Monday, October 2, 2023
বাড়িআরওএ ডটার’স টেল : বেদনার এক মহাকাব্য

এ ডটার’স টেল : বেদনার এক মহাকাব্য

মাসুদ পথিক:

তোমার মাঝে দেখেছি আমার মায়ের ছবি
তোমার ভেতর বাস করে স্বপ্নের এক কবি ॥
তোমার গভীরে বাজে সময়ের রঙিন বীণা
তুমি বাংলার মা- সবার প্রিয় শেখ হাসিনা।
দেশরতœ তুমি, তুমি মাতৃভূমি।

অদ্ভুত! বেদনার অন্তর্ঘাত। যেন ভেতরে নিহিত ছিল সব পাথরচাপা ব্যথা, আর শোকের অভূতপূর্ব বিলাপ। সঙ্গে অসহনীয় সহনশীলতার সৌকর্য। দেশরতœ শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার অন্তর্জগতের সন্ধান মেলে এই তথ্যচিত্রে ভিজ্যুয়ালের ভাঁজে ভাঁজে।
তাই দেশরতœ শেখ হাসিনা এতিমদের উদ্দেশ্যে এভাবে বলতে পারেন, ‘তোমরা যারা এতিম তাদের ব্যথা আমরা বুঝি। আমিও একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনি আমার বাবা-মা-ভাইসহ কেউ নেই। সে কারণে আমরা এতিমদের দুঃখ বুঝি। তোমরা যারা এতিম, তারা একা নও। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোমাদের পাশে আমি আছি।’
তিনি আরেক জায়গায় বলেন, ‘একটা জিনিসই শুধু চিন্তা করেছিÑ আমার বাবা দেশটা স্বাধীন করেছেন মানুষের জন্য, সেই সাধারণ মানুষের জীবনটা যেন সুন্দর হয়। সেজন্য নিজের জীবনের সব ব্যথা সবকিছু বুকে চেপে রেখে আমি দিনরাত কাজ করে চলেছি। শুধু একটা কারণেÑ আমি চাই দেশটা যেন এগিয়ে নিতে পারি। বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনকারী এ জাতি যেন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। আমি কারও প্রতি বিদ্বেষ নিয়ে চলি না বা প্রতিশোধ নিতেও যাইনি। যেখানে অন্যায় হয়েছে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছি।’
আমরা হয়তো পাহাড়ের মতোই দেখি শেখ হাসিনাকে, তিনি আজ প্রধানমন্ত্রী। দেশ চালাচ্ছেন মাতৃ-মমতায়, স্নেহে এবং শাসনে। কিন্তু পাহাড়ও দূর থেকে মসৃণ মনে হয়, ভেতরে ঠিক খানাখন্দ থাকে। তেমনি শেখ হাসিনার ভেতরেও জ্বলজ্বল করে শোক ও ব্যথার নিভৃত লাভা। অতীতের সংগ্রাম, পথে পথে পাথর মাড়িয়ে চলা এক সাহসী যাপিত কর্তব্যের অগ্রদূত।
এটা অবশ্য অভূতপূর্ব যে সবকিছু হারিয়ে অসহায় এক নারী কী করে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে নিজ ও দেশ-জাতিকে নিয়ে যেতে পারেন অনন্য উচ্চতায়Ñ তা ভাবলে সত্যিই হতবাক হতে হয়। যা এতদিন আমাদের কাছে ছিল অজানা-অকল্পনীয়; তা-ই জানা যায়, বঙ্গবন্ধু-কন্যার জীবনভিত্তিক ‘ডটার’স টেল’ জীবনচিত্রের মাধ্যমে। আমি যেমন মুগ্ধ, তেমনি বিস্মিতও।
এই সত্য দর্শকের অজানাই ছিল, যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, তার আগের রাতে বিদেশের মাটিতে বসে ক্যান্ডেল ডিনার পার্টি করছিলেন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। সেই আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই ১৫ আগস্টের ভয়াবহ খবর তাদের বাকরুদ্ধ করেছিল। আজও টেলিফোনের রিং কিংবা মোবাইলের রিংটোন শুনলেই বঙ্গবন্ধু-কন্যার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তাই আমরা বলতে পারি-

তুমি করো আদর বিছিয়ে স্নেহের চাদর
করো কঠিন হাতে শাসন তুমি প্রগতির আসন
তুমি বাংলার সফলতার গান
তোমার কৃতী হবে না, হবে না মøান
তুমি তো ভোরের রবি।

