Sunday, September 24, 2023
বাড়িSliderআমাদের পদ্মা সেতু

আমাদের পদ্মা সেতু

পুরো আট বছর ধরে নদীশাসনের কাজ চলে। কোনো সেতু নির্মাণে এত বড় নদীশাসনের কাজ পৃথিবীতে এর আগে আর কোথাও হয়নি।

একেএম আনোয়ারুল ইসলাম: পদ্মা সেতু তৈরির প্রথম প্রস্তাবনা আসে বঙ্গবন্ধু সেতু খুলে দেওয়ার মাস খানেকের মধ্যে ১৬ জুলাই ১৯৯৮, আনুমানিক ৩ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মাওয়া ঘাটে। প্রস্তাবিত সেতুর দৈর্ঘ্য ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৮ মিটার। বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ জুলাই ২০০১ পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তী সরকারের সময়ে বিভিন্ন গাফিলতির কারণে সেতু নির্মাণের কাজ পিছিয়ে যায়। ২০০৬-০৭ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সেতু নির্মাণের প্রস্তাবনা অনুমোদিত হলেও কাজ এগোয় না। বাংলাদেশের জনগণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই সেতু নির্মাণের প্রকল্প আবার নিজ হাতে তুলে নেন।
এপ্রিল ২০১০-এ প্রাক-উপযোগিতা মূল্যায়নের জন্য দরপত্র ডাকা হয়। আশা, ২০১১-তে কাজ শুরু করে ২০১৫-তে শেষ করা। কিছু লোকের ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণের কাজ পিছিয়ে গেলেও থেমে থাকে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচ- আত্মবিশ্বাস ও আগ্রহ নিয়ে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চালিয়ে যান। বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য দাতাসংস্থা যখন অনুমাননির্ভর, অযাচাইকৃত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কল্পনাপ্রসূত দুর্নীতির অভিযোগ এনে সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ বিনিয়োগে অস্বীকৃতি জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন ৯ জুলাই ২০১২, দৃঢ় প্রত্যয়ে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। এ-রকম একটি সাহসিক এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে দেশবাসী একদিকে যেমন বিস্মিত, অন্যদিকে তেমন আশান্বিত হয়ে উঠল। এদিকে সংশয়বাদীরাও পিছিয়ে থাকল না। কেউ কেউ বলেই ফেলল, আওয়ামী লীগ সরকার জীবনেও এ সেতু তৈরি করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাথা নোয়াবার নন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন পূরণে বাঙালি জাতি আরও একধাপ এগিয়ে যায়।

প্রায় ৩০ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হলো বহুল প্রতীক্ষিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আর অবহেলিত থাকবে না। তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনটিই আশা করেন। সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ২৫ জুন ২০২২, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করলেন আমাদের পদ্মা সেতু। মুরালের বাঁয়ে বঙ্গবন্ধু, ডানে তার কন্যা শেখ হাসিনা, পদ্মা সেতুর রূপকার আমাদের প্রধানমন্ত্রী। সারাবিশ্ব দেখল বাঙালি জাতির পরিতৃপ্ত হাসি, ‘আমরাও পারি’ সেøাগানে মুষ্টিবদ্ধ হাত।
‘পদ্মা সেতু এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীকে পরিণত হয়েছে’ একটি ফেসবুক পোস্টে বললেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। পদ্মা সেতু শুধু আমাদের গর্বই নয়, আমাদের অহংকারও। আর এই গর্ব ও অহংকার আমরা অর্জন করেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ও নিখুঁত পরিকল্পনায়।
সর্বমোট ৪২টি পিলারের মধ্যে বসেছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১টি স্প্যান; নিচে একটা স্টিল ট্রাস ডুয়েল গেজ রেললাইন, উপরে যানবাহন চলাচলের জন্য চার-লেনের ২২ মিটার প্রশস্ত কংক্রিট ডেকÑ এসব নিয়েই ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আমাদের পদ্মা সেতু। প্রকৌশলীদের বিশ্লেষণে ১২০, ১৫০ ও ১৮০ মিটার দীর্ঘ স্প্যানের মধ্যে ১৫০ মিটার স্প্যান সবচেয়ে বেশি সাশ্রয়ী হওয়ায় মূল সেতুর প্রতিটি স্প্যান ১৫০ মিটার নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি স্প্যানের ধারণক্ষমতা ১০ হাজার টন, যা পুরো স্প্যানের উপরে ভারী যানবাহন আর নিচে রেলগাড়িতে ভরা মোট ওজনের কমপক্ষে ৩ গুণ। ৪০টা মধ্যবর্তী পিলারের প্রতিটিতে রয়েছে কংক্রিটে ভর্তি ৬টি (কোনোটিতে ৭টি) স্টিল পাইল। একেকটি পাইল ১২২ মিটার পর্যন্ত লম্বা, ৩ মিটার ব্যাস এবং ল্যাটারেল লোড রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধির জন্য মাটিতে প্রোথিত হয়েছে প্রায় ৯.৪৬ ডিগ্রি কোণে। পৃথিবীতে কোনো সেতুতে এত বড় পাইলের ব্যবহার এই প্রথম। শেষ দুটি পিলারের প্রতিটিতে রয়েছে একেকটি ৮০ মিটার পর্যন্ত লম্বা ৮টি বোর্ড (Bored) পাইল।
