Wednesday, October 4, 2023
বাড়িSliderআমার দেখা নয়াচীন

আমার দেখা নয়াচীন

‘আমার দেখা নয়াচীন’
তরুণ জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫২ সালের গণচীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা একটি ডায়েরি। তার রচিত তৃতীয় গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি ২০২০ সালে বইটি প্রকাশ করে। উত্তরণ-এর মুজিবপ্রেমী পাঠকদের জন্য সেই বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

[পূর্ব প্রকাশের পর]

শেখ মুজিবুর রহমান: ক্যান্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমার টেবিলে বসেছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাল চীন বাহিনী যখন ক্যান্টন অধিকার করে তখন অবস্থা কী ছিল, বিশেষ করে জনসাধারণের মনোভাব কী ছিল? শহরের বা শিল্পের কোনো ক্ষতি করে গিয়েছে কি না? বিশেষ করে যখন চিয়াং কাইশেক সৈন্য লইয়া পশ্চাদপসরণ করেন? ছাত্রটি ইংরেজি জানে। সে বললো, চিয়াং কাইশেকের সৈন্যবাহিনী কোনো জিনিসই নষ্ট করে যায় নাই। অনেক বড়লোক এবং বড় কর্মচারী, তাহার সাথে পালাইয়া গিয়াছে। যে যাহা পারে নিয়া গিয়াছে, আর অন্য সকল জিনিসপত্র রেখে গিয়াছে। নয়াচীনের সৈন্যবাহিনী যখন শহরে এলো, আমরা ৫/৭ দিন ভয়েতে দরজা খুলি নাই। ভাবতাম বুঝি অত্যাচার করবে, কারণ অনেক অত্যাচারের কাহিনি আমরা শুনেছি। কিন্তু দেখলাম এরা এসেই ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে শুরু করলো। একদল চিৎকার করে বলতে বলতে গেল, ‘তোমরা নির্ভয়ে কাজ কর্ম করো, দোকান খোলো, ব্যবসাবাণিজ্য চালাও। ঘরের বাহির হও। কোনো ভয় নাই। আমরা তোমাদের ভাই, তোমাদের সেবাই আমাদের কাজ।’ আস্তে আস্তে দোকান খোলা শুরু হলো, লোক রাস্তায় বেরুতে লাগলো। অনেকে সৈন্যবাহিনীদের খাবার সাহায্য করতে চাইলো। তারা গ্রহণ করলো না, যারাই বাহির হয় তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করে। এসব দেখে ছয় দিন পরে আমরা দরজা খুললাম- ছেলেটা আমাকে বললো।
ছাত্রটি আরও বললো, ‘আমি আস্তে আস্তে ওদের কাছে গেলাম, ওরা খুব ভালো ব্যবহার করলে আমার মনে সাহসের সঞ্চার হলো। আমরা কয়েকজন ছাত্র এক জায়গায় হলাম। দেখলাম কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মীরা বাড়ি বাড়ি খোঁজ নিচ্ছে কী দরকার, কোনো অসুবিধা আছে কি না? কী সাহায্য করতে পারি? এ সৈন্য জনগণের সৈন্য। এরা জনগণের অংশ। ৭/৮ দিন পর পূর্ণ নাগরিক জীবন ফিরে এলো। শহরে শান্তি রক্ষা ও কাজের জন্য একটা নাগরিক কমিটি গঠন করে দিলো। যদিও তাহার মধ্যে প্রায় সকলেই কুম্যনিস্ট অথবা কম্যুনিস্ট ভাবাপন্ন ও কয়েকজন শিক্ষক এবং সম্মানি লোক। এদের অনেকের ওপরই জনগণের শ্রদ্ধা ছিল। এদের কাজকর্ম, ব্যবহার দেখে আমিও এদের দিকে ঝুঁকে পড়লাম। ওরা সমস্ত লোকদের ডাক দিলো, এসো, আমরা শহর পরিষ্কার ও অন্যান্য সমাজসেবার কাজ করি। কত বেকার, কত দুঃখী, তাহার হিসাব নেওয়া শুরু করলো, নানা প্রকার গঠনমূলক কাজ আরম্ভ করলো, লোকের মনে শান্তির ছায়া ফিরে এলো। সকলেই তাদের ডাকে সাড়া দিলো। কেহ ভালোবেসে, আবার কেহ ভয়ে ভয়ে।