নিয়ামত শাহ: সম্মানিত ভদ্রজনেরা, উপরোক্ত শিরোনাম দর্শনে এই দুর্বল নিয়ামত শাহ নামক লিখিয়েটির প্রতি কুপিত হবেন না। না, রক্তসমুদ্রে জন্ম নেওয়া দেশটির প্রতি, মাতৃভূমির এতটুকু মানহানি করার সামান্যতম বাসনা পোষণ করার আগে আমার মরণ হউক।
সত্যি বলছি। উপরোক্ত নামে একটি দৈনিক পত্রিকা ছিল। এখন আর দেখি না। সেই পত্রিকার একজন কর্মীর মুখে আমি স্বচক্ষে স্বকর্ণে স্বইন্দ্রিয়ে উপরোক্ত ‘আলুকিত’ উচ্চারণ শ্রবণ, দর্শন এবং উপলব্ধি করেছি। বুঝেছি ওটা উচ্চারণের সামান্য ‘ত্রুটি’ মাত্র। অনেকে মজা করে রবীন্দ্রসংগীতের কলি দুমড়ে-মুচড়ে আলুভর্তা বানিয়ে ‘আলু আমার আলু ওগো’ বলেও বেশ মজা করেন। করোনাকালের আগে আগে দেখলাম আমার বাংলাদেশ বহির্ভূত প্রধান প্রিয় প্রান্তর শান্তিনিকেতনের কতিপয় ছাওয়াল-ছাওয়ালী রবীন্দ্রসংগীতের কলিতে রুচিহীন আদিরসের কথা ঢুকিয়ে মজা করছে। সেদেশের মিডিয়াগুলো আবার সেসব প্রচারে দিগগজ পুলকও পাচ্ছে। সবই কী প্রচারযোগ্য, বলুন হে ভদ্রজনেরা!
তবে ‘আলুকিত’ শব্দটি সে-কারণে আজকের আলাপ-আলোচনায় আনিনি। ভাই ও বোনেরা, জানি না বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অঞ্চলে মানবসভ্যতার কোনো কালে ‘আলু-ধর্মঘট’ হয়েছে কি না! আলাপ-আলোচনাকে কিন্তু সতর্কতার সাথেই ‘আলুপ-আলুচনা’ বলিনি। এই যে সংযত রইলাম, আপনারা সেটা ‘লক্ক’ রাখবেন। হ্যাঁ ভাই, হ্যাঁ বোন, এদেশে বেশ কিছু জায়গায় ‘লক্ষ’ কিংবা ‘লক্ষ্য’কে ‘লক্ক’ বলা হয়ে থাকে। জগন্নাথ হলে আমাদের ‘জীবন সাহা’ বন্ধু ছিলেন। তার প্রিয় বন্ধু-কাম-মুরুব্বী একই এলাকার ‘নুরুল ইসলাম’ মহসিন হলে থাকতেন। এটি বাংলাদেশ সময়কালের কথা। উভয়ে একই সাথে একই ছাত্র-সংগঠনে শামিল ছিলেন। তা জীবন সাহা একদিন তার এক সাথীকে বললেন, যা তো, মহসিন হলে গিয়া নুরুল ইসলাম ভাইকে ‘কবর’ দিয়া আয়। ‘খবর’ শব্দটির আঞ্চলিক উচ্চারণ ‘কবর’। বালাই ষাটকোটি! আজও জীবন এবং নুরুল বেশ ভালোভাবেই বেঁচে বর্তে আছেন।
লেজে লেজে বর্ধমান পার হয়ে ধানবাদ চলে যাচ্ছি। ফিরে আসি আমাদের ‘জ্যামতম’ তবু ‘প্রিয়তম’ ঢাকা মহানগরীতে। একদিন এই শহরের কারওয়ান বাজারে এই করোনাকালে করুণ ‘আলু-ধর্মঘট’ হয়ে গেল। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের, উজির-নাজিরের তালু গরম হয়ে গেল। ক্যানো! ক্যানো!! ক্যানো!!!
কাপড়চোপড় ইস্ত্রি করবার লন্ড্রির কথা শুনেছি অনেককাল। কিন্তু ‘মানি লন্ডারিং’ শব্দটি বেশিদিন আগে শুনিনি। আমরা সবাই শুধু ব্যাংকের মালপানি গায়েব করার মহান মহাজনদের নিয়েই আসরে কাঁসরঘণ্টা বাজাতে তিতামিঠা পুলক লাভ করি। কিন্তু দেশের খাতুনগঞ্জ মার্কা কতিপয় ভূষামালের আড়তে একটি পণ্যের মূল্য একটি টাকা বেড়ে গেলে কতো হাজার কোটি টাকার তেলেসমাতি ঘটে, সেই ‘সিন্ডি-বেড়াল’-এর আসল খবর আমরা দেশের এক নম্বর থেকে ঘাসমূল পর্যায় পর্যন্ত কেউ জানি না। তা এবার হঠাৎ আলুর মূল্য এমন কলকিত হলো কেন? খুচরা বলে পাইকারীর কাছে জিগান। পাইকারী বলে ‘কলেস্টর’রে জিগান। ‘কোল্ড স্টোরেজ’ স্থাপনাটি এখন কলেস্টর আমজনগণের মুখে মুখে। ওদিকে কলকাতার চ্যানেলেও দেখি সেখানকার বাজারে আলুর দামে ক্রেতা সাধারণের দম হাঁসফাঁস। তবে সেখানে ‘মমতাময়ী’ হুমকি-ধমকি দিলেও ‘আলু-ধর্মঘট’-এর কথা শুনিনি। তবে কী আমাদের ‘কারওয়ান বাজার’সহ বিভিন্ন বাজারের ‘আলু-ধর্মঘটের’ কাহিনি সেই যে গিনিজ রেকর্ড বই না কী বলে, সেইখানে জ্বলজ্বল করতে থাকবে।
জানি না ‘আলু’ পণ্যটি কোন কোন উজিরি দপ্তরের অধীন! র্যাবের সদস্যগণ আলুর দর দমিয়ে রাখতে বাজারে বাজারে প্রাণান্ত। বেচারাদের সবখানেই দৌড়াতে হয়। যত জায়গায় যা কিছু। তা ক্যাসিনো হোক আর ওয়াকিটকি হোক। কবে এদেশে জনগণ নিজের হাতে ‘সুশাসন’ সুনিশ্চিত করবে? কেননা ‘জনগণ’ই যে হচ্ছে চিরস্থায়ী ওষুধ।
তা আলুবিষয়ক সংকট নিরসনে কয়টি দপ্তর বিরাজমান, জানি না। বাজারে আলু গরম হলেও সিদ্ধ হয় না। পাকিস্তান আমলে প্রথম ‘ভাতের বদল আলু খাও’ আওয়াজ উঠেছিল। ‘খাদ্য-সার্বভৌমত্ব’ নামে একটি বাক্যবন্ধ রয়েছে। এ নিয়ে জগতের নানাপ্রান্তে মগজের শোরগোল চলে। কথাটির মানে যতটুকু জানি, যে অঞ্চলের লোক যা খেয়ে অভ্যস্ত, তাদের তার বাইরের খাবার জোর করে গেলানো যাবে না। তবে ভাতের সঙ্গে খাঁটি সরিষার তেলে পোড়া মরিচে আলুভর্ত্তার যে ‘খাদ্য-সার্বভৌমত্ব’ বঙ্গ অঞ্চলে রয়েছে তা থেকে কেউ বঞ্চিত করতে এলে প্রকৃত লগি বৈঠা ব্যবহার করেই বীর বাঙালি তা সমাধান করবে।
আলু বিষয়ে সর্বশেষ বয়ান-বচন। ভবিষ্যতে যেন ‘গিনিজ-রেকর্ড’ বইয়ে না যেতে হয় সেজন্য এ-বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি বিশেষ গোপনীয় ‘আলু-বিপাক তদন্ত কমিটি’ হোক। রিপোর্টটিও গোপন থাকুক। ‘কলেস্টর-আড়ত-খুচরা’Ñ কোথায় কী হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কত পরিমাণ, কৃত্রিম সুযোগ শতকরা কত ভাগ, সময়ের কামের বদলে সময়ের আকাম কিংবা অসময়ের ডান্ডাবেড়ি কতটুকু হলো এই তদন্ত কমিটি তা দেখবে। এবং সে বিচারে প্রকৃত ধারালো ব্যবস্থার দ- প্রয়োগ করা হবে।
ছোটবেলা থেকেই বাঙালি সনাতনী সন্তানদের সাথে উঠ-বস করি। বাঙালি সনাতনীরা সাধারণভাবে পিঁয়াজবর্জিত জীবনযাপন করে। অ-সনাতনীদের মুখে পিঁয়াজের গন্ধে আপত্তি তুলতে দেখেছি ষাট-পঁয়ষট্টি বছর আগে থেকেই। তবে মনে হয় সনাতনী অবাঙালিদের কাছে পিঁয়াজের কদর বেশ। সেদেশে গোদা গোদা পিঁয়াজ অঢেল। সে পিঁয়াজের আমদানিতে বাংলাদেশের পিঁয়াজের ঘাটতি নিয়ত মোকাবিলা করা হয়। ফলে কম দামে।
পিঁয়াজ ভক্ষণের এক মোক্ষম আস্বাদনে আমাদের জীবন চলে। কিন্তু হায় রে হায় গত দু-বছরে ভারতীয় পিঁয়াজের হঠাৎ বজ্রপাতে বাংলাদেশ চিৎপাত। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পিঁয়াজবর্জিত জীবনে চলে গেলেন। কিন্তু তার সমর্থক আমাদের সেই সাধ্য হলো না। দেশি পিঁয়াজের ঝাঁজে চোখে পানি আসে। শুধু তিস্তার পানি যে পাই না তা নয়, ভারতীয় বড় বড় পিঁয়াজেও ঝাঁজের পানি পাই না। সেই পিঁয়াজের অভাবে অবশেষে চোখে পানি আসে।
ভারতের বিরাট অঞ্চলের কৃষিপণ্য হচ্ছে পিঁয়াজ। সেদেশে এক অঞ্চলে বন্যা হলে পিঁয়াজের এমন ঘাটতি দেখা দেয় যে জনমন আগুন হয়ে ওঠে। তখন দিল্লির শাসকেরা হঠাৎ পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। গত দু-বছর ধরেই এমন কা-টা ঘটল। বাংলাদেশের স্থলবন্দর থেকে পিঁয়াজের বড় বড় ট্রাকের মুখ উল্টিয়ে দেওয়া হয় বিনা নোটিসে। অমনি টাকার শ্যামের বাজারে বাঁশি বেজে ওঠে। চল্লিশ টাকার পিঁয়াজ মুহূর্তে শতেক টাকায় উন্নীত হয়ে যায়। ওদিকে মহারাষ্ট্র-মুম্বাইয়ের কৃষকেরা রপ্তানি বন্ধ হওয়ার ফলে অতিরিক্ত পিঁয়াজ পচে যাবার ক্ষোভে জ্বলে ওঠে। গত বছর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঐ দেশের কাছে ‘হঠাৎ পিঁয়াজ রপ্তানি’ বন্ধে আপত্তি জানালে কিঞ্চিৎ সুরাহা হয়। এবারও অনেকটা তাই।
এইবার ধরি পিঁয়াজ-উজিরকে। পিঁয়াজ উৎপাদন উজিরকে বলি পিঁয়াজে স্বনির্ভর হবার বিশেষ উদ্যোগ নিন। পিঁয়াজ আমদানি উজিরকে বলি একদেশ-নির্ভর আমদানির ব্যাপারগুলো আর নয়, আর নয়। যতটুকু জানি বাংলাদেশে পিঁয়াজ সরবরাহ করে যে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা, বাংলাদেশে গোপনে পুঁজি খাঁটিয়ে তারাই পিঁয়াজ আমদানি করে। এ বিষয়টিও সত্য হলে সমস্যাটির ঝুঁটি ধরুন।
সেদিন কুড়িগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লাল ভাই জানালেন, কুড়িগ্রামের উনিশটি নদীতে এবার পাঁচ পাঁচটি বন্যা হয়েছে। দেশজুড়ে হয়েছে তিনটি বন্যা। বন্যার পানিতে বিশেষত আগুন লেগে যায় শাক-সবজি-ফসলে। দ্রব্যমূল্যের ‘দাম’ বেড়ে যায়। ফসলের মৌসুমে দাম পায় না বলে তা রাস্তায় ছড়িয়ে দেয় উৎপাদকেরা। আগুন লাগায়। অতএব, প্রয়োজনে ‘কলেস্টর’ বাড়ান। এমন দাবি কতকালের। উজির আসে উজির যায়। বন্যা আসে বন্যা যায়। প্রতিশ্রুতি আসে প্রতিশ্রুতি যায়। তবুও বলি হে ‘কলেস্টর’ তুমি সংখ্যায়, বহরে, কলেবরে বেড়ে চলো। তবুও বলি যেমন রোগ, তেমন ওষুধ দেওয়া হোক সর্বত্র। পদ্মার প্রথম সেতুর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। তারপরই আশায় আছি পদ্মার দ্বিতীয় সেতুর জন্য।
লেখক : অনিয়মিত কলাম লেখক