Monday, December 4, 2023
বাড়িছোট গল্পইতিহাসের মিথ ও মিথের ইতিহাস

ইতিহাসের মিথ ও মিথের ইতিহাস

শাহাব আহমেদ

লের্মন্তভের ডেমন কাব্য কাহিনির তামারা ভালোবেসে একাই ধ্বংস হয়নি। মানুষের ইতিহাসে অনেকেই হয়েছে। দৃষ্টান্তের আদি-অন্ত নেই। মাঝে মাঝে ভাবি লের্মন্তভের মানবপ্রেমী এই ডেমন যদি পৃথিবীতে এসে মানবিক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেয় লাল পতাকা হাতে, তার অনুসারীর অভাব হবে কি?
লের্মন্তভের ডেমনের তুলনায় ইতালির মেদিচি পরিবারের শাসক-পিতারা কি ভালো ছিলেন? অথবা তাদের উৎখাত করে আসা সাভনারোলা?
হিটলার?
আসলে এগুলো বাজে প্রশ্ন।
সময় নষ্ট না করে আমরা তামারার জর্জিয়ায়ই ফিরে যাই। স্ভেতলানা আলুলুয়েভা তার ‘বন্ধুকে বিশটি চিঠি’ বইতে কিছু তামারা, কিছু মানুষ ও কিছু ডেমনের গল্প লিখেছেন। আমি এই বই থেকে কিছু বর্ণনা করছি।
স্ভেতলানা ছিলেন স্তালিনের মেয়ে। স্তালিন সচরাচর আবেগ প্রকাশ করতেন কম।
কিন্তু আশৈশব স্ভেতলানা পিতার স্নেহ পেয়েছেন অনেক, তার ভাই ভাসিলি ছিল দুষ্ট, তাই পিতার শাসন জুটেছে বেশি কিন্তু স্নেহ বঞ্চিত হয়নি সেও। ওদের একজন বড় ভাই ছিল, ইয়াকভ, অন্য মায়ের সন্তান, তার ব্যাপারটা ছিল জটিল। তার প্রসঙ্গ আসবে।
স্ভেতলানার শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠার পরে দেখা পারিপার্শ্বিক জগৎ ও অতি আপনজনের গল্প নিয়ে লেখা এই বইটি। মূল রুশ ভাষায় অনবদ্য একটি সাহিত্যকর্ম।
রুশ প্রকৃতির বর্ণনা, রুশ মানুষের অন্তর্জগতের দেশপ্রেমের ফল্গুধারা এর প্রতিটি পাতায় পাতায়। ‘আমি কোনোদিন রাশিয়া ছেড়ে যাব না’ এ-কথা বারবার উচ্চারণ করা সত্ত্বেও তাকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল তার পিতার গড়া ভূস্বর্গ। কিন্তু এই যেতে না চেয়েও চলে যাওয়ার ইতিহাস রাশিয়ায় অন্তহীন। স্ভেতলানার গল্পটুকু তাই অত্যন্ত মর্মস্পর্শী।
সবাই জানে ‘স্তাল’ থেকে স্তালিন।
‘স্তাল’ মানে ইস্পাত। স্তালিন মানে ইস্পাত দিয়ে তৈরি।
সক্রেটিস নিজেকে জানতে বলেছিলেন। অসম্ভব এ কাজটি পৃথিবীর খুব কম লোকই করতে পেরেছে। স্তালিন পেরেছিলেন বলেই ১৯১২ সালে নিজেই নিজের নাম দিয়েছিলেন স্তালিন। রক্ত মাংসের তৈরি দুর্বল মানুষ তিনি নন, ইস্পাতের তৈরি, শক্ত, অনমনীয় ও অভঙ্গুর। যে কোনো বিপ্লবের জয় বা পরাজয়ের জন্য প্রয়োজন এ ধরনের মানুষ।
নেপোলিয়ন যেমন জয়, না পরাজয়ের প্রতীক কেউ হলফ করে বলতে পারে না, ঠিক তেমনি তার ক্ষেত্রে। স্তালিন হওয়ার আগে তার নাম ছিল কোবা এবং সোসো। তিনি যেমন সাহসী তেমনি মেধাবি ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই বিপ্লবী আন্দোলনে নেমেছেন এবং অনেক বইও পড়েছেন। মেকিয়াভেলিও হয়তো পড়ে থাকবেন।-
It is much more secure to be feared than to be loved.- এ বাক্যটি তার মনে গেঁথে গিয়েছিল।

“তোমার সম্পর্কে খুব বেশি জানে যারা, তারা তোমার ক্ষমতার সবচেয়ে বড় শত্রু।” এ বাক্যটি তিনি কোথায় পড়েছেন, তা তারও মনে নেই, আমারও। হয়তো তিনি কোথাও পড়েনইনি, শুধু আমারই মস্তিষ্ক প্রসূত। অথবা কে জানে, আইভান দি টেরিবলও ফিসফিস করে থাকতে পারেন।
ইস্পাতের তৈরি কোবা, যদিও তখন স্তালিন হননি, আপাদমস্তক প্রেমে পড়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বিপ্লবী বন্ধু আলেকসান্দর স্ভানিদজের বোন ইকাতেরিনা স্ভানিদজের। ‘কাতো’ ছিল তার ডাক নাম। সময়টা বড় কঠিন। ১৯০৫ সালের রক্তাক্ত প্রথম রুশ বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। বিপ্লবীদের কিছু মৃত, কিছু নির্বাসনে, কিছু জেলে, বাকিরা আত্মগোপনে।
ইস্পাতের বুকে প্রজ্বলিত ভালোবাসার আগুনে বিশুদ্ধ হন কোবা। কাতোকে বিয়ে করেন ১৯০৬ সালে। পরের বছরেই তাদের ছেলে ইয়াকভের জন্ম হয়। কিন্তু মাত্র আট মাস পরে টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে কাতো মারা যায় স্তালিনের কোলে। মাত্র ২২ বছর বয়েস ছিল কাতোর! সুন্দর ও পবিত্র ফুলের মতো। ঝরে পড়ার সময় মোটেই নয়।
