Monday, October 2, 2023
বাড়িছোট গল্পএকটি শিশু ও কল্পগল্প

একটি শিশু ও কল্পগল্প

বাসায় ফিরতে নিপা খবর দেয়- দ্যাখো গিয়া তোমার মেয়ের কাণ্ড। বেবিটার কাছছাড়া হচ্ছে না। স্কুল থেকে ফিরেই ওর কাছে বসে আছে। পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে খেলতেও যায়নি। বেডরুমে গিয়ে দেখি সত্যিই তাই।

জিয়া হাশান: মর্নিংওয়াক থেকে বাসায় ফিরে কলিংবেল বাজালে নিপা দরজা খোলে। আমার হাতে একটা বেবি দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে- ‘ওমা! কী সুন্দর গালফোলা বাবু। দাও আমার কাছে দাও।’
তোয়ালে মোড়ানো, কেবল মুখটুক বের করা, বেবিটাকে প্রায় ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে নিয়া নেয়। দু-হাতের ওপর শোয়ায়ে দু-চারটা দোল খাওয়ায়। তখন মৃদুলা ঝাকুনিতে তার পাথরচাপা ঘুমটায় ফাটল ধরে। তার ফাঁক গলে বেবিটা চোখ মেলে। তাতে নিপার উচ্ছ্বাসে আরও এক প্রস্ত ঘি পড়ে। উঁচায় ওঠে তার স্বর- দ্যাখো, দ্যাখো, কী গোটা গোটা চোখ। তারপর তার কপাল মুখের কাছে তুলে ঠোঁটের আগা ছোঁয়ায়। সস্নেহ আদর বিলায়।
নিপার এই বিপুলা উৎসাহের তোড়ে বেবিটাকে ঘরে তোলার পথে বিছানো সুঁচালো কাঁটার আগারা খসে পড়ে। তারা সব ভোঁতা হয়ে যায়। তাদের বাধা-বিপত্তি সৃষ্টির যাবতীয় ক্ষমতা লোপ পায়। তাই আমিও সোৎসাহে নিপার সাথে যোগ দেই। তার আরও কাছ ঘেঁষে দাঁড়াই। দেখি- বেবিটার চোখ জোড়া সত্যিই পদ্মপাতার মতো গোল আর বিশাল। তারা যেন জগৎ দেখায় উদগ্রীব। বলি- বাসায় নতুন অতিথি। তারে মিষ্টিমুখ করাও। দু-ফোঁটা মধু দাও ওর মুখে।
আমার কেবল নিপার ভয়টা ছিল। ও কীভাবে নেবে। যদি না করে, তাহলে যত গল্পই বানাই তার কোনোটাই ধোপে টিকবে না। ওর নারাজিতে খসে খসে পড়বে সব ইট-বালু-সিমেন্ট। আমার শত চেষ্টাতেও তাকে আর রক্ষা করা যাবে না। বাট, নিপা সাদরে গ্রহণ করায়, আদরে বুকে জায়গা দেওয়ায় আমার দায়িত্ব খালাস, ঘাড় থেকে ভারী বোঝা নামা সারা। আমি তাই নিশ্চিত মনে ঝাড়া হাত-পায়ে বাথরুমের দিকে আগাই। ঠিক তখন নিপা মোক্ষম প্রশ্নটা তোলে- ওকে পেলে কোথায়? সাত-সকালে কোত্থেকে নিয়ে এলে?
এবারে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। তোয়ালে হাতে বাথরুমের সামনে থির হয়ে থাকি- কোন গল্পটা বলি? একেবারে খাপে খাপে মেলে, কোনো ফাঁক-ফোকর না থাকে এমন মসৃণ একটা গল্প দরকার। ‘দাঁড়াও, বাথরুম থেকে আসি’ বলে ঢুকে পড়ব? কমোডে নিরিবিলিতে বসে গল্পটা গেঁথে তুলব? তার সব ফাঁক-ফোকরে গ্যাটিস মেরে একেবারে মসৃণ করে তুলব? তারপর বের হয়ে এসে তারে নিপার সামনে দাঁড় করাব- ‘এই যে দেখে নাও, একেবারে নির্ভেজাল গল্প।’ না-কি পথে আসতে আসতে বানানো গল্পগুলো থেকে একটা ঝাড়ব? তা দিয়েই কেল্লা ফতেহ করে ফেলব? নিপার মুখ বন্ধ করে দেব?
তবে মাত্র কিছুদিন আগে নিপা একটা মৃত সন্তান প্রসব করে। সে হাতছাড়া হওয়ায় তার মাতৃস্নেহের বিপুল ভাণ্ডার এখন একেবারে খালি। তাতে যে কোনো গল্পই এঁটে যাবে। যত জটিল করেই বলি, ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে উপস্থাপন করি না কেন, নিপা তা সহজেই নেবে। ভাণ্ডার পূর্ণ করার তরতাজা উপাদান হাতের মুঠোয় পেয়ে গল্পের ফাঁক-ফোকরের দিকে আর নজর দেবে বলে মনে হয় না। তাই আমি নির্দ্বিধায় বলে ফেলি- এ্যাই তো বাসার সামনের ফুটপাতে পেলাম। কেউ রেখে গেছে হয়তো।
-হায় আল্লা! মানুষগুলা কী নিষ্ঠুর। এমন ফুটফুটে বেবিকেও ফেলে রেখে যায়।
– যাওয়ার সময় খেয়াল করি নাই। মর্নিংওয়াক করে ফেরার পথে দেখি পড়ে আছে। তাই তুলে নিয়া এলাম।
– ভালো করছো। আমার খালি বুকটা ভরে গেছে। বাট, ছেলে না মেয়ে দেখে এনেছো?
– না, দেখিনি। তুমি দেখে নাও।
আমাদের একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে আছে- লোপা। সে-ই বাসাটা আলোকিত মুখরিত করে রাখে। তাই আমার আর কোনো চাহিদা ছিল না। কিন্তু নিপার মন ভরে না। তার একটা ছেলে চাই। তাই আমরা দ্বিতীয় ইস্যুর উদ্যোগ নেই। সে ছেলেই ছিল। কিন্তু তাকে জীবিত উদ্ধার করতে না পারায় নিপার মনস্কামনায় গভীর খাদ রয়ে গেছে। বেবিটা ছেলে না হলে সে খাদ ভরার কোনো সম্ভাবনা নাই। তাই বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে মোনাজাত করি- হে খোদা, বেবিটারে ছেলে করে দাও।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাথরুমের দরজায় নিপার করাঘাত- এ্যাই শুনছো… শুনছো?
অ্যাঁ! তাহলে কি বেবিটা মেয়ে? তার তিন কোনা ভূঁইয়ে খাদ। তাই তার ভার নিতে নিপার অনীহা? দুটো মেয়ের বোঝা বইতে অনিচ্ছুক? সাড়া দিলেই বলবে ‘এক্ষুণি এরে ফেলে দিয়া আসো। যেখান থেকে এনেছো সেখানে রেখে আসো। না হলে কোনো অরফানেজে বা মিশনারিতে।’ তাই তার এত তাড়াহুড়ো। আমার বাথরুম থেকে বের হওয়ারও তর সইছে না। আমি উদ্বেগভরা স্বরে জিজ্ঞেস করি- কী হলো আবার?
– বেবিটা একেবারে পারফেক্ট। আমাদের ফ্যামিলির জন্য সুইট্যাবল। কারণ তোয়ালে খুলে দেখি তার দু-পায়ের মাঝখানে শোয়া ছোট্ট টুনটুনি পাখি। আর তার বুকের তলায় কুচকানো দুটো ডিম।
যাক বাবা! আমার গল্পের তাহলে খাপে খাপে মেলা সারা। নিপা এখন আর বেবিটা ছাড়বে না। বুকে আগলে রাখবে। আমি নিশ্চিত মনে টয়লেট-সেভ-গোসল সেরে বাথরুম থেকে বের হই।
বাসায় আগে থেকেই সেরেলাক, ভাইপার থেকে শুরু করে মাতৃদুগ্ধ হাজির। এমন কী দুগ্ধবতীর বাকি তিন মাসের ম্যাটারনিটি লিভও হাতের মুঠোয়। আমি তাই রেডি-সেডি-গো হয়ে অফিস পানে ছুটি।
পনেরো থেকে বিশ মিনিটের রাস্তা। কিন্তু যানজটের দুঃশাসনে দেড় ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে অফিসে পৌঁছতে না পৌঁছতেই মায়ের ফোন- কার পাপের ফসল। কোন অজাত-কুজাত ঘরে তুলেছিস, অ্যাঁ?
ওহ! তাহলে নিপার ঢোল বাজানো সারা। তার পেট এমন পচা, দু-ঘণ্টাও তাতে কিছু থাকে না। বুটবুট করে সব বের হয়ে যায়। আমার বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই তাই তার শাশুড়িরে কল দিছে। তিন হাত কাহিনিরে সাত হাত বানায়ে বলেছে। আর আমার মা আমেনা বেগম খাঁটি সৈয়দ বংশের ঝি, আশরাফ-আতরাফ মেনে তার জীবনে হাঁটাচলা। তাই ফুটপাত থেকে তুলে আনা বাচ্চার কথা শুনে আর থির থাকতে পারে নাই। সাথে সাথে আমারে ধরেছে। তবে তারে সামলানোর গল্প, ফাঁক-ফোকরবিহীন নিখুঁত কাহিনি আমার আগে থেকেই স্টকে রেডি করা। আমি শুধু তার ভূমিকাটুকু বলি- ওতো মীর মাহমুদের ছেলে।
মীররাও সৈয়দদের মতো ভালো খাওয়া-পরার আশায় দূর দেশ থেকে এদেশে এসে বসতি গাড়া আশরাফ। তারা একই স্বভাবের স্বজাতীয়। তাই গল্পের ভূমিকাতে মা কুপোকাত হয়ে যায়। তার গলার স্বর গোটা পাঁচেক ধাপ নামে। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে- মীর মাহমুদ আবার কে?
– ভাইয়ার নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার আগে তুমি যখন আমাদের সাথে ছিলে তখন মাহমুদ বেশ কয়েকবার বাসায় এসেছে। তুমি তারে দেখেছো, উঁচা-লম্বা ফরসা চেহারা। আমার অনেক দিনের ফ্রেন্ড। বাচ্চাটা ডেলিভারির পর ওর বউ পারভীন মারা যায়। তারপর তারে লালন-পালনের জন্য আত্মীয়-স্বজন অনেকের কাছে ধরনা দিছে। কিন্তু কেউ রাজি হয় নাই। শেষে আমারে ফোন দেয়। তাই আজ সকালে মর্নিংওয়াকের কথা বলে বের হয়ে গিয়ে নিয়ে এসেছি।
– ভালো করেছিস। এত বড় বংশের পোলা না খেয়ে মরবে কেন? অযত্ন-অবহেলায় থাকবে কেন? কিন্তু নিপা কি এত ছোট বাচ্চা একা একা সামলাতে পারবে? আমার আজকে সকাল থেকে আবার কোমর ব্যথাটা বেড়েছে। আর নড়াচড়া করতে পারব না। তুই কাল এসে আমারে তোর বাসায় নিয়া যাস।
বাসায় ফিরতে নিপা খবর দেয়- দ্যাখো গিয়া তোমার মেয়ের কাণ্ড। বেবিটার কাছছাড়া হচ্ছে না। স্কুল থেকে ফিরেই ওর কাছে বসে আছে। পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের সাথে খেলতেও যায়নি।
বেডরুমে গিয়ে দেখি সত্যিই তাই। দুজনে বেশ খাতির জমিয়ে নিয়েছে। বেবিটা শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে আর লোপা খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে দেখে বলে- দ্যাখো বাবা, কী সুন্দর। যেন জ্যান্ত পুতুল। জানো, ক্লাসের সবাইকে বলে দিয়েছি- আব্বু-আম্মু আমাকে যেমন হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছে। তেমনি আরেকটা বেবি এনেছে। বয় বেবি। ও এখন আমার ভাই। ওদের কারও বাসায় বেবি নাই। তাই সবাই দেখতে আসবে বলেছে।
– একদিন সবাইকে নিয়ে এসো।
– বাট, মিসরা হাসাহাসি করেছে। বলেছে, কিছুদিন আগে তোমার আম্মু একটা বেবি এনেছিল না, ডেড? আবার এক মাসের মধ্যে আরেকটা আনল কী করে? আনা যায় না বাবা? হসপিটাল তো কাছেই। এক ঘণ্টাও লাগে না আসতে-যেতে।
– মিসদের বলে দিও, এটা মৌলি খালামনি এনেছে। আঙ্কেল আর আন্টি দুজনেই অফিসে যায়। তাদের বাসায় কেউ থাকার নাই। বেবিকে দেখবে কে? তাই আমরা নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের হয়ে গেছে।
– তাই বলে দেব। বাট, ওর নাম কী বলব?
– তোমার ব্রাদার, তুমিই ঠিক করো।
– তাহলে কাল ক্লাসে সবাইকে বলে দেব- একটা করে নাম নিয়া আসতে। যারটা পছন্দ হবে, তারটা রেখে দেব।
– ওকে, ভেরি গুড আইডিয়া।
পরদিন অফিসে পৌঁছার পরপরই পিয়ন খবর দেয়- বড় স্যার আপনাকে সালাম দিছে।
অ্যাঁ! এমডির ডাক। তাও আবার সাত-সকালে? ঘটনা কী? চাকরি নাই না-কি? গেলেই টার্মিনেশন লেটার ধরায়ে দেবে- দেখুন, কিছু মনে করবেন না। আমাদের হাত-পা বাঁধা। হেড অফিসের অর্ডার। আমাদের ফলো করতে হচ্ছে…। না-কি হিসাবে কোনো গোলমাল ধরা পড়েছে? অ্যাকাউন্টে চাকরি করি। তার কোনো শিটে তাড়াহুড়ায় বুকের টিবির জায়গায় পাহাড় বসিয়ে দিয়েছে, মুখের আদলের বদলে পিছনের ফুটো? আকাশ-পাতাল সে গরমিলের বিচারের ভার তাই জেলা-দায়েরা জজ, সেকশন হেডকে পাশ কটিয়ে এক দৌড়ে একেবারে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে, এমডির টেবিলে গিয়া হাজির হয়েছে? বুুকে রীতিমতো ধুকধুকানি নিয়া তাই তার কুঠুরি পানে আগাই।
কাঠঘেরা ঘরে ঢুকে দেখি বড় বড় কোম্পানির মোটাতাজা চেয়ারে বসানোর জন্য ছাচে ফেলে তৈরি করা স্যারের চেহারা। ইস্পাতের মতো কঠিন ও থির। নতুন কেউ দেখলে নির্ঘাত বুকের জল শুকিয়ে যাবে। অন্তরাত্মা ছুটে পালাবে। তবে আমরা অভ্যস্ত বলে অত দূরে ছুটতে হয় না। বরং দু-কদম আগায়ে তার মুখোমুখি বসতে পারি। এবার স্যার মুখ তুলে তাকান- আপনি ম্যাটারনিটি লিভের অ্যাপ্লাই করেছেন?
আমাদের কর্পোরেট অফিস, এদেশে চেয়ার-টেবিল পেতে বসলেও তার হাত-পা তো বটেই, মগজও চলে বিদেশের ইশারায়। তাদের এক আঙুলি হেলনে বছর তিনেক আগে ম্যাটারনিটি লিভের চল চালু হয়। তবে ম্যাটারনিটির তুলনায় তার দশা একেবারে হতদরিদ্র। ছয় মাসের পেট মোটা তহবিলের বিপরীতে মাত্র দুই সপ্তাহের চুপসানো খুতি। কিন্তু ফাও তো, একেবারে মিনি-মাগনা। বাঙালি কখনও তা হাতছাড়া করে না। এমন কী আলকাতরা হলেও ক্রোড়ে তুলে নেয় বলে প্রবাদ আছে। তাই নতুন বেবির পিতৃত্বের খুঁটি পাকাপোক্ত করতে, আরও গহীনে গাঁথতে, পাঁচ থেকে অন্তত সাত হাত গভীরে নিতে গতকাল লিভের অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু তার তো বড় স্যারের অফিসে আসার কথা না। ইমিডিয়েট বস, কাচঘেরা ঘরের সেকশন হেডই তার জন্য কলম নিয়া খাড়া। তিনি তাতে আঁচড় কেটে ইয়েস অর নো করে দিলেই হয়ে যেত। এতদিন তো তাই হয়ে আসছে। তাহলে তা কাচঘেরা ঘরের বদলে কাঠঘেরায় পা রাখল কী করে? তারে এখানে ঢুকতে দিল কে?
– এইচআর। কয়েকদিন আগে আপনার চাইল্ড হয়েছে। তাও ডেড। তার ওয়ান মান্থের মাথায় নিউ বর্ন বেবি আপনি কোথায় পেলেন? তার সুরাহা করতে না পেরে এইচআরডি অ্যাপ্লিকেশনটা সরাসরি আমার কাছে পাঠিয়েছে।
কিন্তু বড় স্যারের জন্য তো আমার স্টকে কোনো গল্প মজুদ নাই। তাকে যে কিছু বলতে হবে, তা তো প্ল্যানেও ছিল না। তবে সেকশন হেডের জন্য ছিল। কিন্তু তা আর বড় স্যাররে বলা যায় না। কেননা দুইজনের রুচি দুই। একজনেরটা যদি আকাশে তো আরেকজনেরটা পাতালে পা রেখে খাড়া। তাই সেকশন হেডরে যেনতেন নড়বড়ে একটা গল্পে বুঝ দেওয়া যেত। আর তাতে যদি কোনো ফাঁক-ফোকর বের করতেন, তাহলে প্ল্যান ছিল তার দেরাজে দুই প্যাকেট সিগারেট রেখে দেওয়ার। আর বড় কোনো ফাটল পেলে বাজার থেকে এক জোড়া ইলিশ কিনে তার বাসায় পাঠানোর- স্যার, ছোটভাই গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নিয়ে এসেছে। একেবারে তাজা। পদ্মা থেকে তোলার পরপরই কেনা, স্যার।
কিন্তু এসবে তো বড় স্যাররে বুঝ দেওয়া যাবে না। তার জন্য চাই একেবারে ইস্পাতে গড়া গল্প- খাড়া ও ঋজু। শত প্রশ্নেও সে হেলবে না। এতটুকু আঁচড় লাগবে না তার গায়ে। কিন্তু এখন এমন নিখুঁত গল্প কোথায় পাই? ইতস্তত ভাবের সাথে আমার বসবাস দেখে স্যার নিজেই সাহায্যের হাত বাড়ান- মিশনারি থেকে এনেছেন?
ও হ্যাঁ, ক্লাসমেট সাজিদ ও মুনিরা ভার্সিটি শেষ করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। বাট, আট বছরেও কোনো প্রোডাক্টশনে যেতে পারে নাই। বিছানায় চিৎ-কাত কিংবা উপুড়ে ধস্তাধস্তিই সার হয় তাদের। শেষে ডাক্তার ফাইনালি বলে দেয়- সাজিদের স্পার্ম দুর্বল। সবগুলোর কোমর ভাঙা। তারা বের হওয়ার পর ল্যাংচে ল্যাংচে আগায়। ফলে তারা আর মুনিরার ওয়াই-ক্লোরোজমের নাগাল পায় না। সুতরাং তাদের কারও ঘাড়ে হাত রাখা, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা তারপর একদেহে লীন হওয়ার সুযোগ নাই। তাই ভবিষ্যতেও আর বাচ্চা-কাচ্চা হবে না। তখন ওরা মিশনারিতে ছোটে, মাদার তেরেসা হোমে যায়। তারপর খোঁজ দিয়া দেখে- রাজধানীর আরও অনেক স্পেশালাইজ হাসপাতাল নিউ বর্ন বেবি সাপ্লাই দেয়। তাদের কাছ থেকে একটা এনে ঘর আলোকিত করে। সুতরাং আমার আনতে সমস্যা কী?
– জী স্যার, আমাদের বাচ্চাটা ঠিকমতো না হওয়ায় নিপা মানে আমার ওয়াইফ খুব আপসেট হয়ে পড়ে। তাকে কিছুতে সামলানো যাচ্ছিল না। তাই…। বাট, আমার মা একটু সিরিয়াস ধরনের রিলিজিয়াস। তাই মিশনারি থেকে নয়; বরং বাসার কাছের একটা স্পেশালাইজ হসপিটাল থেকে নিয়ে এসেছি।
– ভেরি গুড। দারুণ মানবিক কাজ করেছেন। আপনারা ইয়াংম্যান আপনাদেরই সাজে এমন হিউম্যানিটিরিয়ান ওয়ার্ক।
বড়স্যারের রুম থেকে বের হওয়ার পর নিপুর ফোন- দোস্ত অফিসের পর ইভিনিংয়ে ক্লাবে আয়। তোর সাথে আর্জেন্ট কথা আছে।
নিপু আমাদের ভার্সিটি-ফ্রেন্ড। পড়াশোনা শেষ করে কিছুকাল বিদেশে ছিল। বছর দুই হয় দেশে ফিরে ফ্যামিলি বিজনেস হাতে নিছে। ফলে সব সময় ওর পকেট ভারী থাকে। হোটেল বা ক্লাবে ওর সাথে গেলে আমাদের মানিব্যাগে হাত দিতে হয় না। সুতরাং ওর দওয়াত কবুল না করার কিছু নাই।
কিন্তু ওর আর্জেন্ট কথাটা কী? দেশের বাইরে যাবার সময় বউরে বগলদাবা করে নিয়ে যায়। তবে বছরের মাথায় দেখে সে হাওয়া হয়। আরেকজনের হাত ধরে উধাও হয়ে যায়। তখন একজন বিদেশিনীরে জোগাড় করে নেয়। তবে ফেরার পথে আবার তারে ছেড়ে দিয়া আসে। মাস কয়েক আগে দেশে আরেকজন জুটিয়ে নিছে। তার সাথে এখন সুখে-শান্তিতে আছে বলে আমাদের জানা। তাহলে আবার আর্জেন্ট কথা গজায় কোত্থেকে? তবে আমরা যারা একজনে থিতু। জানি না তিনজনের স্বাদ কেমন। ওর নিশ্চয়ই জানা আছে। এতদিনেও কখনও জিজ্ঞাস করা হয় নাই। আজ ক্লাবে দাওয়াত, তারপর সাথে আর কেউ থাকবে না। সুতরাং পেটে দু-চার পেগ পড়লে মুখের লাগাম ছুটে গেলে তা জিজ্ঞাস করার চান্স হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তারে আজ আর হাত ছাড়া করা যাবে না। জিজ্ঞেস করে বাস্তবের বদলে মৌখিক স্বাদ নিয়ে নেব।
অফিস শেষ করে তাই দ্রুত ছুটি। ক্লাবে গিয়া দেখি নিপু আগে থেকেই হাজির। আমাকে দেখে হৈহৈ করে ওঠে। তার মানে পেটে ইতোমধ্যে দু-চার পেগ পড়েছে। তার রি-অ্যাকশনও শুরু হয়ে গেছে। মাশাল্লাহ্।
টেবিলে মুখোমুখি বসার পর তার মুখের লাগাম ছুটে যায়। যাচ্ছেতাই দিকে ছুটতে থাকে- খোল, তোর প্যান্ট-জাইঙ্গা খোল। দেখি তোরটা কী দিয়া গড়া। রক্ত-মাংসা না-কি স্টিল-লোহার, অ্যাঁ? তিন তিনটা সাজ-সরঞ্জাম, নয়া নয়া কাঠামো ইউজ করেও আজ অবধি একটা প্রোডাক্টশন দিতে পারলাম না। আর তুই মাসে মাসে একটার পর একটা দিয়ে যাচ্ছিস। খোল তোর ইঞ্জিনে কপাল ছোঁয়াই তাতে যদি ভাগ্য খোলে…।
ওহ! এই তাহলে আর্জেন্ট কথা। নিজের অক্ষমতার জ্বালায় টসবগানো প্রশ্ন- মাসে মাসে বেবি আসে কোত্থেকে? জবাব আমার হাতের মুঠোয়। এক বাক্যেই তারে হাজির করা যায়। কিন্তু গল্প ছাড়া কেউ কি কিছু বিশ্বাস করে? কারও আস্থার ঘরে কিছু থিতু হয়? সে-রকম জুতসই গল্প এখন কোথায় পাই?
তবে এ নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হয় না। বেয়ারার এনে দেওয়া পেগ বটম-সাফ করে গলায় চালান করতেই সে স্ব-শরীরের হাজির হয়। পুরো অবয়ব নিয়া খাড়ায়- দুধে ধোয়া তুলসীপাতা ছোঁয়ানো পুত-পবিত্র গল্প- তুই তো জানিস ভার্সিটি লাইফে নিনার সাথে আমার রিলেশন ছিল। নদীর তলঘেঁষা আর মোহনার মতো চওড়া প্রেম। বাট, হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তা ছিঁড়ে যায়। বছরখানেক আগে ওর বর ইহলোক ছেড়ে চলে গেলে আবার তা জোড় লাগে। নিনা এখন বড় চাকরি করে। একা একা একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। তাই মাঝে মাঝে ডাকে। আমিও না করতে পারি না। পুরানা প্রীতি বলে কথা। তার কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে, প্রোটেকশনের প্রতারণায় ওর মিনিস্ট্রুশন হাত-পা গুটায়ে নেয়। তার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমি অ্যাবরশনের কথা বলেছিলাম। বাট ও রাজি হয় নাই- ‘সুযোগ যখন এসেছে, মা হওয়ার এক্সপেরিয়েন্সটা হয়ে যাক।’ তাই গোপনে গোপনে বয়ে বেড়ায়। আগাম ছুটি নিয়ে পেট-পিঠ ঢেকেঢুকে রাখে। বাট ডেলিভারির পর দেখা দেয় আসল সমস্যা- পালবে কে? রাখবে কার কাছে? নিজের অফিস আছে সকাল-সন্ধ্যা। তারপর দেশ-বিদেশ ট্যুর তো লেগেই আছে। ভাগ্যিস, লোপারটা ঠিকমতো ডেলিভারি হয় নাই। তাই পরশু সকালে মর্নিংওয়াক থেকে ফেরার পথে ঘরের ছেলেরে ঘরে নিয়ে এসেছি।
– বাহ! লোপার সাথে আমার কথা হয়েছে। ওর কাছে সব শুনেছি। তুই পারিসও বটে, একটার পর একটা গল্প বানিয়ে দিন পাড়ি দিতে দেখি তোর কোনো জুড়ি নাই।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য