রিয়েলি, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবন যেন সত্যি এক সিনেমাÑ যার পুরোটাই বেদনামথিত আলোকরশ্মি। এমন চলচ্চিত্র সবার জন্য শিক্ষণীয়। গতানুগতিক রাজনীতির ভাবনার বাইরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জীবনের ঘটনা তুলে আনা হয়েছে। নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে সিনেমাটিক উপস্থাপনার বিষয়টা অনন্য। ছবিটির সর্বজনীনতাও আছে। দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য আবেদন সৃষ্টির মতো নির্মাণশৈলী আছে ছবিতে।
জাতির পিতার কন্যারা এখানে জীবনের গল্প বলেছেন, সংগ্রামের গল্প বলেছেন। দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহসী গল্পও বলা হয়েছে। ছবিটা শুধু দুজন মানুষের গল্প নয়, এ যেন অন্ধকার কেটে আলোয় ফেরা বাংলাদেশের কর্ষিত মাটির কথা। এটা আগামী প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস।
‘তথ্যচিত্রটি দেখে তরুণ প্রজন্ম নতুনভাবে চিনবে তার দেশ-জাতি ও নেতৃত্বকে। যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বা ওই সময়ে জন্মই হয়নি। অনেক কিছু দেখাই হয়নি। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে এই প্রজন্ম অনেক কিছু শিখেছে ও শিখবে। কেননা অনেক ইতিহাস উঠে এসেছে তথ্যচিত্রের ঘটনা পরম্পরায়। সুন্দর এক উপস্থাপন।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা, হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের সংকটকাল ও নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসার কাহিনি তুলে আনা হয়েছে বিশদভাবে। রাজনৈতিক আদর্শের বাইরে শেখ হাসিনার শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত টুঙ্গিপাড়া থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে কাটানো দিনলিপিও উঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে। এতে অকপট সরলতায় স্মৃতিচারণ করেছেন দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
নির্মাণের সার্থকতা এখানেই যে, দর্শককে ঘটনার সঙ্গে আত্মিকভাবে মিলিত করা হয়েছে বিশেষ মনোযোগে। প্রধানমন্ত্রীর আটপৌরে ও সাদাসিধে জীবনবোধ, জন্মভূমির প্রতি দায়বদ্ধতা আর সরকারে থেকেও সহজ সাবলীল জীবনাচার চলচ্চিত্রের গভীরতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, এনে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। সবই ঘটনা পরম্পরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-দর্শনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন-দর্শনের একটি সাজুয্যও আবিষ্কার করা যায়, চলচ্চিত্রটির মধ্য দিয়ে। তার মমত্ব সম্পর্কে অনেকেই জানেন; কিন্তু দুই বোন টুঙ্গিপাড়া তাদের শেকড়টিকে যে এত গভীরভাবে লালন করেন, তা প্রথম জানা গেল।
তো, ডকুড্রামার বিষয়টিই ইতিহাসের এক আকর, এখানে নির্মাণ বড় বিবেচ্য নয়। যদি অতিরিক্ত রং, অতিরঞ্জিত বক্তব্য দিয়ে কিছু করতে চাইতেন হয়তো তা এমন সাবলীল ও গ্রহণযোগ্য থাকত না। পুরোপুরি স্বাধীন একটি জায়গা থেকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর দুই কন্যার স্মৃতিকথাকেই আকর হিসেবে নেওয়ার কারণে কাজটি হয়েছে পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত।
অর্থাৎ ‘ডটার’স টেল’ কোনোভাবেই ব্যক্তির ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র নয়, মূলত ইতিহাসের ঘটনার পারম্পর্য। এর সঙ্গে যথোপযুক্ত সুর, কিছু শব্দের খেলা আর আবহসংগীতে দর্শক ছবির উপস্থিত বিষয়কে যতটা ধরতে পেরেছে ততটাই গভীরভাবে একাত্ম হতে পেরেছে। চলচ্চিত্রে যে দৃশ্যপটগুলো নেই, সেগুলোর সঙ্গেও। সবাই যেন আলোচ্য সময়ের ভেতর দিয়েই চলতে পেরেছে। ঘটনার বাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই নির্মাণকে বেশ দক্ষতাপূর্ণ বলা যাবে।
প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) ও অ্যাপেলবক্স ফিল্মসের যৌথ প্রযোজনায়। ক্যামেরায় ছিলেন সাদিক আহমেদ। নির্মাণে আছেন পিপলু খান। ৭০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার সারা জীবনের অসাধারণ কিছু মুহূর্ত আছে। যেসব মুহূর্তে তাকে পাওয়া যায় কখনো কন্যা, বোন, মা; কখনো জননেত্রী হিসেবে কখনো সাধারণ মানুষ হয়ে উঠে এসেছেন। অদ্ভুতভাবেই কন্যা, মা এবং একজন দেশপ্রেমিকের সত্য ও অনুভূতিকে ভিজ্যুয়ালাইজড করতে পেরেছে।
তথাপি বলাই যায়, এ ডটার’স টেল এক বেদনার ভিজ্যুয়াল গীতিকাব্য। আবার এভাবেও তাকে বলা যায় :

তুমিই আজ বঙ্গবন্ধু
উন্নয়নের সকল বিন্দু
বিজয় নাচে তোমাকে ঘিরে
চেতনার নদীর তীরে
জাতির পিতার স্বপ্ন চলেছে বয়ে
তুমি জনতাকে করেছো ধারণ
সকল যাতনাকে সয়ে
ওগো, মাতা মৃত্যুঞ্জয়ী
দুনিয়াতে আর কেউ নাই
তোমার মতো কান্নার কবি।

লেখক : কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য