নূহ-উল-আলম লেনিন: আমরা যারা ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই নিঃসন্দেহে আমরা সৌভাগ্যবান! বিশেষ করে আমরা যারা বাংলা বিভাগে পড়ার সুযোগ পাই, তাদের ভাগ্য কেবল সুপ্রসন্ন ছিল তাই নয়, ঈর্ষণীয়ও বলা যেতে পারে। যাদের আমরা শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, তারা কেবল খ্যাত কীর্তি মনীষীই ছিলেন না, তারা ছিলেন রেনেসাঁ চরিত্রের বিরলপ্রজ মানুষ। এই বাংলায় উনিশ শতকের অসম্পূর্ণ রেনেসাঁকে যারা সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়েছেন- একটা জাতিসত্তার মানসলোক গঠনের কারিগর হিসেবে অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন ছিলেন বাংলা বিভাগের শিক্ষক।
আমরা বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পেয়েছি প্রফেসর আবদুল হাইকে। আমাদের পড়িয়েছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, রফিকুল ইসলাম প্রমুখ কৃতবিদ্য শিক্ষকগণ। বছর না ঘুরতেই প্রফেসর হাই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে আলবদর বাহিনীর হাতে শহিদ হন মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা। এসব প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষকের অবদান বাঙালি জাতি কোনোদিন বিস্মৃত হবে না।
তরুণ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেই ত্রিশ বছর বয়সেই বিদ্বৎসমাজে সুপ-িত এবং মেধাবী হিসেবে পরিচিত। আমরা তাঁকে জানতাম, অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে বাংলা মাস্টার্স পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। স্বল্প ও মৃদুভাষী এই শিক্ষককে সবাই সমীহ করত। আমরা তাকে বেশি দিন পাইনি। ’৬৯ সালে রিডারের পদ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। ’৭১-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। পরে ভারতে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও ছিল তার ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর তাকে পেলেও আমরা তার ক্লাস পাইনি। উপরের ক্লাসে পড়াতেন। তবে আমরা অনেকেই তার সুখ্যাতি শুনে তার ক্লাস শুনতে যেতাম। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়াতেন। কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার অসাধারণ গুণ ছিল তার। মুগ্ধ বিস্ময়ে তার ক্লাস শুনে ফিরতাম।
ছাত্র রাজনীতির সুবাদে আমি তখনই জানতাম, আনিসুজ্জামান প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ ছিলেন। সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল না করলেও তিনি বাম প্রগতিশীলদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়। তৃতীয় শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাস হাই স্কুলে পড়ার পর বাংলাদেশে চলে আসেন। অষ্টম শ্রেণি পড়েন খুলনা জিলা স্কুলে। পরে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। তিনি প্রিয়নাথ হাই স্কুলে (বর্তমানে নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে তিনি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৫৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯১৮)’ বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
আনিসুজ্জামান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ বুড়িগঙ্গার গ্রিনবোটে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৪৬ যোগীনগরে ছিল যুবলীগের কার্যালয়। যুবলীগের অফিসের লেখালেখির কাজে যুক্ত থাকায় ১৯৫২ সালের এক পর্যায়ে আনিসুজ্জামানকে যুবলীগের সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের অনেক লিফলেট ও প্রেসরিলিজ ইত্যাদি আনিসুজ্জামানের লেখা। তিনি ড্রাফট করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। পরবর্তী জীবনেও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন/সংগঠনের অনেক কর্মসূচি, দাবিনামা ইত্যাদি তিনি ড্রাফট করে দিয়েছেন।
আসিসুজ্জামান কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি সদস্য বা সংগঠক ছিলেন না। তবে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। তার বন্ধুদের অনেকেই বামপন্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন নেয়ামুল বাশার প্রমুখ বন্ধু তাকে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র গ্রুপের সদস্য করেছিলেন। কিন্তু পরে আর তিনি সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ নেননি।
ভাষা আন্দোলন শেষে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বাধা দিলে আনিসুজ্জামান অন্যান্য বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীর সাথে যুক্ত হয়ে সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বস্তুত বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিজ অবস্থান থেকে আনিসুজ্জামান যথাসাধ্য ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু তাকে দেশের সংবিধান রচনার সাথে যুক্ত করেন। তিনি গণপরিষদের সদস্য না হলেও সংবিধান প্রণয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে কমিটি করেন, আনিসুজ্জামানকে সেই কমিটির সাথে কাজ করার দায়িত্ব দেন। সংবিধানের বাংলা ভাষ্য তৈরির মূল দায়িত্ব ছিল আনিসুজ্জামানের। পরে সংবিধানে একটি ধারা সংযোজিত হয়, যদি ইংরেজি ও বাংলা সংবিধানের মধ্যে কোনো বিষয়ে তারতম্য হয়, সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষ্যটিকেই প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এই সংবিধানের সাথে আনিসুজ্জামানের নাম তাই চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল ড. কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে। বঙ্গবন্ধু এই শিক্ষা কমিশনেও আনিসুজ্জামানকে সদস্য হিসেবে রাখেন।
স্বাধীনতার পর আনিসুজ্জামান বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া তিনি আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের সভাপতি ছিলেন।
তার গবেষণার পরিধিও বিস্তৃত। ভাষা ও সাহিত্যের নানা বিষয়ে তার গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রণীত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতকেরও বেশি।
আনিসুজ্জামান তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশের প্রচুর মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’ ও ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারে’ তিনি ভূষিত হয়েছেন। ভারতের তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পদ্মভূষণেও তাকে ভূষিত করা হয়েছে। এছাড়া পেয়েছেন অনারারি ডক্টরেট, আনন্দ পুরস্কার ইত্যাদি।
মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন ‘জাতীয় অধ্যাপক’। সেই সাথে দীর্ঘদিন তিনি বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন এবং তার প্রিয় শিক্ষক আনিসুজ্জামানকে আমৃত্যু গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন বিনয়ী, সদালাপী, নিরহঙ্কার এবং সকল রকম বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে আমার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘জ্ঞানপীঠ স্বদেশ গবেষণা কেন্দ্র’ উদ্বোধন করেছেন। একইসঙ্গে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন পরিচালিত ‘বঙ্গীয় গ্রন্থ জাদুঘর’-এরও সদস্য ছিলেন। আমাদের অভিভাবক যেমন ছিলেন তিনি, তেমনি পালন করেছেন জাতির বিবেকের ভূমিকা। সত্য প্রকাশে এবং নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তা প্রকাশে তিনি ছিলেন অকুণ্ঠ। অবশ্যই আনিসুজ্জামান স্যার বাঙালির অসমাপ্ত রেনেসাঁর অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