সম্পাদকের কথা: টুঙ্গিপাড়ার অজপাড়া গাঁয়ের শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলো করে আজ থেকে শতবর্ষ আগে খোকা নামের যে শিশুটি এলো, জীবনের মধ্যাহ্নে সে বঙ্গবন্ধু। আর সূর্য হেলে পড়ার আগেই জাতির পিতা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি।
টুঙ্গিপাড়ার এই শেখ পরিবারের দুরন্ত ছেলেটি কেন, কী কারণে একটা জাতির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়কে পরিণত হলেন। এই জিজ্ঞাসা দেশ-বিদেশে। আমাদের উপমহাদেশের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ সাধারণভাবে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এলিট পরিবার থেকেই রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজপতি ও শিল্প-সাহিত্য জগতের বিশিষ্টজন বেরিয়ে আসেন। সে-জন্য, প্রায় কুসংস্কারের মতোই একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, ভালো পারিবারিক ঐতিহ্য ও পরিবেশ ছাড়া সে-পরিবারে কেউ ‘বড়’ হয়ে ওঠে না।
অথচ দৃশ্যত শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার কোনো এলিট পরিবার ছিল না। না কোনো জমিদার, না কোনো প্রতাপশালী সমাজপতি অথবা নাগরিক মধ্যবিত্ত, আইনজীবী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ীÑ এক কথায় কোনো তথাকথিত ধনাঢ্য পরিবারের ধনীর দুলাল ছিলেন না শেখ মুজিব।
যদিও শেখ লুৎফর রহমান সেরেস্তাদারের কাজ করতেন, তবু মূলত পরিবারটি ছিল সম্পন্ন কৃষক পরিবার। এলিটিসিজমের বিন্দুমাত্র ছিল না। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য এই পরিবারের ‘ঐতিহ্য’ই শিশু খোকা বা তরুণ শেখ মুজিবের মানস গঠন-চরিত্র গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দুটি ঘটনা স্পষ্ট করে বলেছেন। প্রথমত; তার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন ইংরেজবিরোধী। খুলনার কুঠিয়াল রাইন সাহেবের অত্যাচারের স্মৃতি শেখ পরিবার কোনোদিন ভুলতে পারেনি। শেখ মুজিবের কিশোর বয়সে মাদারীপুর বিপ্লবী পূর্ণ দাসের দলের সাথে তার সম্পর্ক অথবা তার গোপালগঞ্জের গৃহশিক্ষা স্বদেশী কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি মাস্টারের প্রবল প্রভাব ছিল তার ওপর। পরবর্তী জীবনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও নেতাজী সুভাষ বসুর প্রভাবের মূলেও রয়েছে একদিকে ইংরেজ-বিদ্বেষ, অন্যদিকে এই দুই নেতার অসাম্প্রদায়িক কর্মকা-, যা বঙ্গবন্ধুকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে।
শেখ মুজিব যে মুসলিম লীগের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং কলকাতার জীবনে সবাইকে ছাড়িয়ে মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে, তার মূলে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব বা সাম্প্রদায়িকতা তেমন কার্যকর ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমানের মানস গঠনে হিন্দু-বিদ্বেষ না, মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে জমিদারি প্রথার শোষণ-বঞ্চনা বিশেষত মুসলমান গরিব চাষি ও মধ্যবিত্তকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল, তারই প্রকাশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন সামন্ততন্ত্রবিরোধী আধুনিক লিবারেল গণতন্ত্রী। এ-কথা তো গোপন নয় যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভূত জমিদারি প্রথার সুবাদে অবিভক্ত বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশিরভাগ জমিদারির মালিক ছিল। বেঙ্গল জমিদার ও অ্যাসোসিয়েশনের প্রায় সব সদস্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। পূর্ব বাংলায় টাঙ্গাইল ও বগুড়াতে কয়েকঘর জমিদার ছিল মুসলমান।
জমিদারগণ হিন্দু-মুসলমান বেছে বেছে অত্যাচার করত না। সাধারণ হিন্দু প্রজাও মুসলমান প্রজার মতো শোষিত-বঞ্চিত হতো। কিন্তু বাংলার কৃষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল মুসলমান। তাই এমন যে, প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ তারাও জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারেরও ছোটখাটো জমিদারি ছিল। কিন্তু অষ্টাদশ-উনিশ শতকে এই জমিদারি ‘রাণী রাসমণি’র টার্গেটে পরিণত হয়। রাণী রাসমণিদের বিরুদ্ধে একের পর এক দীর্ঘদিন মামলা করতে গিয়ে শেখ পরিবার জমিজমা বিক্রি করে নিঃস্বে পরিণত হয়। মামলায় জিতেও কোনো লাভ হয়নি। এসব ঘটনা বঙ্গবন্ধুর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সামন্ততন্ত্রবিরোধী মানস গঠনে কার্যকর ছিল। আর ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাÑ যা গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ঘটেছে, সে-ঘটনা বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শগত বোধ ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনাকে শাণিত করেছে।
শেখ মুজিব জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। কলকাতায় থেকে তিনি পশ্চিমা অভিজাত মুসলমানদের বাঙালি-বিদ্বেষ যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে পশ্চিমা এলিট মুসলমানদের ঘৃণা ও বিদ্বেষই তাকে স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্রের চেতনায় উজ্জীবিত করেছে।
একেবারে তৃণমূল থেকে, মাটি থেকে গড়ে উঠেছেন বলেই শেখ মুজিব বাঙালির সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সবচেয়ে আপনজন হতে পেরেছিলেন। প্রকৃতই তিনি ছিলেন ইতিহাসের রাখাল রাজা। পূর্ণ প্রাণশক্তি ও কর্মশক্তি নিয়েই তিনি আত্মদান করেছেন। শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও বঙ্গবন্ধু আমাদের কাজে, চিন্তায় ও আত্মপরিচয়ে চিরজাগ্রত। তিনিই আমাদের পথ দেখাচ্ছেন। জন্মশতবর্ষে তিনি আরও শক্তিশালী এবং প্রবলভাবে বাঙালি জাতিকে শান্তি, মুক্তি ও ভেদ-বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ গড়তে, বাঙালিত্বের গৌরববোধকে সমুন্নত করতে এবং দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন।