Monday, October 2, 2023
বাড়িSliderআমাদের জাতীয় চার নেতা

আমাদের জাতীয় চার নেতা

মুনতাসীর মামুন: বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্ন বাঙালির মননে প্রোথিত করেছেন এবং তা কার্যকর করেছেন। স্বপ্ন দেখা খুব সহজ। বাংলাদেশের স্বপ্ন বিভিন্ন ফর্মে অনেকে দেখেছেন, বৈষম্য না কমালে আলাদা হয়ে যাবে বাঙালিরা, সে-কথাও অনেকে বলেছেন। এর থেকে একটু কঠিন, স্বপ্ন অন্যদের মনে সঞ্চারিত করা। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর আগে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের স্বপ্ন সঞ্চারিত করতে পেরেছিল অধিকাংশ বাঙালি মুসলমানের মনে। কিন্তু যে তরুণরা পাকিস্তান আনলেন তারাই আবার দু-বছরের মাথায় তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন সেটি অভাবনীয়। আরও বড় বিষয়, বাঙালি পাকিস্তানির মনে বাংলাদেশের স্বপ্ন সঞ্চারিত করা। হ্যাঁ, ২০ বছর লেগেছে কিন্তু স্বপ্ন সঞ্চারিত তিনি করতে পেরেছিলেন। কারণ, কমিউনিস্ট নেতাদের মতো তার আত্মত্যাগ ও সততা। সবচেয়ে কঠিন স্বপ্ন কার্যকর করা। বঙ্গবন্ধু অনুভব করেছিলেন স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সংগঠন করতে হবে। সে-জন্য আওয়ামী [মুসলিম] লীগ গঠনে ১৯৪৯ সালেই যোগ দিয়েছেন এবং সারাদেশ ঘুরে সাধারণের সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন। তখনকার তরুণরা ছিলেন তার সঙ্গে। ঐ একঝাঁক তরুণের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামারুজ্জামান। এরা আওয়ামী লীগ ছেড়ে কখনও যাননি, সুখে-দুঃখে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগেই থেকেছেন। তাদের সমসাময়িক অনেক নেতারা আওয়ামী লীগ করেছেন, ছেড়েছেন, আবার এসেছেন। কিন্তু এরা সে কাজটি করেননি। এবং আশ্চর্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাদেরও হত্যা করা হয়। অন্যদের নয়।
রাজনৈতিক নেতাদের এরকম আনুগত্য বোধ লক্ষণীয়। আজকে যারা রাজনীতি করছেন, তাদের এ বিষয়টি শিক্ষণীয়। অর্থাৎ যে আদর্শ ধারণ করব, সেটি সুবিধার জন্য ত্যাগ করব না। যারা এটি বিশ্বাস করেন তারাই ইতিহাসে থাকেন, অন্যরা নয়। যে চারজনের কথা উল্লেখ করলাম, আজ তারা এ কারণেই জাতীয় চার নেতা, অন্যরা নয়। আর আদর্শ বা নেতার প্রতি যাদের আনুগত্য ছিল না তারা হারিয়ে গেছেন, যেমনÑ খন্দকার মোশতাক। শেখ হাসিনা তো এমনও বললেন, কুমিল্লা বিভাগ নাম হবে না। কু দিয়ে এটির শুরু এবং মোশতাক কুমিল্লার।
চার নেতার মধ্যে বয়সে এম মনসুর আলী ছিলেন জ্যেষ্ঠ তারপর কামারুজ্জামান এরপর বাকি দুজন, একই সময় জন্ম। পাবনা ছিল মনসুর আলীর চারণ ক্ষেত্র এবং আইনজ্ঞ হিসেবে সেখানে কাজ শুরু করেন। তাকে সম্মান করে হোমগার্ডের অনারারি ক্যাপ্টেন করা হয়েছিল, সেই থেকে ‘ক্যাপ্টেন’ নামটি আজীবন তার নামের সঙ্গে থেকে গেছে। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগ গড়ে তুলছেন তখন পাবনার যাবতীয় দায়িত্ব ছিল মনসুর আলীর ওপর। শেখ হাসিনা সম্পাদিত সিক্রেট ডকুমেন্টস-এ তার নামই পাওয়া যায়। অন্যদের তেমন নয়। এর অর্থ তখনই তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা হিসেবে পরিচিত। পরে যুক্ত হন কেন্দ্রের সঙ্গে।
অন্যদিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকাতেই পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন; বঙ্গবন্ধু এখানে আসার আগে। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফেরার পর নিজ সাংগঠনিক কর্মক্ষমতার কারণে শামসুল হকের পাশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। অচিরেই শামসুল হক নয়, তিনিই তরুণদের নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাজউদ্দীন ঢাকাতে, সৈয়দ নজরুল ময়মনসিংহে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। কামারুজ্জামান ষাটের দশকে রাজশাহীতে নিজ আসন দৃঢ় করেন। অচিরেই চারজনই কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন তাজউদ্দীনের ওপর, তাকে হিন্দু পরিবারের ছেলে হিসেবে আখ্যা দিতেও তারা দ্বিধা করেননি। তাদের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যায়, তাজউদ্দীনের সঙ্গে নয়। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন, তাজউদ্দীন নয়, তখন তিনিই আওয়ামী লীগের দেখভাল করতেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৬৪ থেকে আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে দল পরিচালনার ভার তার ওপরই ন্যস্ত ছিল। কামারুজ্জামান ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সুতরাং, দেখা যায় পঞ্চাশ দশক থেকেই তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দল, আদর্শ কোনো কিছুই ত্যাগ করেননি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালে গ্রেফতারের আগে চার যুবনেতা ও চার নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। কাজী আরিফ এক স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, ২১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু চার যুব নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন এবং তাদের বলেন, “আমি না থাকলেও তাজউদ্দীনকে নিয়ে তোমরা সব ব্যবস্থা করো। তোমাদের জন্য অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের সব ব্যবস্থা থাকবে।” বঙ্গবন্ধু তাদের কলকাতার একটি ঠিকানা দিয়ে বলেন, “এই ঠিকানায় গেলেই তোমরা প্রবাসী সরকার, সশস্ত্র বাহিনী গঠন, ট্রেনিং ও অস্ত্রশস্ত্রের সহযোগিতা পাবে। নেতা বলেন, তোমরা চারজন সশস্ত্র যুবশক্তিকে পরিচালনা করবে। আর তাজউদ্দীন প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব নেবে। তিনি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের কথা বারবার করে বলেন, বিপ্লবী কাউন্সিল প্রয়োজনে স্বাধীনতার পরও পাঁচ বছর থাকবে। তিনি কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকেও এই কথাগুলো জানিয়ে রাখেন।” উল্লেখ্য, খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। কাজী আরিফের ভাষ্য সঠিক হলে বলতে হয়, তাকে প্রবাসী সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও তিনি বলেননি।
তারপরের ইতিহাস সবার জানা। মুজিবনগরের মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে দ্বন্দ্বের কথাও কারও অজানা নয়। যুব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ জানার পরও বিরোধিতা করেছিলেন তাজউদ্দীনের। তখন সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দীনকে সমর্থন করেছেন। আওয়ামী লীগের তিনিই তখন সিনিয়র নেতা। বলতে গেলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তার সমর্থন বিরাট ব্যাপার ছিল। বাকি দুজনও তাজউদ্দীনকে একনিষ্ঠভাবে সমর্থন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় ষড়যন্ত্রের কথা বলতেন। মুজিবনগর সরকারেও ছিল একই ব্যাপার। শেখ হাসিনাও ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন এবং তা প্রমাণিতও হচ্ছে। মনে হয় বাঙালির ডিএনএ’তে ষড়যন্ত্রের একটি উপাদান প্রোথিত।
মুজিবনগর সরকারের বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। বিভিন্ন বইপত্রেই তা পাওয়া যাবে। দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রাক্তন সম্পাদক ও মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বিশিষ্ট সাংবাদিক মানস ঘোষ ঐ সময় নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, তাজউদ্দীন সম্পর্কেও যে ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা সন্দিহান ছিলেন না তা নয়। কিন্তু চিত্তরঞ্জন সুতার যখন ইন্দিরা গান্ধীর দপ্তরে জানালেন, তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত ব্যক্তি তখন তারা সন্দেহমুক্ত হয়। সুতারের মতে- “That Tajuddin was, indeed, the senior most member of the secret government had formed for leading the liberation war in his absence and that he not only enjoyed Mujib’s total confidence but that of entire party, the hitch was resolved.”
তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কথা ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা জানতেন। তাদের একজন মানস ঘোষকে বলেছিলেন, এ সময় [১৯৭১] আওয়ামী লীগে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো তাজউদ্দীন ছাড়া কেউ নেই।
ভারতীয় কর্মকর্তারা যে বাঙালি নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন তা নয়। জানিয়েছেন মানস ঘোষ। বাংলাদেশের তরুণ সামরিক অফিসাররাও ভারতীয় প্রশিক্ষকদের পছন্দ করতেন না। প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামানকে বিষয়টি জানালে, তিনি বলেছিলেন, “এসব তরুণ অফিসাররা পাকিস্তানি মানসিকতা ত্যাগ করতে পারেননি।” এমন কী স্বাধীনতার পরও এ ধারণা থেকে তারা বেরুতে পারেনি। যে কারণে, বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতাকে তারা হত্যা করে।
খন্দকার মোশতাক ও তার অনুসারীদের তাজউদ্দীন বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের বিশদ বর্ণনা দিয়ে মানস ঘোষ লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রচারিত পোস্টার [আমরা বাঙালি]-এর সমালোচনা করেছেন মোশতাক। মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বলতেন, “তোমরা মোসলমান, আল্লার দোহাই, তোমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা তুলো না। শুধু আল্লাহ আল্লাহ করো।”
মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিচারণ করে ১৯৭২ সালে তাজউদ্দীন দৈনিক বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম, সেটাই আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি (কুষ্টিয়া জেলায়) নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা হল একটি স্বাধীন বাংলা সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে কাজ শুরু করা।”
৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি বলেন, “এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই।”
খন্দকার মোশতাকরা যখন আমেরিকার সঙ্গে দহমহরম করছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে চাইলে স্বাধীনতায় ছাড় দিতে হবে এমন প্রস্তাব করছিলেন এবং তা মেনে নেওয়ার জন্য তাজউদ্দীনকে চাপা দিচ্ছিন তখন তিনি বলেছিলেনÑ “পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি সংগ্রামের এক পর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতা চাও না-কি মুজিবকে চাও। এর উত্তরে আমি বলেছিলাম স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই।”
তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা ঠিক; কিন্তু বাকি চারজন দৃঢ় সমর্থন না দিলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হতো না।
তিনি এর জন্য কোনো কৃতিত্ব কখনই নিতে চাননি। বলেছেন, “আমি তো শুধু ধাত্রীর কর্তব্য পালন করেছি।”
বঙ্গবন্ধু নেতা ছিলেন ঠিকই কিন্তু সামষ্টিক নেতৃত্বের ওপরও জোর দিয়েছিলেন, সৈয়দ নজরুল সেটির ওপরই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাকি চারজনও তা মেনেছিলেন। উল্লেখ এদের সবার সিনিয়র ছিলেন মনসুর আলী বঙ্গবন্ধু থেকেও এক বছরের বড়। তারপর বয়সের দিক থেকে কামারুজ্জামান বাকি দুজন একই বয়সী। কিন্তু নেতৃত্ব নিয়ে তাদের কোনো মনোমালিন্য হয়নি। এবং কখনও আলাদাভাবে। গৌণভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য কোনো কৃতিত্ব নিতে চাননি। খুব বড় মাপের মানুষ না হলে এরকম বিনয় দেখানো সম্ভব নয়। তাদের থেকে এ বিষয়টিও শিক্ষণীয়।
সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি করেছিলেন। এ নিয়ে বিরোধীরা অনেক কথা বলেন। ‘দেশ বিক্রির’ কথা বলেন। কিন্তু বাস্তব হলো- ‘দেশ বিক্রির’ কোনো ধারা সেখানে ছিল না। বরং ঐ চুক্তির ফলে বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর আস্থা বৃদ্ধি হয়েছিল। প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ-কে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সৈন্য প্রত্যাহার করেছেন। এসব কৃতিত্ব এদের কেউ দিতে চান না। ১৯৭৪ সালের ২৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে তাজউদ্দীন বলেছিলেন, “এমনকি যুদ্ধের দিনে, সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখুনি হবে যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না।… ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সঙ্গে এসেছিল। সেদিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোনো গোপন চুক্তি ভারতের সঙ্গে হয়নি। একটাই চুক্তি হয়েছে… যেখানে লেখা ছিল আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী হিসেবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এবং যেদিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই সেই দিন তোমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যেদিন বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখুনি মিসেস গান্ধী ১৯৭২ এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।”
অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহের স্থপতিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম যিনি খুব অল্প সময়ে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন যে সংবিধানের মূলনীতি ছিল ৪টি। আমি অনেক প-িত গবেষককে বলতে শুনেছি, ভারত ও রাশিয়ার চাপে বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি হিসেবে সংযোজিত করেছিলেন। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, শুধু তাই নয় ষড়যন্ত্রমূলকও। বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে আসছেন পঞ্চাশ দশক থেকে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কাগজপত্রে, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় এসব কথা বারবার এসেছে। তার শিষ্যরা এ-কথা ভুলেননি। প্রবাসী সরকারের নীতি-নির্ধারক হিসেবে এসব কথা তারা বলেছেন, যার খোঁজ আমরা রাখি না। দু-একটি উদাহরণ দিই-
৬ ডিসেম্বর নিউজউইক সৈয়দ নজরুলের একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। এটি ছিল বিদেশি কোনো সাংবাদিককে দেওয়া তার প্রথম একক সাক্ষাৎকার।

মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে
আমার ছেলেরা চমৎকার কাজ করেছে। এখন আমরা সুসংগঠিত ও কার্যক্ষম। মানুষের দেশাত্মবোধ গোয়েন্দাদের সাহায্য করছে; শিক্ষিত শ্রেণি আমাদের পক্ষে। জয়ী হতে সময় আর বেশি লাগবে না। অধিকৃত ও মুক্ত অঞ্চলে আপনি নিশ্চয় আমাদের প্রতি সমর্থন লক্ষ করেছেন।

বিদেশি প্রভাব সম্পর্কে
এটি সম্পূর্ণই আমাদের শো show)। ভারতের কোনো চাপ আমাদের মধ্যে নেই। কমিউনিস্টরা আমাদের সমর্থন করছে। ‘But they are not a big factor.’

যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম মৌল বিষয়গুলি তুলে ধরেছে। এ কাহিনী সবার জানা। যে কারণে আপনাদের কংগ্রেস আমাদের সমর্থন করছে। আমরা বুঝতে অক্ষম কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার আমাদের বিরোধিতা করছে।

যুদ্ধের সমাপ্তি প্রশ্নে
যদি ইয়াহিয়া অনুধাবন করতে পারে যে আমাদের মুক্তি আসন্ন, তাহলে রক্তপাত ছাড়া তাদের ফিরে যাওয়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে। প্রথমত; মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে, স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাহলেই যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে। যদি ইয়াহিয়া শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি সমাধান চায়, তাহলে মুজিবকে এখনই মুক্তি দিতে হবে। যদি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা না ছাড়তে চান তাহলে যুদ্ধ চলবে যতক্ষণ না তিনি বাধ্য হন।
১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ঘোষণা করে দেশ স্বাধীন হলে ‘কোলাবরেটর’দের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। সৈয়দ নজরুল ১১ তারিখ বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জামাতই ইসলাম, নিজামে ইসলাম ও পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
১৬ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন বাংলাদেশ হবে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। পত্রিকার ভাষায়- “It was committed to peaceful co-existence, non-alignment, opposition to all form of imperialism and colonialism, democracy and a secular and socialist way of life.”
পাকিস্তানকে চীনের সমর্থনের তিনি নিন্দা করেন। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা বলে ঘোষণা করেন, “If a single Bangladesh citizen was harmed or hurt become of his language or race, it would be a betrayal of the ideals of the founder of the nation and the flag of free Bangladesh.”
শুধু তাই নয় ১৮ ডিসেম্বর তিনি বলেন, চা ও পাট শিল্প জাতীয়করণ করা হবে। এবং এখন দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে যাতে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। [দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, ১৮.১২.১৯৭১]
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর চারজনকেই তার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৯৭৫-এর আগে কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পান। যতদিন তারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং পরবর্তীকালেও কেউ তাদের সততা ও আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। এখনও কেউ তোলেন না। বাঙালির দেশে এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা তার কথা আলাদা। কিন্তু এই চারজনকে মানুষ ভালোবেসে জাতীয় চারনেতা আখ্যা দিয়েছেন। অথচ, এদের একজনকে নিয়ে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান বলেছিলেন, ‘কোথাকার কোন নজরুল ইসলাম।’ সৎ ব্যক্তিদের নিয়ে এমন মন্তব্য আল্লাহ্ও সহ্য করেন না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে চার নেতার হত্যার বিষয়টি জড়িত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাদের মনে হয়েছে, এই চারনেতা যদি বেঁচে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে তারাই আওয়ামী লীগ ও জাতিকে পথ নির্দেশে দেবেন। এবং যে আদর্শ উৎখাতের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা তাহলে সে পরিকল্পনা বিনষ্ট হবে। সে-কারণেই, তাদের গ্রেফতার এবং পরবর্তীকালে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। জেলে ঢুকে জাতীয় নেতাদের হত্যার ঘটনা এই প্রথম। খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, তৎকালীন সামরিক অফিসাররা এ কাজ করে কি দুনিয়া ভোগ করে যেতে পেরেছিলেন? পারেননি। তাদের সমর্থকরাও পারবেন না। ব্যক্তি হত্যা করা যায়, আদর্শ নয়। সঠিক আদর্শ আবার মহীরুহ হয়ে ওঠে।

লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু চেয়ার ও ইতিহাসবিদ

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য