সম্পাদকের কথা
দেশপ্রেম, সততা, দক্ষতা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি মনস্কতায় অতুলনীয় লিজেন্ডারি ব্যক্তিত্ব এএমএ মুহিত সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। মেধা ও প্রতিভায় অত্যুজ্জ্বল মনীষা এএমএ মুহিত ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ের সফল অর্থমন্ত্রী। ২০০৮ সালে তার নেতৃত্বে প্রণীত হয় স্বাধীনতা-উত্তর সবচেয়ে তাৎপর্যময় ও আকর্ষণীয় নির্বাচনী ইশতেহার- দিনবদলের সনদ। বিদ্যুৎ ঘাটতি, খাদ্য ঘাটতি, লজ্জাজনক দারিদ্র্য এবং অপ্রতুল শিক্ষার সুযোগ নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ক্ষমতা গ্রহণকালে ছিল রপ্তানি বাণিজ্যে সংকট। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অচিরেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। অর্থমন্ত্রী মুহিতের দক্ষ পরিচালনায় বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থেই দিনবদলের ভিত্তি রচিত হয়। বাংলাদেশ এখন বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীল, শিক্ষা সম্প্রসারণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, পদ্মাসেতু নির্মাণসহ অবকাঠামো নির্মাণে অতুলনীয় সাফল্য এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে অগ্রগতি বাংলাদেশকে যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছে, তার পেছনে সরকারপ্রধান ছাড়াও অর্থমন্ত্রী মুহিতের বিশেষ অবদান রয়েছে। এসব কারণে বাঙালি জাতি তাকে কোনোদিন বিস্মৃত হবে না।
মুহিত তরুণ বয়স থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এজন্য কারা নির্যাতনও ভোগ করেছেন। ছিলেন সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। সিএসপি কর্মকর্তা হিসেবে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে কর্মরত থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের আনুগত্য ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কাজ করেন। এরশাদ আমলের শুরুতে অর্থ সচিবের পদে ইস্তফা দিয়ে শর্তসাপেক্ষে এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। এরশাদ একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করলে মুহিত দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে আমেরিকা চলে যান। সেখানে তিনি প্রবাসীদের নিয়ে এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সাধারণ নির্বাচনে সিলেট থেকে জয়লাভ করেন।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ রাজনীতিকই গ্রাম থেকে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। ফলে তাদের আচরণে-চিন্তায় এবং জীবনচর্যায় কম-বেশি এক ধরনের ‘গ্রাম্যতা’ থেকে যায়। মুহিত একটি উচ্চ শিক্ষিত বনেদি পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক। মানুষটি ছিলেন নাগরিক বৈদগ্ধমণ্ডিত সংস্কৃতিবান এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধসম্পন্ন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-প্রত্নতত্ত্ব, সংগীত, ক্রীড়া, পরিবেশ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও গৌরববোধ। আর্থিক খাত ছাড়াও এসব ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল প্রেরণাদায়ক।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র মুহিত দেশের ইতিহাস, রাজনীতি, উন্নয়ন-অর্থনীতি নিয়ে বহু সংখ্যক গ্রন্থের প্রণেতা। তার ছিল বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা। সদাহাস্য মুহিত সব বয়সী মানুষের সাথে অবাধে মিশতে পারতেন। নিরঙ্কার, নির্লোভ, সেকুলার ও মহান এই দেশপ্রেমিক মানুষটির প্রতি জানাই সুগভীর ভালোবাসা ও অনিঃশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।