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোনো লোককেই কি গ্রেফতার করা হলো না? সে বললো, যারা চিয়াং কাইশেকের দলে অথবা তাহাকে খুব সমর্থন করতো তারা পালাইয়া গিয়াছে। আর যদি কেহ কোনো লোকের বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে করতে পারে যে সে চিয়াং-এর আমলে অত্যাচার করেছে, ব্লাক মার্কেটিং করেছে এবং খারাপ কাজ করেছে তাকে গ্রেফতার করা হতো। আমার মনে হলো ছেলেটা একটু চেপে গেল, কারণ কিছু লোককে তো নিশ্চয়ই গ্রেফতার করা হয়েছে- যারা সরতে পারে নাই আর ভাবছে তাদের কাজকর্ম নয়াচীন সরকার জানতে পারে নাই।
আমরা রাত প্রায় ১০টায় রুমে ফিরে এলাম এবং যার যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সকাল পর্যন্ত খুব আরামে ঘুমালাম। উঠে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কাপড় পরলাম। কারণ আমাদের রওয়ানা হতে হবে পিকিংয়ে, যেখানে আমাদের শান্তি সম্মেলন হবে। নয়াচীনের রাজধানী পিকিং শহরে ক্যান্টন থেকে যেতে রেলগাড়িতে দুই দিন দুই রাত লাগে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে বলে আমাদের জন্য অ্যারোপ্লেনের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সকাল ৯টায় অ্যারোপ্লেন ছাড়বে।
আমরা যে হোটেলে ছিলাম তা নদীর পাড়ে চারতলা একটি দালান, লিফটের বন্দোবস্ত ছিল। হোটেলের দুই পাশ দিয়ে নদী। বড় বড় নৌকা নদীর পাড়ে থেমে আছে। এরা আমাদের দেশের মতো মালপত্র আনা-নেওয়া করে। ৮টার সময় আমরা চা-নাস্তা খেলাম, তারপর সকলে মোটরে উঠে অ্যারোড্রাম-এ পৌঁছলাম। আমাদের জন্য ছোট দুইটা প্লেন জোগাড় করে রাখা ছিল। আমরা ভাগ ভাগ হয়ে উঠে পড়লাম। যাবার সময় আবার আমাদের তারা প্রাণভরে বিদায় সম্ভাষণ জানালো।
প্লেনগুলি ছোট হলেও বেশ আরামদায়ক। ২১ জনের বসবার ব্যবস্থা আছে। আমাদের খাওয়ার বন্দোবস্ত প্লেনের মধ্যেই ছিল। আমরা মাঝে মাঝে চা ও শরবত খেতে খেতে বেলা ৫টার সময় পিকিং অ্যারোড্রামে পৌঁছলাম। সেখানেও আমাদের অভ্যর্থনা করা হলো, বাচ্চা বাচ্চা ছোট ছেলেমেয়েরা আমাদের ফুলের তোড়া উপহার দিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের জনাব মাজাহার- লাহোরের দৈনিক পাকিস্তান টাইমস কাগজের সম্পাদক, পূর্বেই পিকিং পৌঁছেছিলেন। তিনিও আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে দেখে আমরা খুব আনন্দিত হলাম। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা আমরা গিয়াছি তার মধ্যে আমার সাথেই তাঁর পরিচয় ছিল।
আমাদের অ্যারোড্রামেই চা খাওয়ান হলো। তারপর গাড়িতে চড়ে আমরা পিকিং শহরে চললাম। দুনিয়ার নামকরা এই শহর। বহু ঝড় গিয়াছে এর ওপর দিয়ে। বহু রাজার রাজধানী ছিল এই শহর। বহু বিদেশি এই শহরটি অনেকবার অধিকার করেছে। শেষবারের মতো জাপানিরা এই শহরটা অধিকার করে- যখন চীন-জাপান যুদ্ধ হয়। তারপর চিয়াং কাইশেকের হাতে ছিল। শেষে, নয়াচীন সরকার মাও সেতু-এর নেতৃত্বে এই শহরটা অধিকার করে রাজধানী কায়েম করে। দেখবার আকাক্সক্ষা বেড়ে চললো, মনে হলো কখন পৌঁছব, আর তো দেরি সয় না! সন্ধ্যা হবে হবে এমন সময় আমরা পৌঁছলাম। আমাদের জন্য কামরা ঠিকই ছিল। পিকিং শহরের শ্রেষ্ঠ হোটেল- যার নাম ‘পিকিং হোটেল’ সেখানে আমাদের রাখা হলো। ভারত থেকে যারা যোগদান করতে গিয়াছেন তারাও ঐ হোটেলে আছেন। হোটেলটা পাঁচতালা, খাবার ব্যবস্থা উপর তলায় বন্দোবস্ত। আরও অনেক দেশের ডেলিগেটরা এই হোটেলে ছিলেন। পীর মানকী শরীফকে এক রুম দেওয়া হয়েছে। আর প্রায় সকলেই দুইজন করে এক রুমে। আমরা ইচ্ছা করেই তিনজন এক রুম নিলাম। আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই ও আমি। আমাদের কামরায় আমাদের মালপত্র হাজির। যার যার বিছানায় বসলাম।
রাত্রে আমাদের পাকিস্তান ডেলিগেটদের সভা হবে, খাবার পরেই। পীর সাহেব বলে দিয়াছেন মুসলমানের পাক খাবেন, তাই আমাদের জন্য এক মুসলমান হোটেলে খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। রাত্রে সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের, ‘আস্সালামু আলাইকুম’ বলে অভ্যর্থনা করলো। আমরা ‘ওয়া লাইকুম আস্ সালাম’ বলে উত্তর দিলাম। তাদের সাথে গল্প শুরু করলাম, ‘মনে রাখবেন দোভাষী আমাদের সাথে আছে, না থাকলে আমরা বোবা’।
আমাদের টেবিলে সাংহাই-এর দৈনিক ইংরেজি খবরের কাগজের সম্পাদক বসলেন। তিনি আমাদের কথা ওদের বুঝয়ে দেন। আবার ওরা যা বলে তাহা আমাদের বুঝায়ে দেন- এক কথায় তারা বললো, আমরা খুব ভালো আছি। এখন আর অত্যাচার হয় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হয় না। পরে আলোচনা করা যাবে। খাবার যখন আমাদের সামনে হাজির করা হলো তখন আমাদের অবস্থা কাহিল। কী করে এগুলি খাবো! পাক প্রায় সকল সম্প্রদায়ই নিজেদের মতো করে। কেহ গরু খায়, আর কেহ শুয়োর খায়। আমাদের জন্য গরুর গোস্তের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কিন্তু খেতে পারলাম না। যা খেলাম তার জন্য সারারাত পেটে তেল লাগাতে হলো। মাঝে মাঝে পেটের ভিতর গুড়ুম গুড়ুম শব্দ শুরু করতে আরম্ভ করলো, আর চাপা চাপা বেদনা শুরু হলো। যা হোক, ফিরে এসে টেবিলের উপর দেখি কিছু ফল আর সিগারেট। ফল ও সিগারেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক কষ্টে রাত কাটলো। আমাদের কনফারেন্স পরের দিন থেকে শুরু হবে। [চলবে]

সূত্র : আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য