Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderউন্নয়নের জন্য অপরিহার্য রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

বাংলাদেশের রয়েছে গতিশীল ও সমৃদ্ধিময় অর্থনীতি। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের পর রিটার্ন আসে দ্রুত। অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশের রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট তুলনামূলক খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে।

ড. এ কে আবদুল মোমেন: বিশ্ব পরিমণ্ডলে এক সময়ে ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশ আজ আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করে একটি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে জোরেসোরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলাদেশের শাসনভার নিজের কাঁধে নিয়ে যে শান্তি ও প্রগতির রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছেন সামনে। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ বিশ্বশান্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অমোঘ নীতিই এখনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রের ওপর ভর করেই সকল বাঁধার পাহাড় ডিঙিয়ে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এদেশের সর্বকালের সফল প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তার শাসনামলের প্রতিটি পদে পদে রচিত হচ্ছে সফলতার ইতিহাস। শেখ হাসিনা সরকারের বিগত ১৩ বছরে অজস্র কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ শুধু এদেশের দূরদর্শী কূটনৈতিক নেতৃত্বের কারণে।
বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির দুটো ফোকাসিং পয়েন্ট হলোÑ ইকোনোমিক ডিপ্লোমেসি এবং পাবলিক ডিপ্লোমেসি। এর সাথে যোগ হয়েছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও ব্যাপকভাবে প্রয়োজন। আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক ও শান্তি বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ এ বিষয়টাকে প্রাধান্য দিয়েই অগ্রসর হচ্ছে সামনে।
০২
শেখ হাসিনার বর্তমান শাসনামলে অর্থনৈতিক কূটনীতির কার্যক্রম আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে, গত এক বছরে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ৬৮ শতাংশ বেড়ে ৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের সমকক্ষ দেশগুলোর কেউই সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণে এমন সাফল্য পায়নি। এদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল লক্ষ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া ‘ভিশন-২০২১’ ও ‘ভিশন-২০৪১’ অর্জনে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, প্রবাসীদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও গতিময় করা গুণগত উৎকর্ষ সেবাদানের মাধ্যমে সকলের আস্থা অর্জন করা। এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি।
অন্যদিকে পাবলিক ডিপ্লোমেসির উদ্দেশ্য হলো- সামাজিক অগ্রগতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আর সন্ত্রাস দমনে সরকারের অভাবনীয় সাফল্য এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও শেখ হাসিনার ভিশনসমূহকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা। যাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পরিবর্তিত হয় এবং বিশ্ববাসী জানে যে বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়; বরং বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট গন্তব্য। কারণ, বাংলাদেশের রয়েছে গতিশীল ও সমৃদ্ধিময় অর্থনীতি। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের পর রিটার্ন আসে দ্রুত। অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশের রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট তুলনামূলক খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে, বিদেশের বিভিন্ন নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজকে সম্পৃক্ত করে, সেদেশের সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনি প্রচার করে উন্নত ভাবমূর্তি অর্জন জনকূটনীতির মূল লক্ষ্য। এ কাজটি করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিটি মিশনে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ চালু হয়েছে। যেমন এক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানা ও বুঝার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশনের বাইরে ‘ইউএসআইএস’ প্রতিষ্ঠান ছিল, যারা মার্কিন জীবনধারা, তাদের ইতিহাস, তাদের অর্জন এবং তাদের গুণাবলিগুলো তুলে ধরত। ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ একইভাবে বাংলাদেশের অর্জন, বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার অর্জনের জন্য ত্যাগ, ধর্মীয় সহিঞ্চুতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগের সুযোগ ও পরিবেশ, উন্নত অবকাঠামো, বিশাল কর্মক্ষম ও দক্ষ যুবসমাজ, আইটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা, ইত্যাদি অর্থাৎ বাংলাদেশকে সম্ভাবনার অর্থনীতি হিসেবে বহির্বিশ্বে জানান দেওয়া। নাগরিকদের সৃষ্টিশীলতা ব্যবহার করে দেশের কাজে লাগানো। প্রবাসীরা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বৈকি।