কোবা শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েন। কাতোর কফিন যখন কবরে নামানো হয় তিনি ঝাঁপ দেন কবরে। এত বড় বিপ্লব যার ভাগ্যে লেখা, তার বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়। তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন এই ভয়ে বন্ধুরা তার রিভলভার কেড়ে নেয়। তিনি বলেন : “এই প্রাণীটি (This creature) আমার পাথরের হৃদয় নরম করে দিয়েছিল। সে মারা গেল। সেই সাথে মারা গেল মানবজাতির প্রতি আমার উষ্ণ অনুভূতি।”
পাথরের হৃদয়! মানবজাতির প্রতি উষ্ণ অনুভূতি! হ্যাঁ, তার বাক্যে কথাগুলো ছিল হয়তো কাকতালীয়। কারণ যে কোনো যুবা-বিপ্লবীর মতো তিনিও একটা-দুটো কবিতা লিখতেন তখন। এবং খারাপ লিখতেন না, পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছে কিছু।
মেদিচি উত্তর ফ্লোরেন্সে সাভনারোলাও না-কি এক নারীর প্রেমের প্রত্যুত্তর না পেয়ে বুকে পাথর ধারণ করেছিল। এবং হয়তো এমনই কিছু কথা উচ্চারণ করেছিল। সময়ে নিঃস্ব ও দরিদ্রের মঙ্গল ও অধিকার নিশ্চিত করার  স্লোগান তুলে মহাসন্ত্রাস ও রক্তের হোলি উৎসবে মেতেছিল সেই ব্যথিত প্রেমিক। কিন্তু সে অন্য গল্প, যদিও এ গল্পগুলো ফিরে ফিরে আসে।
কোবা তার ছেলে ইয়াকভের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। আবার নিবিষ্ট হন শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। মামা আলেকসান্দার স্ভানিদজে ও মামি মারিয়া পিতা-মাতার স্নেহবঞ্চিত ইয়াকভকে মানুষ করেন।
কাতোর আরও একটি বোন ছিল মারিকো, সেও ছিল ইয়াকভের খুব কাছের মানুষ। শুধু অতি বিশাল ও অতি দূরের পিতার সাথে উষ্ণ সম্পর্ক কোনোদিনই গড়ে ওঠেনি ইয়াকভের।
১৯২১ সালে ইয়াকভ উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনে মস্কো আসে। ততদিনে পিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন (১৯১৯ সালে), নাদিয়েঝদা আলুলায়েভা এখন তার সৎ-মা। নাদিয়েঝদা শব্দের অর্থ আশা। ডাক নাম নাদিয়া। অতি সজ্জন, স্নেহময়ী, রুচিশীল ও কঠিন শৃঙ্খলার সাহসী এক রুশ নারী। সাদাকে সাদা বলেন, কালোকে কালো।
ধানাই-পানাইয়ের ধূসরতা তার সহ্য হয় না।
নাদিয়ার বাবা-মা-বড় ভাই সবাই বিপ্লবী। কোবা তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন বহু আগ থেকেই। তাদের বাসায় আত্মগোপন করে থেকেছেনও অনেক। বাবা সের্গেই আলুলুয়েভ এবং মা ওলগা আলুলুয়েভা দুজনেই ছিলেন বলশেভিক পার্টির সক্রিয় সদস্য এবং লেনিনের সাচ্চা সহচর।
তাদের চার সন্তান : পাভেল, আন্না, ফিওদর ও নাদিয়া।
নাদিয়ার কিশোরী বুকে তীব্র ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল গোপনে গোপনে তাদের বাসায় পালিয়ে থাকতে আসা বিপ্লবী কোবার প্রতি। জাপানের মুরাসাকি শিকিবুর ‘টেল অব গেঞ্জি’র গেঞ্জি যেমন জোর করে তারই গৃহে আশ্রিতা কিশোরী ভায়োলেটের পবিত্রতা ভায়োলেট করেছিল, নিন্দুকে বলে, ঠিক তেমনিভাবে এক ধ্বংসাত্মক অথবা মিলনাত্মক রাতে ১৬ বছর বয়সী নাদিয়াকে জোর করে গ্রহণ করেছিল পিতার ইস্পাত-তপ্ত বিপ্লবী বন্ধুটি। নাদিয়া তাকে ভালোবাসতো, তাই অপ্রত্যাশিত এই অন্দর প্রবেশের ক্ষত শুকিয়ে কোবার হাত ধরে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে। কথিত আছে যে, নাদিয়া দুই বছর বয়সে জলে পড়ে গিয়েছিল এবং কোবা তার জীবন রক্ষা করেছিল। কিছু প্রেমের ইতিহাস বড় কাকতালীয়ভাবে শুরু হয়।
তারপরে আসে বিপ্লব।
কোবা ততদিনে কমরেড স্তালিন, জাতিবিষয়ক মন্ত্রী এবং তার সেক্রেটারি নাদিয়া।