পদ্মা বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীগুলোর অন্যতম। এটা পৃথিবীর বৃহত্তম পলিবাহী নদী। ফলে বর্ষার ভরা মৌসুমে খরস্রোতা পদ্মা তলদেশের মাটি ক্ষয় করে সাথে বয়ে নিয়ে যায়। এতে সেতুর ভিত্তি নির্মাণে অধিক শক্তিশালী ও গভীর পাইলিং করার দরকার হয়। নদীর ক্ষয়িষ্ণু তলদেশের কারণে ধরা হয়েছে যে পাইলের প্রথম ৬০ মিটারে নদীর তলদেশে মাটি থাকলেও মাটির কোনো কার্যকারিতা বিবেচনায় আনা হবে না। এ-রকম একটি খরস্রোতা নদী, যে নদীতে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, সেই নদীর তলদেশে একটি নির্দিষ্ট কোণে পাইল ড্রাইভিং অত্যন্ত দুরূহ ও কঠিন কাজ। জার্মানির ৩৮০ টন ওজনের MENCK হাইড্রোলিক হ্যামারসহ আরও দুটি হ্যামার দিয়ে ২৯৪টি পাইল ড্রাইভিং করতে মোট সময় লেগেছে তিন বছর সাত মাস। একেকটি পাইলের ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ২৫০ থেকে ৮ হাজার ২০০ টন। পাইলের ওপরে পাইলক্যাপ বানিয়ে পিলার তৈরি করা হয়। বিভিন্ন স্প্যানে পিলারের ওপর ডেক বসানোর সময় নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয়। ৩ হাজার ৬০০ টন উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন ভাসমান ক্রেন ব্যবহার করা হয় ডেক বহনের জন্য। শুষ্ক মৌসুমে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় ভাসমান ক্রেন চলাচলে বিঘœ ঘটে এবং সেতুর কাজ বিলম্বিত হয়।
নদীশাসন ছিল আরেকটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল ব্যাপার। ব্যাপক নদীশাসন মূলত এই উপমহাদেশের সেতু নির্মাণেই করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এর আগে বঙ্গবন্ধু সেতুতে সর্বপ্রথম এত বড় মাপের নদীশাসন করা হয়। এছাড়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজ (১৯১৫) ও মেঘনা ব্রিজ (২০০৩) নির্মাণেও বেশ বড়সড় নদীশাসনের প্রয়োজন হয়। পদ্মা পৃথিবীর বৃহত্তম পলিবাহী নদী হওয়ায়, পদ্মার পাড় ও তলদেশের ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ ৫০ থেকে ৭০ মিটার পর্যন্ত গভীর হতে পারে। এজন্য পাড়ের ক্ষয়রোধে নদীশাসন অপরিহার্য। ড্রেজার দিয়ে তীরের মাটি সরিয়ে সেখানে বড় বড় পাথর, কংক্রিট ব্লক এবং বালিভর্তি জিও-ব্যাগ ফেলে নদীশাসনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। পুরো আট বছর ধরে নদীশাসনের কাজ চলে। কোনো সেতু নির্মাণে এত বড় নদীশাসনের কাজ পৃথিবীতে এর আগে আর কোথাও হয়নি।
এছাড়া পদ্মা সেতু একটি সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। তাই রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতুর উপরিকাঠামোর (কংক্রিট ডেক ও রেললাইন) যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে-জন্য উপরিকাঠমো ও অবকাঠামোর (পাইল ও পিলার) মাঝখানে ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে ভূমিকম্পের সময় অবকাঠামো নড়ে গেলেও উপরিকাঠামো স্থির ও অক্ষত থাকবে। ফ্রিকশন বা ঘর্ষণের মাধ্যমে ভূমিকম্পের শক্তির ক্ষয় হবে। ফলে যানবাহনের যাত্রীরা ভূমিকম্প হলেও টের পাবে না। ভূমিকম্প শেষে সেতুর বক্রতার কারণে সেতু আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে। ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং ব্যবহারে সেতু নির্মাণে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি সাশ্রয় হয়েছে। এছাড়া ব্যবহৃত অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে মূল সেতুতে লাইটিং, সিসিটিভির বাইরেও টোল প্লাজায় রেডিও ফ্রিকোয়ন্সি আইডেন্টিফিকেশনের মাধ্যমে যানবাহনের টোল আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
