‘আমার দেখা নয়াচীন’
তরুণ জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫২ সালের গণচীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা একটি ডায়েরি। তার রচিত তৃতীয় গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি ২০২০ সালে বইটি প্রকাশ করে। উত্তরণ-এর মুজিবপ্রেমী পাঠকদের জন্য সেই বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান
[পূর্ব প্রকাশের পর]
আমি ভাবলাম, লোকটা অন্ধ। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের লোভ মোহ দিয়া ভোলানো সোজা না। তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগওয়ালারা তা পারতো। মনে মনে ভাবলাম, ‘জেলে দিয়া, মিথ্যা মামলার আসামি বানিয়ে, ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত করে নানা প্রকার অত্যাচার করেও আমাদের মতের পরিবর্তন করা যায় নাই।’ দেখা যায়, হংকং-এ থেকে কম্যুনিস্ট বিরোধী হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, চীনের অনেক বড় বড় লোক কম্যুনিস্ট জুজুর ভয়ে হংকং-এ আশ্রয় নিয়েছে। তবে আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে। অনেকে আবার হুজুগে এসে বিপদে পড়েছে। এইভাবে, বহুলোক হংকংয়ে সামান্য জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। যা হোক, ফেরার পথেও দুইদিন হংকংয়ে ছিলাম, তাই হংকং পর্ব শেষ করে নয়াচীনে ঢুকবো।
হংকং ইংরেজ কলোনি, ইংরেজই শাসন চালায়, তবে হংকংয়ের বাসিন্দাদেরও প্রতিনিধি থাকে। একদিকে বিরাট বিরাট দালানকোঠা আর ব্যবসা-বাণিজ্য, আর একদিকে লক্ষ লক্ষ গরিব রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছে। সকলের চেয়ে বড় আয় নারী ব্যবসায়। তাই দিয়েই বহুলোক সংসার চালায়।
দুনিয়ার অন্যতম সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ শহর বলে বহু লোক এখানে বেড়াতে আসে। যার কারণে ইংরেজদের ব্যবহার খুব ভালো। মিছামিছি লোককে হয়রানি বা পেরেশান করে না। তাদের ব্যবহার ও গণতন্ত্রের জন্য মানুষ হিসাবে ইংরেজ জাত শ্রেষ্ঠ, যদিও আমার এটা ব্যক্তিগত মত।
আতাউর রহমান সাহেব, মনিকভাই, ইলিয়াস ও আমি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ১৬/১৭ বৎসরের একটা মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল লাগাইয়া দিতে অগ্রসর হয়। মেয়েটি কলারে হাতও দিয়াছে, খান সাহেব হঠাৎ যেন চমকাইয়া উঠলেন। পরে ধাক্কা দিয়া ফুল ছুড়ে ফেলে রাগে ঘোঁতঘোঁত করতে করতে এগিয়ে চললেন। মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মতো যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কী? আতাউর রহমান সাহেব তো রাগে অস্থির, আর মানিকভাই তো তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ মতো ঘুরাইয়া ফিরাইয়া ওনার পিছনে লাগলেন। আমরা খুব হাসাহাসি শুরু করলাম। বেচারা ভদ্রলোক রাগে শোকে দুঃখে কথা বলেই যেতে লাগলেন।
হংকংয়ে ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’। ফুলটা গ্রহণ করলেই ওরা মনে করবে আপনি তার সাথে যেতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে হাত ধরে সাথে করে ওদের জায়গায় নিয়ে যাবে। বেচারি ভেবেছিল, আমাদের দলের নেতা মোটাসোটা ভালো কাপড় পরা, গম্ভীর প্রকৃতিরÑ টাকা পয়সাও নিশ্চয় যথেষ্ট আছে। ঠিকই ধরেছিল কিন্তু বেচারি জানে না, আমাদের নেতা নীরস ধর্মভীরু মানুষ, ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ করেন আর তার একমাত্র সহধর্মিণীকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালোবাসেন। এসব দিকে খেয়াল দেয়ার মতলব ও সময় তাঁর নাই। তবে এই মেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ কী? এই সমাজব্যবস্থা। বাঁচবার জন্য এরা সংগ্রাম করছে, ইজ্জত দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করছে। হায়রে মানুষ! রাস্তায় রাস্তায় বহু মেয়েকে এইভাবে হংকং শহরে ঘুরতে দেখা যায়, অধিকাংশ চীন দেশের মোহাজেরান। জুজুর ভয়ে হুজুগে এসে এখন ফিরে যেতেও পারে না, আর কাজ করে যে খাবে সে ব্যবস্থাও নাই। অনেক দুঃখে দিন কাটছে ওদের। দেশের মালিক ইংরেজ, জনগণ না। ইংরেজ জাত, যে যায় তাকে আশ্রয় দেয়, তাই এত যুদ্ধের পরেও জাতটা বেঁচে আছে আর থাকবেও। আমাদের সাথে অনেক ইংরেজের দেখা হলো, আলাপ হলো। যখন শুনলো আমরা পাকিস্তানি, ব্রিটিশ কমনওয়েলথের একটা দেশ, খুব খাতির করতে লাগলো। ভালো ব্যবহারও করলো। এবং অনেক বিষয়ে আলাপ করলো। চীন দেশে যাবো শুনে আমেরিকানদের মতো আঁতকে উঠল না। একজন বললো, বহুদিন পরে চীন দেশে একটা সত্যিকারের সরকার কায়েম হয়েছে। এখন চীন দেশে আইন-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