জর্জিয়ার রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সময় স্তালিন সেখানে যান। সাথে যায় নাদিয়া ও নাদিয়ার ভাই ফিওদর আলুলুয়েভ। ফিওদর হত্যা, রক্ত, আহাজারি, মৃত্যুর নরকে গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এর পৈশাচিকতার তীব্রতায় পাগল হয়ে যায়। অথচ সে ছিল অসম্ভব মেধাবি, সেরা ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পেরেছিল। তবে এই পাগল হয়ে যাওয়া তার জন্য সাপেবর হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের পরিবারের ওপর যে ডেমন ভর করে একে একে সবাইকে হত্যা করে, তার চক্ষু এড়িয়ে একমাত্র সে-ই বেঁচে থাকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু সেটি আরও একটু পরের গল্প। স্তালিন ও নাদিয়া জর্জিয়ায় বিয়ে করেন সবার অবর্তমানে। তখন নাদিয়ার বয়স ছিল মাত্র ১৭ এবং স্তালিনের ৩৯।
নাদিয়ার চুম্বক ব্যক্তিত্বের কারণে আলুলুয়েভ পরিবার ও স্তালিনের প্রথম স্ত্রী কাতোর স্ভানিদজে পরিবার এক পরিবারে পরিণত হয়। তারা সবাই কাছাকাছি বাস করতে থাকে বিপ্লবের পরে পালিয়ে যাওয়া কোনো এক শিল্পপতির বনাশ্রয়ী জুভালোভা গ্রামে। তাদের সূর্যালোকিত বাড়ির পাশেই থাকেন বিপ্লবী মিকোইয়ান এবং আরও কিছু বিশাল বলশেভিক।
সবাই সোভিয়েত রাষ্ট্রের কোনো-না-কোনো বড় পদে অধিষ্ঠিত।
সবাই একসাথে মিলিত হয়, একসাথে উৎসব করে।
শিশুরা খেলা করে।
ক্রেমলিন থেকে বড় বড় কমরেডের পরিবারগুলো যোগ দেয় সে-সব আনন্দ আড্ডায়। গ্রীষ্মে তাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকার জন্য মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন প্রাণী পাগল বুখারিন। সাথে আসে তার সজারু, ঢোড়া সাপ, শেয়াল আর খাঁচাবদ্ধ আহত ঈগল। তাকে সবাই ভালোবাসতো। স্ভেতলানার আবছা চোখে ভাসে তার মুখ, স্যান্ডেল পায়ে, গ্রীষ্ম প্যান্ট পরা আত্মভোলা মানুষটি বাচ্চাদের সাথে খেলছেন অথবা সাইকেল চালাতে শিখাচ্ছেন তার ন্যানিকে।
কী যে ভালোবাসতো শিশুরা অভূত বিদ্বান অথচ শিশুর মতো এই পরিশীলিত মানুষটিকে।
অনেকদিন পরে যখন তিনি ‘নাই হয়ে যান’, ক্রেমলিনের ভিতরে কখনও কখনও সেই শেয়ালটিকে দৌড়াতে দেখা যেত এবং লোকে বলতো ‘দেখো, দেখো বুখারিনের শেয়াল।’
গ্রীষ্ম কাটাতে আসতেন অরদ্ঝোনিকিদজে। ভরোশিলভ, মলোতভ, বুদিওনি আরও কত কত মানুষ। অতি ব্যস্ত পিতাও তখন সুখী ছিলেন। স্ভেতলানা কি সুন্দর নস্টালজিক বর্ণনা দেন তার শৈশবের সেই সময়টার।
মস্কো ফিরে ইয়াকভ ক্রেমলিনে থাকতে শুরু করে সবার সাথে। নাদিয়া তাকে স্নেহ করতেন। বয়সেও ছিলেন ইয়াকভের চেয়ে মাত্র সাত বছরের বড়।
ইয়াকভ জয়া নামে তার এক সহপাঠীর প্রেমে পড়ে এবং তারা গোপনে বিয়ে করে। তাদের একটি সন্তানের জন্ম হয়। নাদিয়া সহানুভূতিশীল থাকলেও পিতা জানতে পেরে রাগে উন্মত্ত হয়ে পড়েন। আগুনে ঘি পড়ে তিনি যখন জানতে পান যে জয়া কমিউনিস্ট নয়, একজন ধর্মযাজকের মেয়ে। ইয়াকভকে বাধ্য করা হয় জয়ার সাথে সংশ্রব ত্যাগ করতে। ১৯২৯ সালে তাদের শিশুটি মারা যায়। নীলকণ্ঠ জীবন দুঃসহ হয়ে পড়ে ইয়াকভের জন্য। সে কোনো আলো দেখতে পায় না চারদিকে, না কোনো মানবিক উষ্ণতা।
সে পিস্তলের গুলি চালায় নিজের ওপরে; কিন্তু ব্যর্থ হয়। পিতা শ্লেষ করে বলেন : ‘এমনই অপগ-ো, সোজা করে গুলিটাও ছুড়তে শিখেনি।’
ইস্পাতের তৈরি যে মানুষ তার কাছ থেকে কোমলতা আশা করলে একটু বেশিই চাওয়া হয়।
বিয়ে-পরবর্তী ১৪ বছর এক দুঃসহ রোলার কোস্টারে জীবন কাটান নাদিয়া। স্বামীর ডেসপটিজম ও দুর্ব্যবহারের কারণে তাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে তিক্ত হয়ে ওঠে। যদিও তিনি ভালোবাসতেন স্বামীকে।
তিক্ততার চরমে ১৯২৬ সালে নাদেঝদা ক্রেমলিন ছেড়ে বাবা-মার কাছে লেনিনগ্রাদে চলে যান। লেনিনগ্রাদের সেক্রেটারি তখন সের্গেই কীরভ, অত্যন্ত মেধাবি ও প্রজ্ঞায় পরিশীলিত। নাদিয়ার ব্যক্তিত্বের চুম্বকত্ব তাকেও খুব করে কাছে টানে। নাদিয়ার বাবা-মার অ্যাপার্টমেন্টে স্থান অপর্যাপ্ত।
তিনি তাকে অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু নাদিয়া জানেন তার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপরে দৃষ্টি রাখা হয়। তিনি সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেন ‘মস্কোর সর্বদর্শী’ দুই চোখ থেকে কীরভকে নিরাপদ দূরত্বে রাখার। অসম্ভব সন্দেহপরায়ণ তার স্বামী। কিছুদিন পরে স্তালিন তাকে মস্কো ফিরিয়ে আনেন।
সীমাহীন বিষণœতায় দিন কাটে তার। স্তালিন আপাদমস্তক কাজে ব্যস্ত। পুরনো বিশ্বস্ত ও ত্যাগী সব বলশেভিক নেতারা ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘প্রতিবিপ্লবী’, ‘বিদেশের চর’ ইত্যাদি বিশেষণ নিয়ে কেউ পার্টি থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, কেউ যাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডে; কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছেন না। অভিযোগগুলো তার বিশ্বাস হয় না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারেন না। একদিকে তার স্বামী, অন্যদিকে আবাল্য দেখে আসা পিতার বিপ্লবী বন্ধুরা, যাদের অনেকেই তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। এই আত্মবিধ্বংসী বিষণœতা থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেন নিকোলাই বুখারিন।
নাদিয়া ১৯৩২ সালের শরৎকালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল একাডেমিতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শুরু করে। এখানে তিনি ইউক্রেনের কিছু ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে জবরদস্তিমূলক সমবায়করণের ফলে সৃষ্ট দুষ্প্রমেয় দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু (গলোদামর) সম্পর্কে জানতে পান। বাড়িতে স্বামীর সাথে এ নিয়ে তর্ক হয় এবং তার ভ্রান্ত পলিসির সমালোচনা করেন। ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষ ছিল রাষ্ট্র ও পার্টির সিক্রেট, নাদিয়ার জানার কথা নয়। সমস্ত পত্র-পত্রিকা থেকে এই খবর গোপন করা হয়েছিল। স্বামীর সাথে বিতর্কের পরে নাদেঝদার ইউক্রেনের সহপাঠীরা নিখোঁজ হয়ে যায়। ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর রাতে অক্টোবর বিপ্লবের ১৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে কমরেড ভরোশিলভের বাসায় ডিনার পার্টিতে সবার সামনে স্তালিন ও নাদিয়ার তুমুল তর্ক হয় এবং স্তালিন তার সাথে রুক্ষ ব্যবহার করেন। পরের দিন ভোরে নাদিয়াকে বেডরুমে মৃত পাওয়া যায়। বলা হয় তিনি বড় ভাই পাভেলের জার্মানি থেকে নিয়ে আসা উপহার, ছোট্ট একটি পিস্তল ব্যবহার করে আত্মহত্যা করেছেন। দ্বিতীয় ভাষ্য গভীর রাতে স্তালিন নাদিয়ার বেডরুম থেকে বের হয়ে আসেন নিজে নাদিয়াকে হত্যা করার পর। তৃতীয় এবং সরকারি ভাষ্যে বলা হয়, নাদিয়া অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কারণে মারা গেছেন (এই ভাষ্যে আত্মহত্যার কথা নেই)।
স্ভেতলানার বয়স তখন ছিল মাত্র ছয় এবং ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সে শুধু সরকারি ভাষ্যটিই জানত। মৃত্যুর কারণ যাই হোক স্তালিনের জন্য এই মৃত্যু খুব দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তিনি খুবই ভেঙে পড়েন। তার মনে হয় নাদিয়া সর্বসমক্ষে তাকে হেয় করার জন্য আত্মহত্যা করেছে।
স্তালিনের প্রিয়পাত্র বেরিয়াকে নাদিয়া একদিনের জন্যও বিশ্বাস করতেন না। জর্জিয়ার রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সময় বেরিয়া বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বন্দী হয়েছিল বলশেভিকদের হাতে এবং ককেশিয়ার বিপ্লবের নাড়ি-নক্ষত্র জানা কীরভ আদেশ দিয়েছিলেন তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করার। কিন্তু শহরে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় সবাই যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং বেরিয়ার কথা ভুলে যায়।
সময়ে সে স্তালিনের বিশ্বাসভাজন হয়ে জর্জিয়ার পার্টি সেক্রেটারির দায়িত্ব পায় এবং সব পুরাতন বলশেভিকদের একে একে হত্যা করায়। এই পুরাতনদের মধ্যে যারা জীবিত ছিল তারা হলো স্তালিনের প্রথম স্ত্রী কাতো’র স্ভানিদজে পরিবার, এবং দ্বিতীয় স্ত্রী আলুলায়েভ পরিবার। স্ভেতলানার খালু এনকেভিডি’র প্রভাবশালী নেতা রেদেন্সকে সে জর্জিয়া থেকে সরে আসতে বাধ্য করে।
