সৈয়দ এ সামাদ : তিনি ছিলেন একজন বিশাল মানুষ। যেমন আক্ষরিক অর্থে, তেমনি কল্পনাশ্রিত অর্থেও। তিনি ছিলেন দয়ালু, উদার, অসাধারণ সাহসী একজন স্বভাবগত নেতা, যার তুলনীয় আর কাউকেই সম্ভবত পাওয়া যাবে না এই অঞ্চলে। আমি লিখছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা-পিতার কথা। তার জীবন ছিল তার দেশের জনগণের জন্য সংগ্রামে ও ত্যাগে উৎসর্গকৃত একটি জীবন। একটি সোনার বাংলার জন্য তার স্বপ্ন ছিল এত তীব্র ও শক্তিশালী যে তার জীবদ্দশাতেই তা বাস্তবায়নের জন্য ঘটনার গতি-প্রকৃতি অনিবার্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তার বজ্রকণ্ঠ পাকিস্তান ফেডারেশনের ভঙ্গুর ভিত্তিটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন দুর্লভ চমৎকারিত্ব ও ক্যারিশমার অধিকারী এক ব্যক্তিত্ব। নেতৃত্বসুলভ সহজাত গুণ আর সাংগঠনিক ক্ষমতা নিয়েই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার সম্বন্ধে আমরা শুনেছি পঞ্চাশের দশকের একজন নবীন ও ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে। তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতির মৌল চরিত্র বদলে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বদলে প্রবর্তন করতে চেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা, স্বৈরতন্ত্র থেকে উত্তরণ ঘটাতে চেয়েছেন গণতন্ত্র। আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারার অসাম্প্রদায়িকীকরণ শেখ মুজিবের অর্জন। তার এই পরিণতিস্বরূপ ১৯৭১ সালে তারই নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে।
আমরা প্রথমে তাকে দেখি পল্টন ময়দানের অসংখ্য রাজনৈতিক জনসভায়। আওয়ামী লীগের জনসভাগুলোতে প্রচুর জনসমাগম ঘটত। ময়দানের কাছাকাছি আমরা যখন ক্রিকেট খেলতাম, তখন দৃশ্যত বিশৃঙ্খল জনতার মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হতাম। সেসব জনসভার মঞ্চে থাকতেন এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অন্য নেতারা। কিন্তু বিশৃঙ্খল জনতাকে সামলাতে দেখা যেত সব সময়ই যুবক শেখ মুজিবকে, সেই বিখ্যাত গোঁফ আর মোক্ষম হাসিমাখা মুখের শেখ মুজিবকে।
তিনি যখন বলতেন, “দয়া করে বসে পড়েন, আপনারা না বসলে সভার কাজ আরম্ভ করা যাচ্ছে না”, তখন তার ফল হতো বৈদ্যুতিক। বিশাল জনসমুদ্রে তৎক্ষণাৎ নেমে আসত পরিপূর্ণ নীরবতা। অসাধারণ জাদুকরি শক্তিসম্পন্ন একজন নেতা ছিলেন তিনি। প্রায় নির্ভুলভাবে তিনি জনতার মনমেজাজ ধরে ফেলতে পারতেন, যেমনটি তিনি তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রজ্ঞায় বিশ্বাস করতেন। সাধারণ মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অসাধারণ। জনগণের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা সত্যিকারভাবে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে তিনি যতটা আন্তরিক ও পারদর্শী ছিলেন, তার যুগের আর কোনো নেতাই তার নিকটবর্তী হতে পারেননি।
আমার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে আমি একটি ঘটনার কথা বলব। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে আমরা লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে শিক্ষানবিস ছিলাম। সেটা ছিল ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী সময়। শেখ মুজিব তখন বাঙালি জাতির একজন শক্তিমান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছিলেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানকে বস্তুত অরক্ষিত দেখতে পেয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নৈরাশ্যজনক অবস্থান চিহ্নিত করেছিলেন। আমরা গুজব শুনতে পাই যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষার জন্য তিনি এক মহান কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। কিন্তু তার সেই পরিকল্পনায় কী ছিল, সে-সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে শিক্ষানবিস ছিলাম বলে আমাদের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে হতো। লাহোরের একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় যখন খবর পেলাম যে শিগগিরই লাহোরে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শেখ মুজিব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেবেন, আমি তখন স্থির করলাম, যা ঘটে ঘটুক, আমি সে-জনসভায় যাবই, শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতেই হবে।
নির্ধারিত দিনে একাডেমি থেকে লুকিয়ে বের হয়ে আমি জনসভাস্থলে হাজির হলাম। শেখ মুজিবের কথা শোনার জন্য বিশাল জনসভা অপেক্ষমাণ। এক সময় দেখতে পেলাম, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন সিভিল সার্ভিস একাডেমির ডেপুটি ডিরেক্টর ড. তারিক সিদ্দিকী। স্বীকার করতেই হবে যে আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম এবং ভাবছিলাম তিনি কেন সেখানে উপস্থিত। মনে ভয় হচ্ছিল, চাকরিটাই বুঝি গেল! ড. সিদ্দিকী ছিলেন একজন উদারপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, তার ছিল ভারসাম্যের একটি সুন্দর বোধ। তিনি আমাদের পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে আমার ঘাবড়ানো অবস্থান দেখে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন যে তিনি আমার ওপর নজরদারি করতে আসেননি, স্রেফ শেখ মুজিবের ভাষণ শুনতে এসেছেন। এ-কথা শোনার পর আমার ধড়ে আবার প্রাণ ফিরে এলো।
তার কথা শুনে আমার মনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। ততক্ষণে জনসভা শুরু হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জনতার ভিড় ছিল উত্তাল, হৈচৈ ছিল প্রচণ্ড আর ভীষণ অস্থিরতা ছিল এএইচএম কামারুজ্জামান (স্বাধীন বাংলাদেশের তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন) এবং জহিরুদ্দিন সমবেত জনতার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছিলেন। তারা উভয়ই চমৎকার উর্দু বলতেন। কিন্তু তাদের চেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছিল না। ২০-২৫ মিনিট ধরে জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা চলে। কিন্তু চারদিকে হৈচৈ, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলার নিরসন ঘটে না। হতাশ হয়ে আমি সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ একটি বজ্রকণ্ঠ কানে এলো। শেখ মুজিব উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং মাইক্রোফোন হাতে নিয়েছেন। ভারী ও গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বললেন, “এ আপনাদের কী ধরনের ব্যবহার? আমরা আপনাদের মেহমান। আমাদের কথা বলতে দেওয়া হবে বলে আপনারা রাজি হয়েছেন, অথচ এ-রকম শোরগোল করছেন। আমি একটা সমতল খেলার মাঠ চাই। দয়া করে আগে আমার কথা শুনুন, তারপরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুন।” হঠাৎ করে সব হট্টগোল থেমে গিয়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
এই হচ্ছে নেতৃত্বÑ পেছন ফিরে শুনতে পেলাম ফিসফিস করে বলছেন ড. তারিক সিদ্দিকী, প্রায় স্বগতোক্তির মতো। আবার তিনি বললেন, “এই যে পাঞ্জাবের মধ্যভূমিতে এসে একজন লোক তার কথা বলার চেষ্টা করছেন আর কত সহজেই না তিনি তা করলেন, এটা অসাধারণ!” যে জনতা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরূপ ছিল, তাদের মেজাজ তিনি চক্ষের পলকে যেভাবে বদলে দিলেন, তা দেখে আমি ভীষণভাবে অভিভূত হলাম। তারপর তিনি একে একে তার দাবি তুলে ধরলেন, ইতিহাসে যেগুলো ‘৬-দফা’ দাবি নামে বিখ্যাত হলো। প্রতিটি দফা তিনি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন, যাচাই করে দেখালেন এবং বললেন যে তার জানামতে এই হলো বাঙালিদের ন্যূনতম কর্মসূচি। এখন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতার পক্ষ থেকে এই বিখ্যাত দাবিনামা মেনে নিতে হবে। ভাষণের পর জনতার মধ্যে আমি কিছু গোলমাল দেখতে পেলাম। দাবিনামার অন্তর্নিহিত অর্থ ও যোগফল সম্পর্কে আমার নিজেরও অস্পষ্টতা কম ছিল না। তখন আমি স্থির করলাম যে জনসভার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত সচিবের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আমি তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধুর হোটেলকক্ষে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে ক্লান্ত, চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছিল। বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিলাম। তারপর জানতে চাইলাম ৬-দফার তাৎপর্য কী? তিনি সরাসরি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি একজন সিএসপি শিক্ষানবিস। তোমার উচিত সিরিয়াসভাবে ট্রেনিং ক্লাসগুলো করা। অদূর ভবিষ্যতে তোমার মতো লোকদের অনেক বড় বড় দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। ৬-দফা সম্পর্কে সময় হলেই সবকিছু জানতে পারবে। অধৈর্য হওয়ার কিছু নেই। এখন একাডেমিতে ফিরে যাও, চাকরির শৃঙ্খলা মেনে চলো।” আমার মনে হলো এটা একটা মৃদু ভর্ৎসনা, তবু আনন্দিত হলাম এই ভেবে যে এত বড় একজন নেতার কাছে আমি কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া খুব সহজেই যেতে পেরেছি। তখন আমি ছিলাম নেহাত একজন প্রশিক্ষণার্থী, তবু তিনি আমার সঙ্গে সাগ্রহে, সস্নেহে কথাবার্তা বলেছেন।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তিনি চট্টগ্রাম সফরে যান ফেব্রুয়ারিতে। আমি তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক। বিমানবন্দরে জনসমাগম এত ব্যাপক ছিল যে হেলিকপ্টার সেখানে নামতে পারেনি। আমরা তাকে সরাসরি গভর্নমেন্ট হাউসে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেখানেও জনতার ভিড় সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মহান নেতাকে একনজর দেখতে চাইছিল প্রত্যেকে। বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় আমি বঙ্গবন্ধুকে দূরের একটি সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে গেলাম। ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ও, তুমি। এখন বুঝেছ তো ৬-দফার পুরো মানে?”
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিশ্চয়ই লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তারপরও তিনি লাহোরের এক হোটেলে আমার সঙ্গে সেই সামান্য কথোপকথনটি পরিষ্কার মনে করতে পারছেন। এত প্রখর এবং তীক্ষè ছিল তার স্মৃতিশক্তি। হাজার হাজার লোকের নাম তিনি মনে রাখতে পারতেন, সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে সমান স্বচ্ছন্দ, উদারতা ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করতেন। তার মতো দয়ালু আর কোনো ব্যক্তির সাক্ষাৎ আমি পাইনি। আজন্ম এই নেতা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধসম্পন্ন একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। তবে সর্বোপরি জনগণের জন্য ও দেশের জন্য তার ভালোবাসা ছিল একেবারেই তুলনাহীন। তিনি ছিলেন একজন আসল নেতা, জন্মগতভাবে মোহিনী শক্তির অধিকারী মানুষ, একজন জাত বিজয়ী এবং শেষ পর্যন্ত একজন ট্র্যাজিক হিরো-বিষগ্ন নায়ক। বাংলাদেশের যে শাশ্বত নদীগুলো তিনি এত ভালোবাসতেন, তারা তার স্মৃতি শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে বয়ে নিয়ে যাবে। আর যারা তাকে হত্যা করেছে, তাদের ছাই পর্যবসিত হবে ধুলোয়। আর আমি ও আমার প্রজন্ম, যারা তার দ্বারা এতটা প্রণোদিত, অনুপ্রাণিত ছিলাম, চিরকাল তার শূন্যতা বোধ করব।
লেখক : সাবেক মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়; ১৯৭৩-৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত উপ-সচিব