মূল সেতু ও রাস্তার সাথে সংযোগকারী ভায়াডাক্টের পরিমাণ মাওয়া প্রান্তে ১.৪৮ কিলোমিটার এবং জাজিরা প্রান্তে ১.৬৭ কিলোমিটার, মোট ৩,১৫ কিলোমিটার, যা মূল সেতুর অর্ধেকের চেয়েও বেশি দীর্ঘ রেললাইনের ভায়াডাক্টের পরিমাণ আধা কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি। AECOM হংকং অফিসের তত্ত্বাবধানে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের ডিজাইনে চায়নার মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং। কোম্পানি নির্মাণ করেছে মূল সেতু। নদীশাসনের কাজ করেছে চায়নার সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন, দুই পাড়ের সংযোগ সড়কসহ অন্যান্য খুঁটিনাটি কাজ সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার এইচসিএম জয়েন্ট ভেনচার। [সূত্র : পদ্মা মাল্টিপারপাস ব্রিজ প্রজেক্ট, বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটি]
মূল সেতু নির্মাণের চেয়ে নদীশাসন, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনেই খরচ হয়েছে বেশি। মাওয়া পাড়ে ১.৬ কিলোমিটার, জাজিরা পাড়ে ১২.৪ কিলোমিটার, দুই পাড় মিলে মোট ১৪ কিলোমিটার নদীশাসন করতে হয়েছে। এছাড়া গ্যাস, রেল, বিদ্যুৎ, টেলিফোনের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার পরিবহন খরচের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে দিন দিন নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে থাকে, সেই সাথে কমতে থাকে ইউএস ডলারের সাপেক্ষে বাংলাদেশি টাকার মূল্যমান। উল্লেখ্য, নির্মাণ কাজের বেশিরভাগ খরচই পরিশোধ করতে হয়েছে ইউএস ডলারে। সেতু নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধিতে দুর্নীতির ভিত্তিহীন ও ঢালাও অভিযোগ যারা করেন, তাদের এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা দরকার।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ টাকা বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে, যা ৩০ বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকায় পরিশোধ করতে হবে। অনুমান করা হচ্ছে, এই সেতু দিয়ে এখন প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার যানবাহন পারাপার হবে, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৪২ হাজারে এবং ২০৫০ সালে ৬৭ হাজারে। একটু হিসাব করলে বোঝা যাবে, শুধু টোলের টাকাতে সেতু নির্মাণের খরচ উঠে আসবে সাড়ে ৯ বছরে। আর পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে এই টাকা উঠে আসবে ৯ মাসেই। পদ্মা সেতুর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করে সেতু কর্তৃপক্ষ অতি সহজেই এই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।
সেতু নির্মাণ, ডিজাইন ও গবেষণা করে দেশে-বিদেশে কাটিয়েছি ২৮ বছর। একসময় হুন্ডাইয়ের হয়ে কাজ করেছি বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে, পেশাগত কারণে বিদেশে থাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে সরাসরি যুক্ত হতে পারিনি। তবুও আমার প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নিয়মিত জানতে পারতাম। তাছাড়া, ইউটিউব ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমেও সেতু নির্মাণে সাফল্য, সমস্যা ও জটিলতার খবর পেতাম। বাংলাদেশে এত বড় কোনো প্রকল্প কখনও বাস্তবায়িত হয়নি, নিজেদের অর্থায়নে তো নয়ই। খরস্রোতা পদ্মায় সেতু নির্মাণ একটি ভয়ানক জটিল ও দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে তাই অনুমিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে সেতু নির্মাণে। স্বস্তি ও সুখের বিষয় এই যে, কোনোরকম বিদেশি শর্তের চোখ রাঙানো ছাড়াই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের ৫ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে এবং সারাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে আমাদের পদ্মা সেতু। তবে সেতু নির্মাণই শেষ কথা নয়, এর রক্ষণাবেক্ষণও সমপরিমাণ জরুরি। যেহেতু সেতুটি স্টিল এবং কংক্রিটের সমন্বয়ে নির্মিত, আলাদা আলাদা করে এর বিভিন্ন অংশের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। অনর্থক যানজট ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী সমস্যা থেকে সেতুকে মুক্ত রাখতে হবে। যে কোনো মেরামত তাৎক্ষণিকভাবে সারতে হবে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ পেলে ১০০ বছরের জন্য ডিজাইন করা হলেও এই সেতু বেঁচে থাকবে কয়েক’শ বছর।
পেশাগত কারণে বাংলাদেশের দু-একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কারিকুলাম আর ব্রিজ ও বিল্ডিং ডিজাইন দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছেÑ এখনও এখানে ৩০ বছর আগের পুরনো ডিজাইন কোড পড়ানো এবং সেই অনুযায়ী নির্মাণও করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ডিজাইন কোড অনেক দশকের গবেষণার প্রতিফল এবং সদাপরিবর্তনশীল ও আধুনিক। নিজেদের কোড নিজেদের উদ্ভাবন সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের সর্বশেষ ডিজাইন কোড ব্যবহার নিশ্চিত করে ডিজাইন মোতাবেক নির্মাণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবীর অনেক দেশই এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও পারি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের পশ্চিমা বিশ্বের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করে আমরা তার সুফল পেতে শুরু করেছি। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, ডিজিটালি আমরা অনেক এগিয়ে গেছি ঠিকই, টেকনোলজিক্যালি এখনও আমরা অনেক পিছিয়ে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আমি সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের গবেষণায় নিয়োজিত এবং গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রে ছোট-বড় সব সেতু প্রতি বছর (দুয়েকটা প্রতি দু-বছর অন্তর) সরেজমিনে পরিদর্শন করে পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট দাখিল করা বাধ্যতামূলক। এসব পরিদর্শনে কখনও ছোটখাটো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সমন্বয় করে রিপোর্টগুলো অনলাইন রিপোজিটরিতে রাখা হয় ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত ও গবেষণার প্রয়োজনে। আমরা প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ম্যাশিন লার্নিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন অজানা বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করার গবেষণা করি। যেমনÑ কোন ধরনের সেতু বর্তমানে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, কতটা সফল, কোন সেতু আর কতদিন সেবা দিতে পারবে, কী কী সমস্যা হতে পারে, কখন কোনটা মেরামত, সংস্কার কিংবা প্রতিস্থাপন করা দরকার, ইত্যাদি। এসব গবেষণার ফলাফল যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণীতে গুরুত্বপূর্ণ ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
গত এক মাসে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণের সময় আমাদের গ্রাম-গঞ্জ-শহরের অনেক সেতুর দীর্ণ-দৈন্যদশা প্রত্যক্ষ করেছি। বারবার মনে হয়েছে, আমি এত বছর ধরে সেতুর স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছি আর আমার নিজের দেশের সেতুগুলোর এ কি দুরবস্থা! মনে হয়েছে, আমাদের একটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আইএমএস) তৈরি করা অত্যাবশ্যক। এখানে দেশের সমস্ত সেতু নিবন্ধিত হবে, ওগুলোর বর্তমান অবস্থাও লিপিবদ্ধ করা হবে। প্রতি বছর প্রত্যকটা সেতু পরিদর্শন উপজেলা পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে একটা অনলাইন রিপোজিটরি গড়ে তোলা হবে এবং প্রতি বছর পরিদর্শনের পর নতুন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সেতুর অবস্থা হালনাগাদ করা হবে। পরে এই রিপোজিটরি ব্যবহার করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন সেতুর মেরামত, সংস্কার কিংবা প্রতিস্থাপন এবং গবেষণা করা হবে। আমরা প্রবাসী বাঙালিরা সুযোগ পেলে এ-রকম রিপোজিটরি তৈরির প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি, যার যার অবস্থানে থেকে আমরা বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যেতে পারি, করতে চাই। এই ডিজিটাল যুগে পৃথিবীর যে কোনো দেশে থেকে নিজের দেশের জন্য কাজ করা যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেলে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করে আমরা অতিসত্বর আইএমএস তৈরির কাজ শুরু করতে পারি। আমার জানামতে, কাজের অনেকটা করা আছে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সারাদেশে। এখন শুধু দরকার উদ্যোগ, সমন্বয় এবং সম্মিলিত তথ্য-উপাত্তের যথাযথ আপলোড। এ বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সেই সাথে সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যুগোপযোগী গবেষণা ও নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক (পিএইচডি, পিই), সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইয়ংস্টাউন স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রদ্ধাঞ্জলি
পরবর্তী নিবন্ধপরনির্ভরতার অচলায়তন ভেঙেছি
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য