Thursday, November 30, 2023
বাড়িউত্তরণ প্রতিবেদনইসলামি মূল্যবোধের চর্চা হবে

ইসলামি মূল্যবোধের চর্চা হবে

আরিফ সোহেল: পৃথিবীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে প্রথম মসজিদ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল পবিত্র কাবা শরিফ বা বায়তুল্লাহ। পৃথিবীতে যত মসজিদ নির্মিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে, তা এই পবিত্র কাবাঘরকে কেন্দ্র করে নির্মিত এবং ভবিষ্যতেও হবে তাই। বাংলাদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমান। মুসলিম দেশ হিসেবে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন চতুর্থ রাষ্ট্র। এদেশে প্রতিটি শহর, নগর, গ্রাম ও মহল্লায় মসজিদ রয়েছে। তারপরও বিশেষ বিশেষ দিনে রাস্তায়, খোলা স্থানে মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায়ের কথা চিন্তা করেই আওয়ামী লীগ সরকার দেশব্যাপী বিশেষ মডেলে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদ আছে। এসব মসজিদের বেশির ভাগই জনগণের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয়। ইসলামি মূল্যবোধের প্রসার ও ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশ্যে সারাদেশে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
ইতোমধ্যে দুই ধাপে ১০০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধন করেন। এর আগে তিনি ২০২১ সালের ১০ জুন প্রথম ধাপে ৫০টি মসজিদ উদ্বোধন করেছিলেন।
১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধনকালে তার ভাষণে বলেছেন- ‘আমরা মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছি; কারণ, এতে ইসলামের নামে কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না এবং তাদের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। মডেল মসজিদে ইসলামি মূল্যবোধের চর্চা হবে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আরও বাড়বে, ইসলামি সংস্কৃতি লালন ও বিকাশের আরও সুযোগ থাকবে এবং ইসলাম ধর্মকে আরও উন্নতভাবে পালনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, ‘আমি এটুকুই চাই, আমাদের দেশে সত্যিকারের ইসলামের জ্ঞান চর্চা হোক। কেননা আমরা ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করেছি, তাছাড়া মসজিদ পাঠাগার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ২ হাজার ৫০০টি নতুন পাঠাগার স্থাপনে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ৬৪৭ জন ইমামকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, ৯৫ হাজার ৮৫ জনকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ৩৪ হাজার ৩২৩ জন ইমামকে অন্যান্য প্রশিক্ষণ এবং ৩ হাজার ৬১৩ জন ইমামকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।
১৬ জানুয়ারি ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান এমপি এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান বক্তব্য দেন। এছাড়া কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম, রাজশাহী ও শরীয়তপুর থেকেও কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ। অনুষ্ঠানে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ওপর একটি ভিডিও-ডকুমেন্টারিও প্রদর্শন করা হয়।

মডেল মসজিদের বিশেষত্ব
শুধু নামাজ আদায় নয়, ইসলামি গবেষণা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মসজিদ ব্যবহার করা মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। বিশ্বে এই প্রথম কোনো সরকার একসঙ্গে এতগুলো মসজিদ নির্মাণ করছে। মডেল মসজিদগুলোর অবকাঠামো নকশা, নান্দনিক স্থাপত্য নির্মাণশৈলী সবাইকে মুগ্ধ করে। তিন ক্যাটাগরির মসজিদগুলো প্রায় একই ঢংয়ের। মডেল মসজিদগুলো ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মিত হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে চারতলা, উপজেলার জন্য তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। তিন ক্যাটাগরির মসজিদগুলো-
১. ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৬৯টি চারতলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এই মসজিদগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন রাখা হয়েছে ২৩৬০.০৯ বর্গমিটার। এই মসজিদগুলোয় থাকছে লিফট।
২. ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে ৪৭৫টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ১৬৮০.১৪ বর্গমিটার এবং
৩. ‘সি’ ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন হচ্ছে ২০৫২.১২ বর্গমিটার। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নিচতলা ফাঁকা থাকবে।
৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। একেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে জেলা শহর ও সিটি কর্পোরেশনে ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা; উপজেলা পর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। জেলা সদর ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নির্মাণাধীন মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন।
আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত সুবিশাল এসব মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নারী ও পুরুষদের আলাদা ওজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা থাকছে। এছাড়া লাইব্রেরি, গবেষণা কেন্দ্র, ইসলামিক বই বিক্রয় কেন্দ্র, হেফজ বিভাগ, শিশু শিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ, অটিজম কেন্দ্র, গণশিক্ষা কেন্দ্র, ইসলামি সংস্কৃতি কেন্দ্র থাকবে। লাইব্রেরি সুবিধার আওতায় প্রতিদিন ৩৪ হাজার পাঠক একসঙ্গে কোরআন ও ইসলামিক বই পড়তে পারবেন। গবেষণার সুযোগ থাকবে ৬ হাজার ৮০০ জনের। ৫৬ হাজার মুসল্লি সবসময় দোয়া, মোনাজাতসহ তসবিহ পড়তে পারবেন। মূল মসজিদটি হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। অসুস্থ ও প্রতিবন্ধী মুসল্লিদের জন্য আলাদা র‌্যাম্প থাকবে।

ফিরে দেখা ইতিহাস
মসজিদ আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ সমর্পিত হওয়ার পবিত্র স্থান। ভারতীয় উপমহাদেশের চণ্ডীগড়ে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়েছে ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় এক সাহাবি মালিক ইবনে দিনার (রা.) ‘চেরমান জুমা মসজিদ’ এটি নির্মাণ করেন। কাছাকাছি সময়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মামা আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। ধারণা করা হয়, ওই সময়ে লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রামে তিনি একটি মসজিদও নির্মাণ করেন। যা ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার করে সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ নামে প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল।
বারো শতকের শেষের দিকে ঘোরী বংশীয়দের দিল্লি­ অধিকারের পর থেকেই ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজ বিকশিত হতে থাকে। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজির বঙ্গবিজয় থেকে সূচনা হয় বাংলায় মুসলিম শাসনের। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে এ অঞ্চলে শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়; ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। বখতিয়ার খলজীর শাসনামলে ভারতবর্ষে অসংখ্য ‘মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ’ নির্মাণ করেছিলেন। বিশেষ করে ১৩৪২ থেকে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে বিরল স্থাপত্য নির্মাণশৈলী সম্পন্ন একের পর এক মসজিদ গড়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মধ্যযুগে সপ্তাশ্চার্যের অন্তর্ভুক্ত তাজমহল মুঘলদেরই নির্মিত একটি মুসলিম স্মৃতিসৌধ। ঢাকার নারিন্দায় অবস্থিত ‘বিনত বিবির মসজিদ’ এখনও ইতিহাসের বড় সাক্ষী। ১৪৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলে তার কন্যা মুসাম্মাত বখত বিনত বিবি বাংলাদেশ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৬৭৮ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে তার পুত্র ও ঢাকার তৎকালীন গর্ভনর মুহাম্মদ আযম শাহ লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরীণ স্থাপনা হিসেবে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
দেশব্যাপী মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৃণমূল পর্যায়ে ইসলাম ধর্মের সঠিক প্রচার-প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বিশুদ্ধ আলেম-উলামার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে। সরকারের এসডিজিএস-র অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনেও এ প্রকল্প ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য