Sunday, September 24, 2023
বাড়িSlider‘একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো’

‘একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে ইতিহাসের ঘৃণ্য ঘাতকচক্রের গুলিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের খবর প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেসব খবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- সম্পর্কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া ‘উত্তরণ’ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন- রায়হান কবির

> বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে খবর প্রকাশ করে বিবিসি বলে, ‘শেখ মুজিব নিহত হলেন তাঁর নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে। অথচ তাঁকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে।’
> ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না।’
> ভারতীয় বেতার ‘আকাশ বাণী’ ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে, ‘যিশু মারা গেছেন। এখন লাখ লাখ লোক ক্রস ধারণ করে তাঁকে স্মরণ করছেন। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’
> একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকা-কে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
> নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
> দ্যা গার্ডিয়ানে লেখা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব।’
> ১৭ আগস্ট কলকাতার প্রভাবশালী আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম ছিলÑ ‘বন্ধুর মৃত্যুতে ভারত শোকাহত’।
> ২৮ আগস্ট লন্ডনের দ্যা লিসনার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনগণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক এবং তার কবরস্থান পুণ্যতীর্থে পরিণত হবে।’
> ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট তার নয়াদিল্লি প্রতিনিধির লেখা প্রতিবেদন ছাপালো। সেখানে লেখা ছিল, ‘একটি সেনা সমর্থিত সরকার মধ্যরাতে পরিচালিত এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছে। মনে করা হচ্ছে, সরকারটি ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষের।’ ওয়াশিংটন পোস্টের ওই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুকে বামপন্থি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে ধরা হয়। সরাসরিই লেখা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুতির ওই বিদ্রোহ প্রায় স্বৈর-ক্ষমতার পর্যায়ে চলে যাওয়া এবং দারিদ্র্যপীড়িত দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের জনক বামপন্থি রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।’
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রিকা প্রাভদা লিখেছিল, “বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার ‘প্রতিকূল শক্তিরা’ হয়তো দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।”
> মার্কিন আরেক চ্যানেল এনবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জাতির পিতা ও স্বাধীনতা লাভের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক মিলিটারি ক্যুতে তার দেহরক্ষীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে মুজিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কট্টর বিরোধী ছিলেন। তিনি দেশের নাম পাল্টে ইসলামি প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রেখেছেন।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পাওয়ার পর পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তাঁর কাছে এত জনপ্রিয় ছিল যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন যে, আমিই রাষ্ট্র।’
> কানাডার সিবিএস নিউজের খবরে বলা হয়, ‘এক আকস্মিক ক্যুতে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন। তার অন্তত ২০০ অনুসারীও নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। দেশে সেনাশাসন ও কারফিউ জারি করা হয়েছে।’
> ১৭ আগস্ট ইকোনমিক টাইমস শিরোনাম করে ‘ইন্ডিয়া শকড অ্যাট মুজিবস ডেথ’। এই সংবাদপত্রেও বাংলাদেশের ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হওয়ার কথা বলা হয়।
স্টেটসম্যান এদিন তাদের মূল শিরোনাম করে ‘ইন্ডিয়া কিপিং ওয়াচ অন ইভেন্ট ইন বাংলাদেশ গ্রিফ ওভার মুজিব ট্র্যাজিক ডেথ’। স্টেটসম্যান বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে তার জীবনী ছাপে।
> ১৭ আগস্ট ভারতের দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করে ‘বাংলাদেশে অভ্যুত্থান : মুজিব ও মনসুর আলী নিহত, সামরিক আইন জারি’। অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর দুই ভাগ্নেও নিহত হন জানিয়ে এতে বলা হয়, প্রাথমিক অবস্থায় যেসব টুকরো খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে জানা যায় যে পশ্চিমা সমর্থক রাজনৈতিক ও সামরিক বাহিনীর লোকেরা এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। শেখ মুজিবের ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার যাঁরা ঘোরবিরোধী ছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁদেরই একজন। যুগান্তর ১৮ আগস্ট ছাপে ‘মনসুর আলী জীবিত’।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়া
> ‘শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তাঁর অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।’ – ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
> ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’ – ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড
> ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’ – ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবা
> ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’ – ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন
> ‘শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামি জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।’ – জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথা কাউন্ডা
> ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না, যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’ – নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট
> ‘সংগ্রামের ইতিহাসে লেনিন, রোজালিনবার্গ, গান্ধী, নকুমা, লুমুমবা, কাস্ত্রো ও আলেন্দের সঙ্গে মুজিবের নামও উচ্চারিত হবে। তাঁকে হত্যা করা ছিল মানব হত্যার চেয়ে অনেক বড় অপরাধ। শেখ মুজিব শুধু তাঁর জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেননি। তিনি তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও সংগ্রাম করেছিলেন।’ – ব্রিটিশ আন্দোলনকারী ও রাজনীতিবিদ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে
> ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজি এবং গতিশীল নেতা আগামী ২০ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’ – যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার
> ‘তোমরা আমারই দেওয়া ট্যাংক দিয়ে আমার বন্ধু মুজিবকে হত্যা করেছ! আমি নিজেই নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছি।’ – মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত
> শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে তখন নিঃসন্দেহে তাঁর বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তাঁর কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে।’ – ব্রায়ান ব্যারন, দ্য লিসনার, লন্ডন, ২৮ আগস্ট ১৯৭৫

লেখক : গবেষণা সহকারী, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য