এর সাথে জরুরি বিষয়টি হলো আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। দেশের অভ্যন্তরীণ অথবা বাইরের যে কোনো বৈরিতা মোকাবিলা করে দেশ এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। কারণ কোনো অঞ্চল একবার অস্থির হয়ে উঠলে সেই এলাকার উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়, সেই সমাজের শান্তি নষ্ট হয়। যার প্রভাব পড়ে অন্য সমাজ ও অন্য দেশেও। একটি শান্তিপূর্ণ দেশের স্থিতিশীল অবস্থাও নষ্ট হতে পারে পাশের দেশের অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে। আঞ্চলিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মানসিকতা না থাকলে কোনো দেশের একার পক্ষে উন্নয়নের সুফল ভোগ করা সম্ভব না। তাছাড়া আমাদের উন্নয়নের অর্জনগুলোকে ধরে রাখতে এবং টেকসই করতে প্রয়োজন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা। এ কারণে সব সময়ই বাংলাদেশ বৈরিতার নীতি পরিহার করে চলছে। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত সকলের সাথে সুসম্পর্কের নীতিই এখনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল বক্তব্য। এর ওপর ভর করেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক অঙ্গনে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সব সাফল্য। এর সুফল হিসেবেই ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা ও সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইন্সট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডালিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট ভিশন নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের তালিকায় উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর আলোকে কার্যকর ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপসমূহ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম, সভা ও সেমিনারে তুলে ধরছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রায় ১১ বিলিয়ন থেকে ৫২ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব ও সফল কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়। ঐতিহাসিক এই নিষ্পত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরোধ নিরসনে বিরল এ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার এ নীতি আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত করেছে। এ রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সম্ভাবনাময় সকল সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ২০১৮ সালে ভারত ও চীনের সাথে ‘ব্লু ইকোনমি’ এবং ‘মেরিটাইম খাতের মান উন্নয়নে সহযোগিতা’ বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই সাথে এই বিশাল জলরাশিতে যে সমস্ত সম্পদ রয়েছে, তার সঠিক ব্যবহারের জন্য (Delta- 2100) ১০০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।
০৩
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম কারণ হলো দেশের বর্তমান স্থিতিশীল রাজনীতি। সুদীর্ঘ ১৩ বছর ধরে সব ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে শক্ত হাতে দেশ চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা। তার যোগ্য ও সুকৌশলী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। অস্থিতিশীলতা একটা জাতিকে কতটুকু পিছিয়ে দিতে পারে, তার বর্তমান উদাহরণ হচ্ছেÑ আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়ামেন কিংবা লেবানন। এদেশগুলোর জনজীবন ও উন্নয়ন এখন বাধাগ্রস্ত। শান্তি ও স্থিতিশীলতায় ভাটা পড়লে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। আমাদের দেশেও এর প্রমাণ রয়েছে। ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কারণে বাংলাদেশ ৩০ বছরের জন্য পিছিয়ে পড়ে। বাংলাদেশ যে ৪টি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দর্শনের অন্যতম একটি হলো গণতন্ত্র, যা ধ্বংস হয়ে গেল ১৫ আগস্টের ভোররাতে। গণতন্ত্র হয়ে গেল সামরিক গণতন্ত্র। তার সাথে মানুষের দৌরগোড়ায় গুণগত উন্নত সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার যে ‘জেলায় জেলায় জেলা সরকার’ প্রবর্তন করেন, তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে কাক্সিক্ষত সুফলটা পাওয়া যায়নি। ফলে জনগণের সব ধরনের সেবা পাওয়ার জন্য এখনও মানুষকে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। যদিও বর্তমান সরকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আন্তরিক হয়ে কাজ করছে। সামরিক শাসন একা চলতে পারে না। যখনই তার সঙ্গে প্রহসনের নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়, তখন তা এতই বিপজ্জনক হয় যে, একটা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৭৫-এর পরে বাংলাদেশের অবস্থাও হয়ে পড়েছিল সেই রকম। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। বহু বাধা পেরিয়ে আজ বর্তমান অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। যে কোনো সংগঠন, প্রতিষ্ঠান- এমনকি রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো স্থিতিশীলতা। সেই স্থিতিশীলতা আসে জনগণের মৌলিক শিক্ষা, দেশপ্রেম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি চিকিৎসাসেবা এবং ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে। শেখ হাসিনার সরকার এর প্রত্যেকটি বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন সামনে।
স্থিতিশীল রাজনীতি একটি দেশকে কেমন করে উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এশিয়ার অন্যতম দেশ মালয়েশিয়া। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে দেশটি। মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ। যার মোট আয়তন ৩ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। মোট ১৩টি প্রদেশ এবং ৩টি প্রশাসনিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত এদেশের জনসংখ্যা ৩২.৭ মিলিয়ন। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ১৫০ মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার টার্গেট অর্জন করতে সক্ষম না হলেও ২০৩০ সালে উন্নত রাষ্ট্র ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চীন, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডের জল ও স্থল সীমান্ত ঘেরা মালয়েশিয়ার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান।
মাহাথির মোহাম্মদ যেদিন মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, সেদিন দেশটি ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র। তখন তার মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১৩০ ডলার। জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ২৫ শতাংশ। শিক্ষিতের হার ছিল ২০ শতাংশ। জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল শহরবাসী ও শিল্পনির্ভর। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছরের শাসন শেষে মাহাথির যেদিন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়েন, সেদিন দেশটির মাথাপিছু আয় ছিল ৩ হাজার ৩৩০ ডলার। শিক্ষিতের হার ৯৯ শতাংশ। পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর, নারীদের ৭৬ বছর। ১৯৮১ সালের ১৬ জুলাই ৫৫ বছর বয়সে ডা. মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার চতুর্থ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটানা ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ৭৭ বছর বয়সে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ও রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। একটি পক্ষ সব দেশেই থাকে, যাদের কাজ হলো শুধু সমালোচনা করা। কিন্তু উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সব সময় সব সমালোচনা গায়ে মাখলে চলবে না। নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক রেখে দৃঢ়ভাবে পথ চলতে হবে, মাহাথিরের দীর্ঘ শাসন মূলত সেই জিনিসটা দেখিয়ে দিয়েছে গোটাবিশ্বকে।
স্থিতিশীল রাজনীতির সুফল ভোগকারী আরেকটি ছোট্ট দেশ হলো সিঙ্গাপুর। এশিয়ার ‘চার বাঘ’ খ্যাত ছোট দেশগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। বাকি তিন দেশ হচ্ছে- হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অর্থনীতির র‌্যাংকিংয়ে সিঙ্গাপুর যুক্তরাষ্ট্র ও হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিজনেস স্কুল আইএমডি’র র‌্যাংকিং এমনটা জানাচ্ছে। একেকটি দেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং নাগরিকদের কল্যাণ কর্মসূচি বৃদ্ধির পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করতে পারছে, তা বিশ্লেষণ করে এ ক্রম সাজানো হয়ে থাকে। র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে সিঙ্গাপুরের উঠে আসার পেছনে দেশটির সরকারের স্থিতিশীলতা, উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো, দক্ষ শ্রমিকের প্রাপ্যতা, অনুকূল অভিবাসন আইন এবং নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ কাজ করেছে। প্রশ্ন হলো সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ যেখানে কাঁদা আর সমুদ্রের খোলা আকাশ ছাড়া কিছুই ছিল না, সেটি অর্থনৈতিকভাবে এত উচ্চতায় উঠে এলো কীভাবে?