স্ভেতলানার মতে, যদিও সবাই তার পিতার দিকে তর্জনি নির্দেশ করে; কিন্তু এটা তার পিতা নয়, বেরিয়া কীরভকে হত্যা করিয়েছে। কীরভ বেঁচে থাকলে বেরিয়া এত ক্ষমতাধর হতে পারত না এবং তার পরিবারের সবাই রক্ষা পেত। সুতরাং স্তালিন পরিবারের সবাই জানত বেরিয়া একটি সাপ। কিন্তু স্তালিন বেরিয়াকে বিশ্বাস করতেন। বেরিয়া আস্তে আস্তে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, তার স্ত্রীদের আত্মীয়রা তার শত্রু।
আলেকসান্দার স্ভানিদজেকে (ইয়াকভের পালক পিতা ও স্তালিনের বিপ্লবী বন্ধু) দেশের শত্রু হিসেবে নির্যাতন করা হয় ১৯৩৭ সাল থেকে; কিন্তু তাকে ভাঙা যায়নি। মাথা উঁচু করেই সে ফায়ারিং স্কোয়াডে যায় ১৯৪১ সালে। স্ভেতলানা আলুলুয়েভার ভাষ্যে : ‘সাহস, সততা ও কঠিন আত্মনিয়ন্ত্রণের কারণে তাকে জীবন দিতে হয়েছে।’
আলেকসান্দার স্ত্রী মারিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল একই সাথে। গুজব আছে যে (স্ভেতলানার বইতে এ তথ্য নেই), নেতার সাথে মারিয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মারিয়া নিয়মিত ডায়েরি লিখত এবং তার মধ্যে এ-সম্পর্কে কিছু তথ্য ছিল। ডায়রিটি না-কি এখনও স্তালিন মিউজিয়ামে আছে এবং তার কয়েকটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গায়েব করা হয়েছে। এই ডায়রিতে ইঙ্গিত ছিল যে, স্ভেতলানার মামি, পাভেলের স্ত্রী ঝেনিয়া তাকে টেক্কা দিয়ে স্তালিনের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে এবং তার ভাগ্য পোড়ে।
মারিয়া স্ভানিদজে গুলাগে পাঁচ বছর কাটানোর পরে ঝেনিয়াকে গোপনে একটি চিঠি পাঠাতে সক্ষম হয়। সেখানে সে তার মুক্তির ব্যাপারে স্তালিনের সাথে কথা বলার অনুরোধ করে। সে জানত যে ঝেনিয়া তখন নেতার ডি ফ্যাক্টো গৃহকর্ত্রী। উপযুক্ত সময় বুঝে ঝেনিয়া কথাটি তোলে। কিন্তু নেতা রাগে ফেটে পড়েন। বলেন, ‘এই নাম যেন তার সামনে আর উচ্চারণ করা না হয়।’
একদিন যে তার প্রিয় নারী ছিল, আজ তিনি তার নাম শুনতে চান না।
পুরুষের এমন হয়।
তার মাত্র কিছুদিন পরেই মারিয়াকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয় কাজাকস্থানে। স্ভেতলানার এসব জানার কথা নয় এবং তার বইতে এ তথ্যগুলো নেই।
মারিয়া ও আলেকসান্দার স্ভানিদজের গ্রেফতারের সময় তাদের ছেলে জনরীড স্ভানিদজের বয়েস ছিল মাত্র ১০। তাকে দেশ শত্রুদের সন্তানদের জন্য চিহ্নিত বিশেষ এতিমখানায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে বড় হয়ে সে বিশ্বাস করতে শেখে যে, তার পিতামাতা আসলেই ছিল দেশের শত্রু। কিন্তু তারপরেও গুলাগ সে এড়াতে পারে না। বন্দী থাকে স্তালিনের বেঁচে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত। মারিয়ার এক ভাইও নিপীড়ন এড়াতে পারেনি।
স্তালিনের প্রথম স্ত্রী কাতোর বোন মারিকো ১০ বছর কাজ করে জর্জিয়ার বিখ্যাত বলশেভিক আবেল এনুকিদজের সেক্রেটারি হিসেবে। এনুকিদজে ছিলেন স্তালিন পরিবারের খুব নিকট বন্ধু এবং নাদিয়ার গডফাদার। ১৯৩২ সালের ৯ নভেম্বর সকালে নাদিয়াকে মৃত অবস্থায় পেয়ে নার্স স্তালিনকে জানাতে ভয় পেয়ে প্রথম কলটি করে এনুকিদজেকে এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যে মৃত নাদিয়াকে দেখতে পায়। তিনি কি এমন কিছু দেখেছিলেন, যা কারও জন্য কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে? ১৯৩৭ সালে আবেল ইয়েনুকিদজেকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানো হয়। আর মারিকোকে ১৯৪২ সালে।
