সাইদ আহমেদ বাবু: ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে আলফ্রেড নোবেল নিজের মোট উপার্জনের ৯৪ শতাংশ (৩ কোটি সুইডিশ ক্রোনার) দিয়ে তার উইলের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন। এই বিপুল অর্থ দিয়েই শুরু হয় পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান। ১৯৬৮-তে তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি। পুরস্কার ঘোষণার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। আইনসভার অনুমোদন শেষে তার উইল অনুযায়ী নোবেল ফাউন্ডেশন গঠিত হয়। তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় আলফ্রেড নোবেলের রেখে যাওয়া অর্থের সার্বিক তত্ত্বাবধান করা এবং নোবেল পুরস্কারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা। বিজয়ী নির্বাচনের দায়িত্ব সুইডিশ একাডেমি আর নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে ভাগ করে দেওয়া হয়।
শান্তিতে নোবেল
এ-বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার গেল আফ্রিকায়। প্রতিবেশী রাজ্য ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সীমান্ত সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে তার অবদান ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলী। নরওয়ের নোবেল কমিটি এক সংবাদ সম্মেলনে শততম নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিজয়ী হিসেবে আবির নাম ঘোষণা করে। শান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ইথিওপিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি এই পুরস্কার পেলেন। পুরস্কার বাবদ একটি সোনার মেডেল ও ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার (১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার) পাবেন আবি আহমেদ।
১৯৯৩ সালে ইরিত্রিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইথিওপিয়া থেকে। কিন্তু ইরিত্রিয়ার সীমান্তবর্তী বাদমে অঞ্চলের দখল নিয়ে ২০ বছর ধরে ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ার মধ্যে সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ। সীমান্ত রেখা সংলগ্ন বাদমে, টসোরোনার মতো বিতর্কিত এলাকার দখল নিতে ১৯৯৮ সালের মে মাস থেকে ২০০০ সালের জুন মাস পর্যন্ত সীমান্ত সংঘর্ষ চলে ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়ার। দুই দশক ধরে চলা ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়ার ‘যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার’ সমাপ্তি যার হাত ধরে হয়, আজ তাকেই ‘শান্তির দূত’ হিসেবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করলো নোবেল কমিটি। তিনি ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলি। বারবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ গেছে দু-পক্ষেরই ৭০ হাজারের বেশি মানুষের। ক্রমেই মেরুদণ্ড ভেঙেছে দুদেশের অর্থনীতির।
আবি আহমেদকে পুরস্কার দেওয়ার কারণ হিসেবে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি বলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিশেষত, প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সীমান্ত সংঘাত বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ায় তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আবির নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় দেশকে গর্বিত করেছে বলে জানিয়েছে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। খুশি ইরিত্রিয়াসহ সারা আফ্রিকাও।
নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রিস-অ্যান্ডারসেন বলেন, পাশাপাশি আবি আহমেদ সুদান, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায়ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ভূমিকা রেখে চলছেন। এই পুরস্কার শুধু আবির একার নয়; বরং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ইথিওপিয়ায় বাকি কর্তাব্যক্তিদেরও।
সাহিত্যে নোবেল
সাহিত্যে ২০১৯ ও ২০১৮ সালের নোবেল ঘোষণা করা হয়েছে। সাহিত্যে এক বছরে দুজন প্রাপকের নাম ঘোষণার ঘটনা গত ৭৫ বছরে ঘটেনি। মানুষের ভাষাগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য এ-বছর বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন অস্ট্রিয়ান উপন্যাসিক, নাট্যকার ও অনুবাদক পিটার হ্যান্ড। সাহিত্যে অবদানের জন্য এর আগে পিটার হ্যান্ডকে ফ্রাঞ্জ কাফকা পুরস্কার, আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, ইন্টারন্যাশনাল ইবসেন অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন বাণিজ্যিকভাবে বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে সফল লেখক কাল্পনিক বিজ্ঞানের কাহিনি লিখে সবার মন জয় করার জন্য খ্যাত পোলিশ লেখক ওলগা তোকারসুক। জন্ম ১৯৬২ সালে। ২০১৮ সালে তার সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ম্যান বুকার প্রাইজ জয়ের পর এ-বছর নোবেল পুরস্কারও জিতে নিলেন এই নারী সাহিত্যিক। এর আগে ১৪ জন নারী সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। প্রয়াত টনি মরিসন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯০১ সাল থেকে সাহিত্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার দিয়ে আসছে সুইডিশ একাডেমি। উভয় বিজয়ী পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসাবে ৮০ লাখ করে ক্রোনার পাবেন।
গত বছর নোবেল কমিটির এক সদস্যের স্বামী ও জনপ্রিয় আলোকচিত্রী জ্যঁ ক্লদ আর্নোর বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনা হয়। পরে ওই ঘটনায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। যৌন কেলেঙ্কারির পাশাপাশি বিজয়ীর নাম ফাঁস করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিতর্কের মুখে স্থগিত করা হয় ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল প্রদান। এর আগে দ্বিতীয় ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এই বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তবে সেগুলো বাতিলের পেছনে কারণ ছিল তখনকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাত।
৫৭ বছর বয়েসি লেখিকা তোকারসুক সাহিত্যের জগতে পা রাখেন কবিতার হাত ধরে। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সিটিজ অব মিররস’। ১৯৯৩ সালে তোকারসুকের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জার্নি অব দ্য বুক পিপল’ প্রকাশিত হয়। সতেরো শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসের আখ্যান এক প্রেমিক দম্পতির একটি হারিয়ে যাওয়া বই অন্বেষণ নিয়ে গড়ে ওঠে।
২০১৯ সালের নোবেলজয়ী লেখক পিটার হ্যান্ডকের জন্ম সোভিয়েত অধিকৃত বার্লিনে, ১৯৪২ সালে। ১৯৬৫ সালে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, যোগ দেন আভা গার্দ আন্দোলনে। শুরু হয় ছবির চিত্রনাট্য লেখা। ১৯৭৮ সালে তার নির্দেশনায় তৈরি ছবি ‘দ্য লেফট হ্যান্ডেড ওম্যান’ সে-বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে মনোনীত হয়। যুগোস্লভিয়া যুদ্ধের সমালোচনা করে তার লেখা পৃথিবীতে সমালোচনার ঝড় তোলে। যুদ্ধের কারণ ও ফল বিষয়ে বারবার পশ্চিমী দুনিয়াকে বিঁধে এসেছেন পিটার। বিতর্ক তার চিরসঙ্গী হয়ে থেকেছে।
রসায়নে নোবেল
রিচার্জেবল ব্যাটারি উদ্ভাবন করে রসায়নবিদ্যায় যৌথভাবে ২০১৯ সালের নোবেল পেয়েছেন জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের তিন বিজ্ঞানী। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরি এবং সেটি রিচার্জ করা সম্ভব- এমন যুগান্তকারী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে রসায়নবিদ জন বি গুডইনাফ, এম স্ট্যানলি হুইটিংহ্যাম এবং আকিরা ইয়োশিনো এই পুরস্কার পান।
রসায়নে এ-বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অধ্যাপক জন বি গুডএনাফ (৯৭) এখন সবচেয়ে বয়স্ক নোবেল বিজয়ীর খেতাব পেলেন। পুরস্কার হিসেবে নোবেল বিজয়ীরা পাবেন প্রায় ১১ লাখ মার্কিন ডলার। বিংহ্যামটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম এবং জাপানের মিজো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আকিরা ইয়োশিনো। শক্তির উৎস হিসেবে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির আবির্ভাব ১৯৭০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রে তখন জ্বালানি তেলের ভীষণ সংকট। তেলের দাম বাড়ছিল রকেটগতিতে। উন্নত বিশ্বে যা হয়- অভাব থেকে উদ্ভাবন। সেটাই হয়েছিল আমেরিকায়। তেলের অভাবে শুরু হয় বিকল্প শক্তির সন্ধান। গত কয়েক দশকে প্রযুক্তিবিশ্বে শক্তির বিপ্লব এনেছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। এই তিন বিজ্ঞানী এর পেছনের কারিগর। তাদের অনায়াসে তিন শক্তিমানও বলা চলে। মুঠোফোন, ক্যামেরা, ল্যাপটপ থেকে শুরু পেসমেকারের মতো প্রযুক্তিপণ্য হাতের নাগালে এসেছে তাদের গবেষণার কল্যাণে। ছোটখাটো পণ্যই কেবল নয়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি দিয়ে গাড়ি এমনকি পুরো বাড়িও চলছে।
আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি বনি কারপেনটিয়ার বলেছেন, ‘রসায়নও যে মানুষের জীবনযাপনে রূপান্তরিত হতে পারে, তার অনন্য উদাহরণ হলো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। গুডএনাফের কল্পনার বাইরে চলে গেছে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। ভবিষ্যতে শক্তির উৎস হিসেবে এর ব্যবহার হবে বহুমাত্রিক। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তির আধারে রাখবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ক্যালিফোর্নিয়া সোলার অ্যান্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পরিচালক বার্নাদেতে দেল চিয়ারো তো বলেই দিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতের নবায়নযোগ্য শক্তিতে লিথিয়াম-আয়ন প্রযুক্তি এমন ভূমিকা রাখবে, যা আমাদের ধারণারও বাইরে।’ ২০১৭ সালে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চেয়ে ৩ গুণ শক্তিশালী ব্যাটারির ধারণা দিয়েছেন গুডএনাফ। নতুন এই ব্যাটারি না-কি দ্রুত চার্জড হবে, টিকবেও বেশি দিন। লিথিয়াম-আয়নের মতো এতে কোনো তরল উপাদান ব্যবহার করা হবে না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই ব্যাটারি দাহ্য নয়, মানে আগুনে পুড়বে না। ব্যাটারিগুলো দামেও হবে সস্তা। নতুন ব্যাটারি এলেও লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির কথা মানুষ মনে রাখবে সব সময়। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে রাখবে তিন শক্তিমান- গুডএনাফ, হুইটিংগাম এবং ইয়োশিনোকে। এই তিন শক্তিমান শক্তি প্রয়োগ করেননি, শক্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন, জীবন হয়েছে সহজ। ভবিষ্যতের ব্যাটারি যে আরও চমকপ্রদ হবে, তা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, লিথিয়াম-আয়ন প্রযুক্তির কিছু সমস্যাও আছে। লিথিয়ামের চাহিদা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ব্যাটারিগুলো পুনরায় ব্যবহার বা ধ্বংস করাও ব্যয়বহুল।
অর্থনীতির নোবেল
বৈশ্বিক দারিদ্র্যতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখায় এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমার এর সঙ্গে অর্থনীতিতে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। অমর্ত্য সেনের পরে দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সম্মানে ভূষিত হলেন অভিজিৎ বিনায়ক। একই সঙ্গে নোবেল সম্মান পেলেন তার স্ত্রী এস্থার ডাফলোও। এস্থার অর্থনীতিতে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেল প্রাপক। বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন তিনি। আর অন্যজন হলেন মাইকেল ক্রেমার। হার্ভার্ডের অর্থনীতি বিভাগে গেটস প্রফেসর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের ফেলো। ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামের ইয়াং গ্লোবাল লিডারও মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।
নোবেল কমিটি অভিজিৎদের গবেষণা সম্পর্কে দু-এক কথা বলতে গিয়ে জানায়, দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে গবেষণার জন্যই পুরস্কার দেওয়া হলো এই ত্রয়ীকে। মাত্র দু-দশকে ওদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল। অভিজিৎ বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধীনে ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর অর্থনীতি বিভাগে আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তার কাজের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনীতিতে উন্নয়ন। তিনি ২০০৪ সালে আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের ফেলো নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৯ সালে অর্থনীতির সামাজিক বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে ইনফোসিস পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ সালে অভিজিৎ এবং এস্থার ডাফলো যুগ্মভাবে ‘আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি অ্যাকশান ল্যাব’ গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বের দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণার জন্য। তাদের পরীক্ষামূলক গবেষণাকেই সম্মান জানাচ্ছে নোবেল কমিটি।
১৯৬১ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম অভিজিৎ বিনায়কের। তিনি প্রাথমিক পড়াশোনা সারেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন অভিজিৎ। সেই বছরই স্নাতকোত্তর পড়তে চলে যান জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘ইনফরমেশন ইকোনোমিক্স’। জাতিসংঘের ২০১৫-পরবর্তী উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন মহাসচিবের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা। এ-সময়ে গবেষণাপত্র, বিভিন্ন জার্নালে লেখার পাশাপাশি অভিজিৎ লিখে গেছেন একের পর এক বই। তার মধ্যে অর্থনীতি বিষয়ে অভিজিতের লেখা ৪টি বই বিশ্বজুড়ে বিপুলভাবে সমাদৃত। তার ‘পুওর ইকোনমিক্স’ বইটি তো গোল্ডম্যান স্যাক্স বিজনেস বুক সম্মানে ভূষিতও হয়। একইসঙ্গে দুটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেন অভিজিৎ। অন্য নোবেল প্রাপক এস্থারের জন্ম ১৯৭২ সালে প্যারিসে। অভিজিতের স্ত্রী এস্থার ডাফলোর গবেষণাও এমআইটি থেকে। এস্থারের গবেষণার বিষয় ছিল, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক নীতি নির্ধারণ’। দীর্ঘদিন সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন অভিজিৎ-এস্থার।
বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রেসিডেন্সির অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ও অধ্যাপক। আর তার মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা-এর অর্থনীতি বিভাগের একজন অধ্যাপক। আশির দশকে বাবার কলেজেই অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন অভিজিৎ। ‘পুওর ইকোনমিক্স’ বইয়ের জন্য এস্থার ডাফলো ও অভিজিৎ যৌথভাবে জেরাল্ড লয়েব অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ২০১৩ সালে তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন কর্তৃক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিশেষজ্ঞ প্যানেলে কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পরের বছর কিইল ইনস্টিটিউট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড ইকোনমি থেকে বার্নহার্ড-হামস পুরস্কার পান।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল
অক্সিজেনের উপস্থিতি পাওয়ার পর মানবদেহের কোষ কীভাবে সাড়া দেয়, সেই বিষয় নিয়ে যুগান্তরকরী গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তারা ২০১৯ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন গবেষক। তারা হলেনÑ উইলিয়াম জি. কেইলেন, স্যার পেটার জে রেটক্লিফ ও গ্রেগ এল সেমনেজা। তাদের মধ্যে কেইলেন ও সেমনেজা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আর রেটক্লিফ যুক্তরাজ্যের। এবার নোবেল পুরস্কারের ৯০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার ভাগ করে নেবেন তারা। আগামী ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাদের অবদানের কথা উল্লেখ করে নোবেল কমিটি বিবৃতিতে বলে, একটি প্রচলিত বিষয় আমরা জানি বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহ হঠাৎ বেড়ে বা কমে গেলে কোষ কি করে তা খাপ খাওয়ায় তা ছিল কিছুটা রহস্যজনক। কমিটির মতে, এই তিন বিজ্ঞানী এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে অতি উচ্চতায় অবস্থান পরিস্থিতি এমনকি ক্যানসার চিকিৎসা এ-বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। চিকিৎসায় নোবেল ঘোষণাকারী ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট জানায়, ফিজিওলজির (শারীরবৃত্ত) ক্ষেত্রে তিনজনের এই আবিষ্কারের মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে এবং ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, তারা শরীরের ভারসাম্যের একটি অনিবার্য প্রক্রিয়ার রহস্য ভেদ করেছেন। যার মাধ্যমে রক্তশূন্যতা, ক্যানসার ও আরও অনেক রোগের চিকিৎসায় নতুন কৌশলের দ্বার উন্মোচন হবে। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক উইলিয়াম কাইলিন। গ্রেগ সেমেনজা তিনি জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক। স্যার পিটার জন র্যাটক্লিফ ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল রিসার্চ ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত।
পদার্থে নোবেল
মহাকাশ নিয়ে গবেষণায় অবদান রাখায় চলতি বছর পদার্থবিজ্ঞানে তিনজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেলেন। ফিজিক্যাল কসমোলোজি বিষয়ে গবেষণায় এই পুরস্কার পান জেমস পিবলস এবং সূর্যের মতো নক্ষত্রকে পরিভ্রমণরত এক্সোপ্লানেটের আবিষ্কারের জন্য এই পুরস্কার পেয়েছেন মাইকেল মেয়র এবং দিদিয়ের কুলোজ। তাদের সম্মানী হিসেবে ১১ লাখ মার্কিন ডলারও দেওয়া হবে। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস এই তিন বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে। পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন সৃষ্টিতত্ত্ব বিজ্ঞানী প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ‘অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর’ জেমস পিবলস এবং জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল মেয়র ও দিদিয়ের কুলোজ। ১৯৯৫-এ অক্টোবরের এক রাতে দুই বিজ্ঞানি দেখতে পান, সূর্য থেকে প্রায় ৫০ আলোকবর্ষ দূরে একটি তারাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে গ্যাসের বলের মতো বস্তু। আয়তনে বৃহস্পতি গ্রহের মতো। পদার্থ বিজ্ঞানের ‘ডপলার এফেক্ট’-এ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বা আলোর রং বদল থেকে বোঝা যায় এর উৎস কাছে আসছে বা দূরে যাচ্ছে। সেই ‘ডপলার এফেক্ট’কে কাজে লাগিয়ে মাইকেল মেয়র ও দিদিয়ে কুলোজ দেখেন, গ্যাসপিণ্ডটি একটি তারাকে পরিক্রমা করছে। সৌরজগতের বাইরে সেই প্রথম গ্রহের সন্ধান মিলল। নাম রাখা হলো ‘ফিফটি ওয়ান প্যাগেসাস বি’। নোবেল জুরিদের মতে, এটা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করতে গিয়ে রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সাইন্সেসের মহাসচিব অধ্যাপক গোরান হানসন বলেন, বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই চিরতরে বদলে দিয়েছেন এই তিনজন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভিতে দাঁড়িয়ে পিবলস অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, বিগ ব্যাং-এর পরে যে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল, তার তাপমাত্রা ও পদার্থের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্কটি কেমন। পিবলসের তত্ত্ব থেকেই আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের এই মহাবিশ্বে বস্তুর পরিমাণ সামান্যই। মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশই ‘ডার্ক ম্যাটার’ ও ‘ডার্ক এনার্জি’। নোবেলপ্রাপ্তির পরে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ‘অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্রফেসর’ পিবলস বলেছেন, তত্ত্বটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। তবে আমাদের স্বীকার করতে হচ্ছে, এই আঁধার বস্তু বা আঁধার শক্তি আসলে কী ও কেমন, তা এখনও রহস্যে মোড়া। ৮৪ বছর বয়সি এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, পুরস্কার পাওয়া সত্যি মধুর। নবীনদেরও উচিত বিজ্ঞানকে ভালোবেসে এর চর্চায় আসা।
৭৭ বছর বয়সি মাইকেল মেয়র ও ৫৩ বছর বয়সি দিদিয়ের কুলোজ, দুজনেই জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কুলোজ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। নোবেলপ্রাপ্তির খবর পেয়ে তারা দুজন এক বিবৃতিতে বলেন, এক কথায় অসাধারণ ব্যাপার। আমাদের কর্মজীবনে সবচেয়ে উত্তেজনাময় ছিল ওই আবিষ্কারটি। ‘বিগ ব্যাং’ তথা মহাবিস্ফোরণের পরে কীভাবে এই বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে, তা বুঝতে বিশেষ সাহায্য করেছে পিবলসের আবিষ্কৃত তত্ত্ব। তাই তিনি পাবেন নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্যের অর্ধেক। ১৯৯৫ সালে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান দেওয়ার জন্য বাকি অর্ধেক ভাগ করে নেবেন মেয়র ও কুলোজ।