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় দলটি হলো পিপলস অ্যাকশন পার্টি। ১৯৫৪ সালে একটি ছাত্র সংগঠন থেকে। স্বাধীনতাপন্থি এই দলের জন্ম হয়েছিল। দলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লি কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি টানা তিন দশক সরকারপ্রধান ছিলেন। দীর্ঘ তিন দশকের শাসনামলে নিজের প্রচেষ্টা ও যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে এক প্রজন্মেই সিঙ্গাপুরকে তৃতীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এ কারণে তাকে জাতির স্থপতি বলা হয়। লি কঠোরভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে একদলীয় শাসন ধরে রেখেছিলেন। স্থিতিশীল একদলীয় শাসন দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মসৃণভাবে এগিয়ে নিতে পেরেছিলেন। যেভাবে লি একক হাতে দেশের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন, তা যদি বারবার হাতবদল হতো, তা কখনোই সম্ভব হতো না হয়তো। এখনও তার ছেলে শক্ত হাতে দেশকে বিশ্বের অভাবনীয় সাফল্যের দেশে পরিণত করে চলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম উন্নত দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ৩৭ হাজার ৪৯৭ মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ৪২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আধুনিক এ আরব আমিরাতের রূপকার ছিলেন শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। বর্তমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক উন্নয়নের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি তার সুদীর্ঘ ১৮ বছরের শাসনামলে। ২০০৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০২২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ দীর্ঘ সময়ে দেশকে ঢেলে সাজিয়েছেন ইচ্ছেমতো।
স্থিতিশীল রাজনীতির সুফল ভোগকারী অপর দুটি দেশ হলো কম্বোডিয়া ও রুয়ান্ডা। রুয়ান্ডাকে বর্তমানে বলা হয় সিঙ্গাপুর অব আফ্রিকা। বিগত দুই দশকে রুয়ান্ডার অর্থনীতি ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে দেশটি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। এক সময় যে রুয়ান্ডার মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সাথে নিয়মিত লড়াই করত, উপনৈশিকদের সৃষ্টি জাতিগত বিভেদ; হোটি ও টুসসির আত্মঘাতি ‘আত্মহত্যা’র কারণে ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার, তারা এখন স্বপ্ন দেখছে উন্নত ও আধুনিক জীবনের। রুয়ান্ডার মানুষকে এ স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট পল কাগামী বস্তুত ১৯৯৬ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এখনও দেশটি শাসন করছেন। তার এ দীর্ঘ ২৬ বছরের শাসনে (উপ-রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রপতি) পুরো চেহারাই বদলে গেছে রুয়ান্ডার অর্থনীতির। মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মানও। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত মান অর্জনের পথে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে রুয়ান্ডা। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একইরকম চিত্র। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হুন সেন ১৯৯৮ সাল থেকে এখনও দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। কম্বোডিয়ার অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। তার দীর্ঘ ও স্থিতিশীল শাসনামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কম্বোডিয়ার অর্থনীতি।

০৪
পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আর সুষম উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা একান্ত জরুরি। তবে শুধু একটি দেশের স্থিতিশীলতা নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও থাকতে হবে। কেননা, এক দেশের অশান্তি অন্য দেশকে আক্রান্ত করে। সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বরাবরই স্বক্রিয় ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুও গভীরভাবে অনুধাবন করতেন, উন্নয়নের জন্য শান্তিÍ অপরিহার্য। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে যে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতে হাতে। বিগত ১৩ বছরের ধারাবাহিক শাসনামলে শেখ হাসিনা সরকার দেশকে উন্নতির চরম শিখরের দিকে নিয়ে চলেছেন। এক সময় যা অকল্পনীয় ছিল এদেশে, তা এখন পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের ঘরের দোরগোড়ায়। স্বাধীনতার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বতর্মান সরকার কর্তৃক দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু, তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি, যেমন আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মতো কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচন এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কৃষক ও কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে দেশ দ্রুত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ হাসিনার সরকার বিএনপি-জামাত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে এবং সেই সময়কার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এক নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি সুপরিচিত নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার অর্জনের পাশাপাশি নানা সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার ও গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদেরই শুধু নয়, অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, ২০২১ সালে তা ২ হাজার ৮১৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্য হারের ব্যাপক অগ্রগতি সূচিত হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বর্তমানে সেই দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবমতে, ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৭৩.৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে তা ১০.৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের প্রমাণ মেলে তার বার্ষিক আর্থিক পরিকল্পনায়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বিএনপি সরকারের শেষ বছরে বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৬১ হাজার কোটি টাকা। শেখ হাসিনা সরকারের ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের আকার ১১ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা রয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো মহাকাশে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। পদ্মা সেতুর মতো দেশের বৃহত্তর ব্রিজ নিজের টাকায় করে আত্মবিশ্বাস অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে, পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জনের জন্য ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে।

০৫
এক সময় প্রবল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চাপে পিষ্ট হতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ছোটখাটো অভিঘাত এই অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি এখন বাংলাদেশ। আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী পিপিপি’র ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান ৩০তম। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপারস-এর প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বে ২৩তম স্থান দখল করবে। এইচবিএসসি’র প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৬তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলো থেকে এগিয়ে থাকবে।
০৬
১০ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে সর্বস্তরের মানুষের। দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে হয়েছে প্রভূত উন্নয়ন। প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর সেতু দিয়ে গাড়িতে করে মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে সহজেই। ফলে অর্থনীতির প্রসার ঘটছে দ্রুত। বৈদেশিক কোনো সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পাতালরেল নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে দেশের প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চন্দ্রা মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করার পর চন্দ্রা-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন, বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন-রংপুর এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ছয়-লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। নতুন রেলপথ নির্মাণ, নতুন কোচ ও ইঞ্জিন সংযুক্তি, ই-টিকিটিং এবং নতুন নতুন ট্রেন চালুর ফলে রেলপথ যোগাযোগে নব দিগন্তের সূচনা হয়েছে। দেশের সকল জেলাকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনা হচ্ছে। বিমান বহরে ৬টি নতুন ড্রিম লাইনার যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সক্ষমতা আরও বেড়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য রামপাল, মাতারবাড়ি, পায়রা ও মহেশখালিতে মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিশোর ও যুব সম্প্রদায়ের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য প্রতিটি উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম এবং অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশজুড়ে স্থাপিত সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা আজ সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে সুযোগ-সুবিধা। খাদ্যশস্য, মাছ এবং মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। চাল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান চতুর্থ এবং মাছ ও সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। সকলের জন্য সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রতি বছর ২ কোটি ৩ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি, উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকী উদযাপনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রত্যেক লোককে যাদের নিজস্ব বাড়িঘর নেই, তাদের বাসাবাড়ি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন- কেউ গৃহহীন থাকবে না এবং ইতোমধ্যে ১১ লাখের অধিক জনকে বাড়ি দেওয়া হয়েছে।

০৭
উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো দেশে স্থিতিশীলতা থাকা। প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না। বিশৃঙ্খলা চাই না। উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। শান্তির জন্য, উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা চাই। গণতন্ত্রের নামে কথিত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি, হাঙ্গামা, আন্দোলন মূলত দেশের উন্নয়ন ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। আন্দোলন করলে করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, শান্তিপূর্ণভাবে। সব রাজনৈতিক দলগুলোকে দেশের উন্নয়ন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও গণতন্ত্রের হাতিয়ার নয়। ইয়েমেন, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াÑ এসব দেশ এখন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চূড়ান্ত ফল ভোগ করছে। তাদের পুরো অর্থনীতি বলা চলে ভেঙে পড়েছে। মাথাপিছু আয় কমে গেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকারত্ব বরণ করেছে। শিল্প-বাণিজ্য সব মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৭ সালে লিবিয়াতে দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর তাদের মাথাপিছু আয় প্রায় ৬০ শতাংশ কমে গেছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ৭৮৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে কেবল আভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে। আফগানিস্তানের অবস্থাও হয়েছে তাই। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার ফলে লাখ লাখ আফগানি কর্মহারা হয়ে বেকারত্ব বরণ করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো অতি জরুরি পরিষেবা ব্যবস্থা এক প্রকার ভেঙে পড়েছে। আফগানিস্তানে জিডিপির মোটামুটি ৪০ শতাংশই বৈদেশিক সাহায্য। কিন্তু তালিবানদের ক্ষমতা গ্রহণের পর সবরকম বৈদেশিক সাহায্য-সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে দেশটির সাধারণ মানুষ স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে। ইরাকের ক্ষেত্রেও আমরা একইরকম চিত্র দেখেছি। মুগ্ধ এবং আভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এক সময়ের বিপুল সম্ভাবনাময় ইরাকের অর্থনীতিকে একেবারে বসিয়ে দিয়েছে। আমরা সেই অবস্থা কখনও কামনা করি না আমাদের দেশে। এ কারণেই আমরা সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। সবার সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতে চাই। যে কোনো মূল্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। তাহলে খুব সহজেই এক দেশের স্থিতিশীলতার সুফল পাবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ।
সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রীও স্বার্থহীন কণ্ঠে সে-কথাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা আছে বলেই তার ছোঁয়া লেগেছে আসামেও। সম্প্রতি আমি আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করি। তখন মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তার কারণে আমরা নানা দিক থেকে লাভবান হয়েছি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন, কোনো প্রকারের সন্ত্রাস তিনি সহ্য করবেন না মর্মে যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা আমাদের মুগ্ধ করছে।’ তার কারণে বাংলাদেশ কখনোই সন্ত্রাসীদের আবাসস্থলে পরিণত হবে না। সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থানের কারণে। তার এই বক্তব্য ও নীতির কারণে আমরাও লাভবান হয়েছি। এখন বাংলাদেশের মতো আসাম, মেঘালয়েও আর তেমন কোনো সন্ত্রাসী তৎপরতা নেই। আঞ্চলিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ত্রাসী তৎপরতা না থাকায় বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এখন আসামের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য আসছে। আগে যেখানে একটি-দুটি হাসপাতাল ছিল, এখন সেখানে ১৭টি নতুন হাসপাতাল গড়ে উঠছে, তাও আবার প্রাইভেট সেক্টরে। অনেক উন্নয়ন হয়েছে এখানে। এ জন্য আমরা শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আগে বাংলাদেশ রুট ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা সেখানে হামলা করত- এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা খুব দরকার। এই স্থিতিশীলতা যেন আমরা বজায় রাখতে পারি পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে, ভারত, বাংলাদেশ সব জায়গায়, সেটি আমাদের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ স্থিতিশীলতা থাকলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে না। স্থিতিশীলতা থাকলে শুধু একটি দেশের না, প্রতিবেশী রাষ্ট্রেরও উন্নয়ন হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে বলেই সাম্প্রতিক সময়ে বছরে প্রায় ২৮ লাখ মানুষ ভারতে সফর করছে, তাতে ভারতের পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ আজ উন্নত হয়েছে বলেই ভারতের অনেক মানুষ বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। স্থিতিশীলতার কারণেই এগুলো সম্ভব হয়েছে। এ কারণে স্থিতিশীলতাটা জরুরি। বাংলাদেশ সব সময় স্থিতিশীলতার পক্ষে সোচ্চার ও সরব অবস্থানে রয়েছে। কারণ আমাদের এখানে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার মতো দেশি-বিদেশি নানা চক্র যেমন আছে, তেমনই আছে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা। রোহিঙ্গা হলো হতাশাগ্রস্ত স্টেটলেস জাতি। তারা যে কোনো সময় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে ফেলতে পারে। দেশের বাইরে থেকে তাদের ইন্ধন দেওয়া হতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিও তাতে জড়িত থাকতে পারে। এর আগে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি বাইরের শত্রুদের ইন্ধনে কী ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। শ্রীলংকায় এক প্রকার লংকাকা- বাধিয়ে ফেলেছিল তামিলরা। বিভিন্ন বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে লিবারেশন টাইগার অব তালিম ইলমের সদস্যরা দেশব্যাপী ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
দেশজুড়ে গুপ্ত হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, হামলা-হাঙ্গামা বাধানোই ছিল তাদের কাজ। দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তারা শ্রীলংকার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে সে-সময়। বর্তমানে যদিও তাদের কার্যক্রম অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। আমরা সব সময়ই সোচ্চার আছি তামিলদের মতো রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে কোনো পক্ষ যেন দেশের অভ্যন্তরে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে। আগামীর পৃথিবী হবে এশিয়ার। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠী এশিয়া প্যাসিফিকের দিকে অধিকতর নজর দিচ্ছে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ ছাড়াও মার্কিন সরকারের ‘East Quad’, ‘West Quad’ এবং ১৪টি দেশের সমন্বয়ে Indo Pacific Economic Forum (IPEF) তৈরি হয়েছে। তাছাড়া ASEAN ও Colombo Secerity Concave-ও তৈরি হয়েছে। ইউরোপিয়ান-চাইনিজ-মার্কিনীরা বহুবিধ উদ্যোগ নিচ্ছে। চাইনিজরা ‘Global Development Initiative (GDI)’ চালু করেছে। এসব বিভিন্ন তৎপরতায় বাংলাদেশকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে হবে। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এসবের টিপিং পয়েন্টে রয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের সময় দেখা গেছে, বড় শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যার ফলে Global Supply Chain and Global Financial Transaction বাধাগ্রস্ত হয়। এসব থেকে মুক্ত থাকার জন্য আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা (Regional Peace and Stability) রক্ষা করা অতীব প্রয়োজন।
বাংলাদেশ কোনো আইসোলেটেড আইল্যান্ড নয়। অন্যদেশে যখন সাধারণ জনগণ নির্যাতিত হয়, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতবর্ষে, তখন এখানেও তার প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ ও ভারতে উভয় দেশেই কিছু উগ্রপন্থি লোক আছে, যারা কখনও কখনও কোনো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে প্রচার করে। জনমনে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা বা অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়Ñ এদের থেকে সাবধান। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তা উভয় দেশের করা উচিত বৈকি। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, তিনি শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। সুতরাং তাকে কিংবা তার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তা আমাদের করতে হবে।
আমাদের ভুললে চলবে না যে ২০০১-০৬ বাংলাদেশে বোমাবাজি ও সন্ত্রাসীর যে তৎপরতা আমরা অবলোকন করেছি, বাংলাভাই-এর উত্থান, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), হরকাতুল জিহাদ ইসলামী বাংলাদেশ (হোজি.বি) ইত্যাদির উত্থান আমরা কি ভুলতে পারি? ২০০১ সালের নির্বাচনের পরপরই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ হয় তা কি ভোলা যায়? একই দিনে দেশের ৬৪ জেলার ৬৩টিতে ৪৯৫টি বোমাবাজি হয়। ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী সিলেটের মাজারে গেলে তার ওপর বোমাবাজি হয়, যার ফলে তিনি আহত হন এবং দুজন মারা যান। জননন্দিত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএম শামসুল কিবরিয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ ইউনুসকে হত্যা, ফাহিমা-সাবরিনা-মাহিমার ওপর অত্যাচার, এমনকি আদালতের এজলাসে বোমাবাজি এবং সর্বোপরি তৎকালীন মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা যখন সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও বোমাবাজির বিরুদ্ধে জনসভার আয়োজন করেন, তখন ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে সেই র‌্যালিতে গ্রেনেড হামলা ও বোমাবাজির ফলে ২৪ জন সহকর্মী মারা যান, ৩৭০ জন আহত হন। যাদের অনেকে এখনও সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। আমরা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে সেসব অসহনীয় নির্মম ও দুঃস্বপ্নের দিন থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনও সময় সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বাড়িঘর ভাঙার বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। এগুলো যাতে আর কখনও না হয়, তার জন্য সরকার বদ্ধ পরিকর। তবে সরকারের হাতকে এবং বিশেষ করে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন সকল শ্রেণি-পেশার জনগণের সমর্থন ও সাহায্য। তাহলে আমরা এসব কলঙ্ক দূর করে একটি শান্তিময় ও স্থিতিশীল দেশ গড়ে তুলতে পারব। তবে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশের একার পক্ষে পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। অন্যান্য দেশের সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন। এ কারণে আমরা অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বেশি গুরুত্ব নিচ্ছি। আঞ্চলিক দেশগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থেই।
বাংলাদেশের উন্নয়নে গতিধারা ও অভাবনীয় অর্জনগুলোকে ধরে রাখতে এবং টেকসই করতে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও আঞ্চলিক শান্তির জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।

লেখক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য