রেদেন্সের কথা আগে বলেছি, তিনি বস্তুত ছিলেন এন কে ভিডির দ্বিতীয় ব্যক্তি। নাদিয়ার বড় বোন আন্নার স্বামী ও স্ভেতলানার খালু। স্তালিনের টেররে অংশগ্রহণকারী এক অতি সক্রিয় নেতা। অসম্ভব রক্তাক্ত ছিল তার হাত। ১৯৩৭ সালে তাকে ও নিকোলাই ইঝভকে লেনিন পদক দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৩৭ সালের শেষ দিকেই ইঝভ ও রেদেন্সের ভাগ্য নির্ধারণকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয় গুপ্তচরবৃত্তি ও স্তালিনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে। প্রায় একই সময়ে ইঝভও ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং বেরিয়া হয় স্তালিনের পরে সর্বক্ষমতাধর।
আন্না বেরিয়া ও স্তালিন দুজনেরই কাছে ছুটে যায়। তাকে চুপ থাকতে বলা হয়। ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে রেদেন্সকে হত্যা করা হয়।
১৯৪১ সালের জুন মাসে যুদ্ধ বাধে। ইয়াকভ প্রথম দিনেই লাল ফৌজে নাম লেখায় একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে। তাকে পাঠানো হয় যুদ্ধের সবচেয়ে ক্রুরতম স্থানে যেখানে তখনও মানুষ মরছিল পাখির মতো আর হিটলারের বাহিনীর অগ্রযাত্রা তখনও ছিল অপ্রতিহত। পিতা জানতেন ফ্রন্টের অবস্থা, তিনি ইয়াকভকে থামাননি; বরং বলেছেন, ‘যাও যুদ্ধ কর।’ অন্যদের মতো মারা যাওয়া তার ভাগ্যে ছিল না।
সে এক মাস পরেই জার্মানদের হাতে বন্দী হয়।
“দেশপ্রেমিক যুদ্ধে মারা যায়, যুদ্ধবন্দি হয় না। বিশ্বাসঘাতক ও স্বপক্ষ ত্যাগকারীই শুধু বন্দী হয়- এই ছিল পিতার দৃঢ় বিশ্বাস।
তাই বিশ্বাস করত পার্টি ও তার ক্ষমতার সংস্থাগুলো। তাই যে বন্দী হতো, তার পরিবারকে তছনছ করে ফেলা হতো।
তার বাপ-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী শাস্তি ভোগ করত গুলাগে। এখানেও ব্যতিক্রম হয় না।
কেন যেন পিতার মনে হয় ইয়াকভের বন্দী হওয়াটা একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
ইহুদি ষড়যন্ত্র।
ইয়াকভের স্ত্রী জুলিয়া ছিল ইহুদি। সে এবং তার মা দুজনে মিলে ইয়াকভকে প্ররোচিত করেছে স্বেচ্ছায় জার্মানদের কাছে ধরা দিয়ে পিতাকে ডিসক্রেডিট করার। ইয়াকভের তিন বছরের মেয়েকে মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জুলিয়াকে গুলাগে পাঠানো হয়। সাথে জেলে পোড়া হয় জুলিয়ার মাকেও।
প্যারানয়া বলে কথা। প্যারানয়ার মা-বাপ ছিল না কোনোদিনই। স্তালিনের তিন বছরের নাতনি যায় শত্রু-সন্তানদের জন্য নির্ধারিত স্পেশাল অনাথ আশ্রমে।
নিজের রক্তের রক্ত।
তিনি সত্যিই ইস্পাত দিয়ে তৈরি।
লের্মন্তভের ডেমনের ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। মানবজাতির জন্য এক মহান সমাজ তৈরির ব্রত নিয়েছেন তিনি এবং দুনিয়াব্যাপী কত অনুসারী তার! কত বড় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, নাট্যকর্মী!
জীবতকালে যে কোনো নবীর চেয়ে বেশি তার পূজারী।
জার্মানরা ইয়াকভের বন্দী হওয়া নিয়ে প্রচুর প্রপাগা-া চালায়, প্লেন থেকে লিফলেট বিতরণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে, ‘দেখো, স্তালিনের ছেলে আত্মসমর্পণ করেছে, তোমরাও আত্মসমর্পণ করো।’
কিন্তু দু-বছরের মাথায় ১৯৪৩ সালে স্তালিনগ্রাদে জার্মানদের বিষদাঁত ভেঙে দেয় সোভিয়েত জনগণ। ফিল্ড মার্শাল পাওলাসসহ বহু জার্মান সৈন্য বন্দী হয়।
ওরা প্রস্তাব পাঠায় ইয়াকভের বিনিময়ে পাওলাসের মুক্তি।
পিতা বলেন, ‘আমি লেফটেন্যান্টের সাথে ফিল্ড মার্শালের বিনিময় করি না।’
কঠিন সিদ্ধান্ত। যুদ্ধের সেই উত্তপ্ত সময়ে তার সামনে হয়তো অন্য কোনো পথ ছিল না। হয়তো জাতির লাখো কোটি পিতামাতার সামনে, যাদের সন্তানেরাও ছিল বন্দী, নিজের ছেলেকে বেছে নেওয়া ছিল অসম্ভব।
সেটা ছিল তার মহত্ত্ব, না যুদ্ধের শীতল ক্যালকুলেশন? ইতিহাসে বহুরাজা, মহারাজা ও সম্রাট তাদের ক্ষমতার স্বার্থে আপন সন্তানের বলি দিয়েছেন।
যদি মহত্ত্ব হয়, তবে এই কি হবে সমাজতান্ত্রিক নতুন মানুষের চেহারা?
আদর্শ হবে অপত্য স্নেহের চেয়ে বড়? পিতা সন্তানকে রক্ষা করবে না বা সন্তান পিতাকে? কেউ যুদ্ধবন্দি হলে তার স্ত্রী জেলে যাবে শত্রু হিসেবে এবং তাদের শিশুরা যাবে দেশশত্রুর জন্য নির্ধারিত অনাথ আশ্রমে?
মিথের ইতিহাস ও ইতিহাসের বহু মিথ তৈরি করা হয়েছে স্তালিনের এই ছেলেটিকে নিয়ে, যার মাথায় নাক রেখে গন্ধ নেয়নি পিতা কোনোদিন, বুকে আঁকড়ে ধরে বলেনি, ‘মাতৃহীন বাপ ভালোবাসি তোকে আমি, ভীষণ ভালোবাসি।’
তাই তার একটুও বাধেনি ইয়াকভের পালক পিতামাতাকে হত্যা করতে।
মার্কসবাদ কি মানুষকে কৃতঘœ হতে বলেছে, বলেছে আপনজনকে শত্রু সন্দেহে হত্যা করতে?
যে তার আশপাশের প্রতিটি আপনজনকে হত্যা করাতে ইতস্ততবোধ করেনি, কেন পৃথিবীর মহত্তম উটপাখিরা ইয়াকভ হত্যাকে মহত্ত্ব হিসেবে দেখানোর জন্য এত আদা-জল খেয়ে লাগে?
১৯৪৩ সালে ইয়াকভ জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মার যায়। বলা হয়ে থাকে, ততদিনে কাতিনে হাজার হাজার পুলিশ অফিসার হত্যার খবর বের হয়ে এসেছে। নাৎসিরা এ নিয়ে প্রচুর প্রপাগা-া করা শুরু করেছে দুনিয়াব্যাপী এবং বন্দীদের ভেতর। পোলিশ বন্দীরা ধিক্কার দিচ্ছে তাকে তার পিতার এই দানবিক কাজের জন্য।
সে সহ্য করতে না পেরে কাঁটাতারে ইলেকট্রিক বেড়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। ভাষ্যমতে, সে আত্মহত্যাই করতে চেয়েছিল কিন্তু সময় পায়নি। সে উন্মত্তের মতো কাঁটাতারের বেড়ার দিকে ছুটছিল। রক্ষীরা থামতে বলে; বলে, না থামলে গুলি করা হবে। কিন্তু সে কমান্ড অমান্য করে ছুটতেই থাকে এবং পেছন থেকে মাথায় গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।
স্ভেতলানার আপন মামা পাভেল গৃহযুদ্ধের পরে লেনিনের নির্দেশে মেরু প্রদেশে নরিলকা নদীর অববাহিকায় জিওলোজিস্ট নিকোলাই উরভানৎসেভের সাথে কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের অনুসন্ধান করে প্রচুর কয়লা ও লোহা পেয়েছিলেন। সেখানে গড়ে ওঠে নরিল্স্ক শহর। নাৎসিদের উত্থানকালে সোভিয়েত সামরিক এটাচি হিসেবে তাকে জার্মানিতে পাঠানো হয়।
সেখান থেকে ফিরে এসে একজন জেনারেল হিসেবে মস্কোতে বাস করতে থাকেন। স্ভেতলানা লিখেছেন, “১৯৩৮ সালে সে প্রায়ই আমাদের বাসায় বসে থাকত বিষণ্ণ মনে, বাবার জন্য অপেক্ষা করত। অবিকল সেভাবে, যেমনভাবে অপেক্ষা করত মামা আলিওশা (আলেকসান্দার স্ভানিদজে) এবং আমার নানা, কিন্তু বাবা আসত না।… অথচ বাবা অনেক ভালোবাসতো পাভেল মামা এবং তার শিশুদের। ১৯৩৮ সালে যখন আলেকসান্দার স্ভানিদজেকে তার স্ত্রীসহ এবং আন্নার স্বামী রেদেন্সকে গ্রেফতার হয়, পাভেল মামা একাধিকবার বাবার কাছে এসেছে এবং তার গ্রেফতারকৃত পরিচিত আর্মি অফিসারদের সম্পর্কে কথা বলেছে কিন্তু ফল হয়নি।
১৯৩৮ সালে শরতে পাভেল মামা সোচি যায় ছুটিতে, যদিও তার অসুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য তা ভালো ছিল না। ফিরে এসে তার অফিসে যায়, দেখে সেখানে কেউ নেই, যেন পুরো অফিসটাকে কেউ ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করে গেছে। এত বেশি দেশ-শত্রু খুঁজে পাওয়া গেছে তার অফিসে এবং গ্রেফতার করে পাঠানো হয়েছে মৃত্যু খোয়াড়ে…!
সাথে সাথে তার হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং সে অফিসেই মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১০ বছর পরে, ১৯৪৮ সালে তার স্ত্রী ঝেনিয়াকে (নেতার এককালীন ডি ফ্যাক্টো গৃহকর্ত্রী) গ্রেফতার করা হয় স্বামীকে বিষপানে হত্যা করার মিথ্যা অভিযোগে। পরবর্তীকালে তাদের ২৮ বছরের মেয়ে কিরাকেও জেলে পোরা হয়। তার ভাগ্য ভালো, মাত্র ছয় মাস জেল খাটার পরে স্তালিন মারা যান।
ঝেনিয়াকে গুলাগের নিঃসঙ্গ সেলে রাখা হয় ১০ বছর। সেখানে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভাঙা কাচ গিলে। যখন সে জেল থেকে বের হয়ে আসে, দীর্ঘদিন মানুষের সাথে কথা না বলার কারণে সে ছিল প্রায় বাকরুদ্ধ এবং প্রথম বাক্যটি সে বলে, ‘আমি জানতাম, জানতাম যে স্তালিন আমাকে মুক্তি দেবে।’ কিন্তু সে জানত না যে, স্তালিন মারা গেছেন এক বছর আগে এবং সে খবর তাকে দেওয়া হয়নি। শুনে সে কেঁদেছিল দুই হাতে মুখ ঢেকে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত না-কি সে স্তালিনের ছবি রেখেছে তার দৃষ্টির সামনে, বিশ্বাস করেনি স্তালিনই ছিল তার নিপীড়ক।
১৯৪৭ সালের শেষ দিকে আন্না (রেদেন্সের স্ত্রী-স্ভেতলানার খালা) একটি স্মৃতিকথা লিখে প্রকাশ করেন পরিচিত চ্যানেলের মাধ্যমে। বইটি স্তালিনকে অসম্ভব ক্ষেপিয়ে তোলে। ‘এরা অনেক জানে এবং খুব বেশি কথা বলছে, যা আমাদের শত্রুদের হাতকে শক্তিশালী করছে।’ আন্নাকে জেলে পোরা হয়। এ সময়ে তার ছেলে ভলোদিয়ার বয়েস ছিল ১২ বছর। আট বছর জেলের অকথ্য নির্যাতনের ফলে স্মৃতিভ্রম, অসুস্থ এবং সম্পূর্ণভাবে থেতলানে মানবিকবোধ নিয়ে যখন সে বের হয়ে আসে, সে ভলোদিয়াকে চিনতে পারে না। ২০ বছরের ভলোদিয়াকেই বারবার জিজ্ঞেস করে, ‘আমার ভলোদিয়া কই?’
স্ভেতলানার নিজের জীবন ছিল ভীষণ অসুখী। তার প্রথম প্রেম ৩৯ বছর বয়স্ক ফিল্ম ডিরেক্টর আলেক্সেই কেপলারকে স্তালিন পছন্দ করেননি। ব্রিটিশ গুপ্তচর বলে ১৯৪৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে মেরু প্রদেশে খনিতে কাজ করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ১০ বছরের জন্য।
১৯৪৪ সালে স্ভেতলানা মারোজভ নামে একজনকে বিয়ে করে যার পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল ইহুদি গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। এ বিয়েকে ‘জায়োনিস্ট ফাঁদ’ বলে উল্লেখ করেন পিতা। এবং মারোজভের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। মার্কস ইহুদি ছিলেন কিন্তু তার বিশাল শিষ্য তখন সারাদেশে ইহুদি শিকারে ব্যস্ত। ১৯৪৭ সালে স্ভেতলানার বিয়ে ভেঙে যায়।
১৯৪৯ সালে স্তালিনের দীর্ঘদিনের সাথী, লেনিনগ্রাদের বহু হত্যাকা-ের কুড়াল ও বিশ্বব্যাপী বামপন্থি সাহিত্যিকদের ত্রাস, কমরেড ঝদানভের ছেলে ইউরি ঝদানভকে বিয়ে করেন পিতার পীড়াপীড়িতে।
ঝদানভ মারা গেছেন মাত্র এক বছর আগে।
অত্যন্ত অসুখী ছিল এই বিয়ে, শাশুড়ি ছিল জীবন্ত ডাইনি। সেই বিয়ে টিকেছিল মাত্র তিন বছর।
এভাবেই ভাঙনের বিপর্যস্ত, বিষাদগ্রস্ত জীবন চলে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাশালী ব্যক্তির কন্যার এবং পিতা হয় তার বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় অনুঘটক। তারপরেও পিতাকে সে ভালোবাসতো এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল অম্ল মধুর।
১৯৬২ সালে সে বিয়ে করে স্ভানিদজে পরিবারের ইভান স্ভানিদজেকে, কিন্তু ১৯৬৩ সালে সে বিয়ে ভেঙে যায়। এরপরে সে ভারতীয় এক কমিউনিস্টের সাথে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সেই বিপ্লবী মারা যায় মস্কোতে। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ক্রুশ্চেভের ব্যক্তিগত নির্দেশে তাকে প্রেমিকের মৃতদেহ নিয়ে ভারতে যেতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সেখান থেকে সে খাঁচা ভেঙে পলায়ন করে। বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘৃণ্য শত্রু আমেরিকায় চলে যায়।
পেছনে রয়ে যায় ২০ বছরের ছেলে জোসেফ এবং ১৭ বছরের মেয়ে কাতিয়া। তার স্মৃতিগ্রন্থ ‘বন্ধুকে ২০টি চিঠি’ (Twenty letters to a friend) বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয় মিলিয়ন মিলিয়ন কপি।
স্ভেতলানা লেখেন, বাবার মনে যদি একবার কাকেও সন্দেহ হতো এবং তাকে সাথে সাথে বন্ধু থেকে শত্রুর স্থানে বসাতেন; কিন্তু তার উল্টাটা কখনও হতো না। সে তার যত পরিচিত, যত কাছেরই হোক না কেন। তার সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলা যেত না, কেউ এ নিয়ে কথা বললে তিনি রেগে যেতেন। শুধু তাই নয় এই হতো তাদের শেষ কথা, শেষ দেখা। রেদেন্স, আলেকসান্দার স্ভানিদজে, পাভেল, এনুকিদজে, এরা সবাই ছিলেন সৎ মানুষ, দীর্ঘদিন ধরে বাবাকে জানতেন এবং তারা বাবার কাছে সত্য বলতে ইতস্তত করতেন না। বৃক্ষ যেমন দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করে তারা সবাই ঋজু দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন; কিন্তু মাথা নত করেননি।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী চিকিৎসক, কবি এবং সাহিত্যিক

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য