হংকংয়ে না পাওয়া যায় এমন কোনো জিনিস নাই। মালপত্র খুব সস্তা। সেখানে জিনিসের দামের ওপর ট্যাক্স না বসানোর জন্য জিনিসপত্র খুবই সস্তায় পাওয়া যায়Ñ বিশেষ করে কাপড়, ঘড়ি, পেন এবং নানাবিধ ‘কনজুমার্স গুড’স। পাকিস্তানি টাকার ছয় টাকায় যে হাওয়াই শার্ট পাওয়া যায় তার দাম আমাদের দেশে ৩০ টাকা। যে গরম জ্যাকেট আমি এনেছিলাম পাকিস্তানি টাকার মূল্যে ২৪ টাকায় তার দাম আমাদের দেশে কমপক্ষে ১০০ টাকা। যে স্যুট আমি ও আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যরা ৬০ টাকায় বানাইয়া আনি, তার দাম কমপক্ষে আমাদের দেশে ২০০ টাকা। অন্য জিনিসের দাম আপনারা চিন্তা করে দেখতে পারেন এই পরিমাণে কম হবে। ঘড়ি ও পেনের দাম আমাদের দেশে হংকংয়ের থেকে ডাবল হবে। তবে, সেখানে খাদ্যের দাম প্রায় আমাদের দেশের মতোই। খাবার বিদেশ থেকে আনতে হয়। কারণ হংকং চীন দেশের মেইনল্যান্ডের পাশে ক্ষুদ্র একটা দ্বীপময় স্থান। যথেষ্ট খাবার হতে পারে না, কেননা লোক সংখ্যা খুবই বেশি। চোর ডাকাত খুব বেশি নাই। ইংরেজ সেটা দমন করেছে, তবে ৪২০-এর আমদানি কিছুটা বেশি। নতুন মানুষ দেখলে কিছুটা চেষ্টা করে বই কি! তবে আমাদের ওপর চালাতে পারে নাই। কারণ আমরা হুঁশিয়ার ছিলাম।
রাত প্রায় ৯টায় আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। আমি ও ইলিয়াস এক রুমে ছিলাম। খাওয়া-দাওয়ার পরে খুব আরামে ঘুম হলো, কারণ ক্লান্ত ছিলাম।
সকালে উঠে আমরা গোসল করে প্রস্তুত হলাম, কারণ নয়াচীনে রওয়ানা করবো। আমাদের সকালেই খবর দিয়ে যাওয়া হলো। শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আমাদের সকল কিছু দেখাশুনা করতে লাগলো। সকাল ৯টায় আমরা কোলন রেল স্টেশনে উপস্থিত হলাম। আমাদের মালপত্র পূর্বেই স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেয়ে দেখি মালপত্র ট্রেনের কামরায় উঠে যাচ্ছে। ট্রেনগুলির কামরা আমাদের দেশের কামরার মতো না। দুইটা করে সিট, একটা বেঞ্চ (ইবহপয)Ñ গদি দেওয়া, আমরা উঠে পড়লাম। কিছু সময় পরে ট্রেন ছেড়ে দিলো।
নয়াচীন ও হংকংয়ের সীমানায় এলাম। ছোট খাল দ্বারা ভাগ হয়েছে। আমরা ইংরেজের জায়গায় নামলাম। ছোট স্টেশন, অনেক বই পাওয়া যায়। আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করা হলো। ভিসা এনে দেওয়া হলো। আমাদের জন্য দোভাষী ঠিক করাই ছিল, যথাসময়ে এসে হাজির। আমাদের শরবত খাওয়ালো। আমাদের মালপত্রের জন্য চিন্তা নাই, চীনের শান্তি সেনারা (শান্তি কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী) তার দেখভাল করেছে। পরীক্ষা করে ইংরেজ সীমানা থেকে চীন সীমানার পূর্বে নিয়ে গিয়েছে। সব মিলে এসে প্রায় দু’ঘণ্টা লাগলো।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে আরম্ভ করলাম। কিছুক্ষণ পরে দোভাষী এসে আমাদের জানালো, এবার আপনারা রওয়ানা করুন। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সকলই ঠিক হয়ে গেছে। একটা পুল পার হয়ে নয়াচীনে ঢুকতে হবে। পুলটার অর্ধেক হংকংয়ের, অর্ধেক নয়াচীনের। দু’পাশেই বন্দুকধারী প্রহরী পাহারা দিচ্ছে। আমরা আবার ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমরা ক্যান্টন শহরে যাচ্ছি। এই শহরটা খুবই সুন্দর, অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে লাল চীন সৈন্যবাহিনী এই শহর দখল করে এবং চিয়াং কাইশেক ফরমোজা দ্বীপে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
আমরা ট্রেনে কিছু খেয়ে নিলাম। ফলের জোগাড় যথেষ্ট তারা করেছে। এই সময়ে মানিক ভাইয়ের কথা সামান্য লেখা দরকার। ‘মানিক ভাই ভালো লেখতে পারেন, কিন্তু এত যে খেতে পারেন তা আগে জানতাম না। সমানে খেতে শুরু করলেন, মনে হলো প্রায় ২/৩ ঘণ্টা খেয়েই চললেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মানিক ভাই পেটে হলো কী? বললেন, দুর্ভিক্ষ হয়েছে।’ মানিক ভাই দোভাষীকে নিয়ে বসলেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আর খাওয়ার পরে খাওয়া চললো। মানিক ভাইয়ের স্মরণশক্তি অস্বাভাবিক, নোট করতে হয় না। কেমন করে সবকিছু মনে রাখেন বুঝতে পারি না। যা হোক, আমিও একটি মাস্টারকে নিয়ে পড়লাম। ভদ্রলোক ইংরেজি জানেন না, দোভাষী তার কথা আমাকে বুঝাইয়া দেয়, আমার কথা তাঁকে। আলোচনাটা পরে উল্লেখ করবো।
[চলবে]
সূত্র : আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান