। ছেলেটিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘তোমার নাম কী, বন্ধু?’
‘কুমো।’
ছোট্ট জবাব। এমন প্রতিভাবান ছেলে ও জীবনেও দেখেনি। ছোট নাম, অথচ কাজে অতুলনীয় শিল্পের ছোঁয়া। রূপমের চোখের কোণ থেকে আনন্দ অশ্রু নেমে এলো।
এবার বিজয়পুরের ফুটবল টুর্নামেন্টের খবর কুমোর কারণে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল।
একইসঙ্গে শুরু হয়েছে বিজয়পুর একাদশের অপ্রতিরোধ্য সাফল্য গাঁথা। কুমো প্রথম খেলা থেকেই কখনও হ্যাটট্রিক, কখনও ডাবল হ্যাটট্রিক করে হৈচৈ ফেল দিল। আর ও যে ধরনের গোল করে ফেলল, তা নিয়ে আলোচনার যেন শেষ হচ্ছে না। দূরের গ্রাম থেকে শহর থেকে অবধি মানুষ ছুটে আসতে লাগল বিজয়পুরের ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখতে। প্রতিদিনই মানুষের ভিড় বাড়ছে। বিজয়পুর একাদশের খেলার দিন লোকে-লোকারণ্য হয়ে যাচ্ছে গ্রাম। এই দলের খেলার দিন স্থান পেতে শত শত মানুষ সকাল থেকে মাঠের আশপাশে অবস্থান নিতে থাকে। এত মানুষের চাপ সামলাতে গ্রামবাসী অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে। বিজয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাকিম আলীর বাড়ির আশপাশে অস্থায়ী তাঁবু টানানো হয়েছে অন্য গ্রাম থেকে আসা মানুষদের আশ্রয় দিতে। উপজেলা পরিষদের সরকারি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরাও চলে এলেন সেমিফাইনাল খেলা দেখতে। বিজয়পুর একাদশ আর গত তিন বছরের চ্যাম্পিয়ন ফুটবল দল গোগনগর ফুটবল ক্লাবের মধ্যে কাল ফাইনাল খেলা হবে। কাল জেলা প্রশাসক আসবেন ফাইনাল খেলার প্রধান অতিথি হয়ে। এবারই প্রথম বিজয়পুর গ্রামে জেলা প্রশাসক আসছেন। বিজয়পুর গ্রাম সরগরম। চারদিকে হৈহৈ, রৈরৈ ভাব। সকলের মুখে কুমো’র অতুলনীয় ফুটবলশৈলীর প্রশংসা। কুমোকে ‘গ্রামের গর্ব’ নামে একটা সনদপত্র তুলে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চেয়ারম্যান হাকিম আলী। গ্রামে কুমোর জন্য একটা দ্বিতল ভবনও তৈরি করে দেবেন তিনি নিজের অর্থে। কুমো একদিন জগৎ বিখ্যাত ফুটবলার হবে এবং এ-কারণে বিজয়পুরের নাম ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপীÑ এটা বিশ্বাস করেন চেয়ারম্যান। তিনি সত্যানন্দ ঘোষকে ডেকে পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন এমন একটি ছেলেকে আবিষ্কার করায়। সত্যানন্দ ঘোষকেও পুরস্কৃত করবেন তিনি। কুমোকে নিয়ে বুকের ছাতি অনেক বড় হয়ে গেছে বিজন, রূপমসহ ওদের টিমের সকল খেলোয়াড়ের। ফাইনাল ম্যাচের আগে ৯টি ম্যাচে কুমো ৪১টি গোল করেছে। বিজনের ধারণা কুমো চাইলে আরও গোল দিতে পারত। ফাইনাল ম্যাচে ওরা জিতবে, এটা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। গোগনগর ফুটবল একাদশের খেলোয়াড়, কোচ ও কর্মকর্তাদের মধ্যে পরাজয়ের ভয় বিরাজ করছে। ফাইনালে উঠলেও এবার গোগনগর গ্রামবাসীর মধ্যে উৎসব-উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে না। খেলার আগেই যেন তারা পরাজয়ের শোকের মধ্যে রয়েছে। বিজয়পুরের গ্রামবাসীরা উৎসবের আমেজে রয়েছে। আগামীকাল ইতিহাস রচিত হবে এই গ্রামে।
কিন্তু তারা কেউ জানে না, আজকের রাতটি কুমোর জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যরাতে হযবরল ভূত কুমোর সঙ্গে কথা বলল।
‘কুমো, ভোর হবার আগেই তোমাকে আমার সঙ্গে ভূতরাজ্যে ফিরতে হবে, জানো তো? আজ ৩০ দিন পূর্ণ হতে যাচ্ছে। পৃথিবীতে তোমার ভ্রমণ সময় শেষ।’
হযবরল ভূতের কথায় আঁতকে ওঠে কুমো। ও জানে, আজকের রাত ফুরাবার আগে ওকে চলে যেতে হবে। বিদায় জানাতে হবে বিজয়পুর, মানে পৃথিবীকে। কিন্তু ওর মনটা কেমন উচাটন করছে। কালকের ফাইনাল খেলাটার আগে যেতে মন চাইছে না। বিজয়পুরের ছেলেদের হাতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটা তুলে দিয়ে যেতে পারলে ভালো লাগত ওর। কোনো কাজ শুরু করে শেষ না করতে পারলে কেমন লাগে? কুমো বিষাদভরা কণ্ঠে বলে,
‘আরও একদিন থেকে যাবার কোনো পথ বের করা যায় না?’
‘না। কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ভূতরাজও চাচ্ছেন না তুমি আর পৃথিবীতে থাকো। ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। যা হবার হয়েছে। তুমি একটা বল নিতে পারবে, ভূতরাজ সম্মতি দিয়েছেন। এখন চলো, নিজের রাজ্যে।’
ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল কুমোর। এটা কেন হচ্ছে, জানে না ও। ভূতদের এমন অনুভূতি হয় না, অথচ ওর হচ্ছে। বিজয়পুর একাদশের ছেলেদের জন্য ও মায়া করছে। মানুষের মায়ায় ও জড়িয়ে পড়েছে। কী অদ্ভুত! হযবরল একটু মুচকি হাসল, এরপর বলল,
তুমি ঠিক করো, ভূতরাজ্যে ফিরে যাবে, না-কি বিজয়পুর একাদশের চ্যাম্পিয়ন ট্রফির জন্য পৃথিবীতে থেকে যাবে। মানুষের মায়া থেকে সাবধান থাকতে বলেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে, তুমি অজান্তেই মানুষের মায়ায় জড়িয়ে গেছ। আমি কোনো পরামর্শ দেব না। তোমার মন কী বলে, সেটা নিয়ে ভাব। সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে। কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। ভাবো। আমি তোমার পাশেই আছি। রাতের অন্ধকার না ফুরাতেই আমি চলে যাব। আমার সঙ্গে যেতে পারো, আবার থেকে যেতেও পার।
কথাগুলো বলে হযবরল ভূত অদৃশ হলো। কুমো ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল। কী সিদ্ধান্ত নেবে, ও বুঝতে পারছে না। থাকবে, না-কি চলে যাবে? এমন দোটানা সন্ধিক্ষণ কেন আসে? প্রশ্নটা নিজেকে নিজে বারবার করতে থাকে কুমো।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধগণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চাই
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেখা নয়াচীন
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য