উত্তরণ প্রতিবেদন: বিশ্বের আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নিজস্ব স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর এবার প্রথম এক্সপ্রেসওয়ের যুগেও পদার্পণ করল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে গত ১২ মার্চ খুলে দেওয়া হলো ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত আন্তর্জাতিকমানের দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। বাংলাদেশের অসামান্য অগ্রগতির সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি সাফল্যের পালক। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার এক ধাপ পূরণ হলো। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হলে এই এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত হবে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পথ।
আনুষ্ঠানিকভাবে এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনকালে এটিকে জাতির জন্য মুজিববর্ষের অনন্য উপহার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প পদ্মাসেতু হলে তার সর্বোচ্চ সুবিধা যাতে দেশের মানুষ পায়, সেজন্য আধুনিক মহাসড়কের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সকল মানুষের যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো।
গত ১২ মার্চ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এ-ধরনের বড় বড় প্রকল্প আমাদের বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করবে, এ-ধরনের আধুনিক সড়কপথ নির্মাণ হওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার চিত্রও পাল্টে যাবে। এখন থেকে খুব দ্রুত টুঙ্গিপাড়া যেতে পারব। এ-মাসেই আমি টুঙ্গিপাড়া যাব। তখন এক্সপ্রেসওয়ে দেখা যাবে। পদ্মাসেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমরা শুধু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ খ-নই করিনি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে যাচ্ছি। আমরা নিজেরা করতে পারি, এই একটা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সারাবিশ্বে সকলের কাছে একটা সম্মান পেয়েছে।
পদ্মাসেতুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতুটাও কিন্তু একটা ভিন্নধর্মী সেতু। দেশে এই প্রথম দোতলা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। এই সেতুর নিচ দিয়ে ট্রেনলাইন থাকবে আর ওপর দিয়ে গাড়ি যাবে। পদ্মা নদীর মতো একটা খরস্রোতা নদীতে কাজ করা খুবই দুরূহ ব্যাপার এবং এর নির্মাণকাজটা করা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করছি। আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এ-ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারি; এ বিশ্বাস আমাদের আছে এবং তা প্রমাণ করে দেখানো হলো।
তিনি বলেন, শুধু সড়কপথ নয়, নৌপথ, রেল এবং সেই সঙ্গে আকাশপথÑ সব দিকেই আমাদের লক্ষ আছে। আমরা সমস্ত বাংলাদেশে যোগাযোগ-ব্যবস্থার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিচ্ছি, যা মানুষকে আরও উন্নয়নের সুযোগ দেবে, জীবনমান উন্নত করার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নতি করা। যোগাযোগ-ব্যবস্থা যদি ভালো হয় একটা দেশের বা অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু হয়ে যায়।
কিছুদিন পরই পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হয়ে যাবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যে করতে পারি, পদ্মাসেতুর মতো একটা অবকাঠামোই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে দেবে। সারাবিশ্বে এই সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের লোক যাতায়াত করতে পারবে। এছাড়া আমিও টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারব খুব দ্রুত। এক্সপ্রেসওয়ে এবং পদ্মাসেতু দুটোই আমাদের নতুন চমক, এই এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো ট্রাফিক সিগনাল থাকবে না। একটানা গাড়ি চলে যেতে পারবে। আশপাশের এলাকার মানুষের জন্য দুই সাইডে আলাদা রোড করে দিয়েছি। তাদের আর হাইওয়েতে আসতে হবে না।
সরকারে থেকে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাংলাদেশটাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ছিল। যখন তিনি এদেশ স্বাধীন করেন তখন এদেশের ৮২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। এমনও ছিল অনেক মানুষ যারা একবেলা খাবারও জোটাতে পারত না। পাশাপাশি ঘর নেই, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। রোগে চিকিৎসা পেত না। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে তখনকার অবস্থা যেমন জানা যায় এবং তিনি যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন, নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তার চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি সবসময় চেয়েছিলেন, বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। আজকে আমাদের ওপর সেই দায়িত্ব পড়েছে। যে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নতি করা। যোগাযোগ-ব্যবস্থা যদি ভালো হয় একটা অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আমরা ছিলাম সব থেকে অবহেলিত। এই ভাঙ্গা পর্যন্ত যেতে হলে এক সময় স্টিমার বা লঞ্চে যেতে হতো। আর গোপালগঞ্জ যেতে গেলে ২৪ ঘণ্টা লাগত স্টিমারে যেতে। লঞ্চ হলে আরও বেশি সময় লাগত। এমনকি ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফিরে আসি তখনও এই অবস্থা ছিল। আজকে আর সেদিন নেই। আমরা ’৯৬ সালে সরকারে আসার পর থেকে পুরো বাংলাদেশে কীভাবে যোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত করা যায়, ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছি। আর দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে এ পর্যন্ত সরকারে থেকে আমরা আমাদের পরিকল্পনামাফিক সমগ্র বাংলাদেশে এই যোগাযোগ-ব্যবস্থা উন্নত করে দিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা নদীর মতো একটা খরস্রোতা নদীতে এ জাতীয় সেতু নির্মাণ করাÑ এটা একটা বিরাট ঝুঁকির ব্যাপার এবং চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করছি। আমরা যে নিজস্ব অর্থায়নেও আমাদের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারি, এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের আছে এবং তার ফলে আমরা এটা নির্মাণ করছি। তিনি বলেন, এখানে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হতে-না-হতেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আমাদের ওপর দোষারোপ করেছিল দুর্নীতির। আমি সেখানে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, এখানে দুর্নীতি হয়নি। আমাদের অনেকেই এখানে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে, এখানে দুর্নীতি হয়েছে। এটা নিয়ে মামলাও হয়। কানাডার কোর্টে যে মামলা হয়, সেখানেও প্রমাণিত হয় এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের সমস্ত অভিযোগ, এটা ছিল বানোয়াট। কিন্তু এটা আমাদের জন্য একটা সম্মানের ব্যাপার ছিল। কারণ আমি, আমার ছোট বোন, আমাদের পরিবার। আমরা তো সব হারিয়েছি। বাবা-মা, ভাই সব হারিয়ে আমরা দুজন নিঃস্ব। আমাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, উন্নত করা, জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাÑ এটাই আমাদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এ-ধরনের একটা অভিযোগ যখন নিয়ে আসে, এটা আমাদেরকে চরমভাবে অসম্মান করা হয়েছিল। তাই এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি এবং আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, তখন তারা সকলে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছে।
উদ্বোধন ঘোষণা শেষে প্রধানমন্ত্রী বরিশাল, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে সংযুক্ত হয়ে মতবিনিময় করেন। প্রকল্পগুলোর উদ্বোধন শেষে দোয়া মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি এবং সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম প্রকল্প বিষয়ে তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন।
ভ্রমণের সময় কমানোর পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জনগণের জন্য আরামদায়ক ও নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে মুজিববর্ষের প্রাক্কালে বাংলাদেশ যোগাযোগক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। আন্তর্জাতিকমানের এই এক্সপ্রেসওয়ে দুটি সার্ভিস লেনের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীকে যুক্ত করবে। এখন মাত্র ২৭ মিনিটে ঢাকা থেকে মাওয়ায় যাওয়া যাবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ সড়ক জোনে নির্মিত ২৫টি সেতু এবং তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ (সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় ছয়-লেনবিশিষ্ট ৮ কিলোমিটার তৃতীয় কর্ণফুলী (শাহ আমানত সেতু) সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক উদ্বোধন করেন।
প্রকল্পের বিবরণ অনুসারে, এক্সপ্রেসওয়েতে ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস এবং প্রায় ১০০টি সেতু এবং কালভার্ট রয়েছে, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়িয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। এটিতে মাওয়া থেকে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এবং ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাচ্চর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে পুরো খুলনা ও বরিশাল বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের একটি অংশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকা শহর এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ জোরদার করবে। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ছয় জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২টি জেলার মানুষ সরাসরি এই আন্তর্জাতিকমানের এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উপকৃত হবেন।
এই হাইওয়েতে আগামী ২০ বছরের জন্য ক্রমবর্ধমান ট্র্যাফিকের পরিমাণ বিবেচনা করে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে প্রায় ১১০০৩ দশমিক ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মিত হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যৌথভাবে ২০১৬ সালে ৪টি জেলাÑ ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর এবং ফরিদপুরে এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করে এবং এটি নির্ধারিত সময়সীমার তিন মাস আগে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।