উত্তরণ প্রতিবেদন: ঐতিহাসিক জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উৎসবমুখর পরিবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের জমকালো ও বর্ণাঢ্য ‘ক্ষণগণনা’র উদ্বোধন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অন্ধকার সময় কাটিয়ে আমরা আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছি। মাঝখানে একটা কালো অধ্যায় আমাদের জীবন থেকে চলে গেছে। বাংলাদেশে মাঝখানে যে কালো অধ্যায় গেছে, সে কালো অধ্যায় যেন আর কোনোদিন ফিরে না আসে। সেই কালো অধ্যায় যেন আর কোনোদিন আমাদের দেশের মানুষের ওপর ছায়া ফেলতে না পারে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে বিজয়ের যে ‘আলোকবর্তিকা’ তুলে দিয়েছেন, তা নিয়েই আগামী দিনের পথচলার কথা জানিয়ে তারই কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, যে বিজয়ের আলোকবর্তিকা জাতির পিতা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, সে মশাল নিয়েই আমরা আগামী দিনে চলতে চাই। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কখনও মাথানত করে না, করবেও না। উন্নত জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে চলছে, এই হোক আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে ১৯৭২ সালের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সেই দিনের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেদিনটিতে আমরা হয়তো বিমানবন্দরে আসতে পারিনি, তখন আমার বাচ্চাটি ছোট ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে, ওই সময় আমার মা (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) সর্বক্ষণ একটি রেডিও নিয়ে বসেছিলেন, ধারাবাহিক বিবরণ শুনছিলেন, আমরা পাশে বসে সারাক্ষণ ধারাবিবরণী শুনছিলাম।’
দেশের জনগণের প্রতি বাবা বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মনে পড়ে, জাতির পিতা কিন্তু বাংলার মাটিতে নেমে আমাদের কথা ভাবেননি, পরিবারের কথা ভাবেননি। তিনি চলে গিয়েছিলেন রেসকোর্স ময়দানে তার প্রিয় জনগণের কাছে, তার প্রিয় মানুষগুলোর কাছেই তিনি সর্বপ্রথম পৌঁছে যান। তারপর আমরা তাকে পাই। কারণ তিনি এদেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। চেয়েছিলেন এদেশের মানুষ সুন্দর জীবন পাবে।’
এ-সময় প্রধানমন্ত্রী কবিগুরুর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনÑ “সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।” তারই উত্তর বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন এই ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।’ উত্তরে জাতির পিতা বলেছিলেনÑ ‘কবিগুরু দেখে যান আপনার সাত কোটি মানুষ আজ মানুষ হয়েছে, তারা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে।’
গত ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে রাজধানীর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার এই দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। জাঁকালো অনুষ্ঠানে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর ক্ষণগণনার ঘড়িও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ল্যাপটপের মাধ্যমে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে ক্ষণগণনার উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপিত ক্ষণগণনার ঘড়িও একসঙ্গে চালু হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি প্রতিবছরই উদযাপন করে কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি। কিন্তু এবারই প্রথম ব্যতিক্রমী উদযাপনে রাজধানীর তেজগাঁও জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাবর্তনের ঐতিহাসিক দৃশ্য প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা দেখে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মধ্যে একটি আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।
বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, দৌহিত্র প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়-সহ তাদের পরিবারের সদস্য, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, ২ হাজারেরও বেশি দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং ১০ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত দর্শকের উপস্থিতিতে ১০ জানুয়ারি বিকেলে স্মরণ করা হলো সেই মুহূর্তটিকে, যেদিন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনন্দ।
বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান পর্ব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম ও প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসে নির্ধারিত আসনে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ-সময় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন।
মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে পুরনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে একটি উড়োজাহাজ। পাকিস্তানের কারগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুই দিন পর লন্ডন হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের এ-রকম একটি উড়োজাহাজে (সদ্য কেনা সি-১৩০ জে) করেই সদ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের তেজগাঁওয়ের বিমানবন্দরে পৌঁছান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। বিমানটি ধীরে ধীরে এসে টারমাকে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে এসে থামে। এ-সময় বাজানো হয় দু-বাংলার কিংবদন্তিতুল্য কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠের সেই গানÑ ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়, ঘরে ঘরে এতো খুশি তাই…’।
বিমানটি টারমাকে পৌঁছানোর পর দরজা খোলা হলে ২১ বার তোপধ্বনি দেওয়া হয়। লাখো শহিদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা হাতে ১৫০ জন তখন সেখানে লাল গালিচার পাশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। তাদের ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে আর লেজার লাইটের মাধ্যমে বিমানের দরজার ফুটিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রূপক আলোকবর্তিকা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে লাল গালিচার মাথায় ছোট্ট মঞ্চে এসে থেমে যায়। এরপর গার্ড অব অনার দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল। এ-সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হলে সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে। উপস্থিত সবার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে প্রকম্পিত জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড।
বঙ্গবন্ধু যে আলোকবর্তিকা হয়ে সেদিন দেশে ফিরেছিলেন, তারই প্রতীকী উপস্থাপনা ছিল এ আয়োজন। এরপর ছোট বোন শেখ রেহানা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেওয়ার পর মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন ও ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন ল্যাপটপের বোতাম চেপে। দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি স্পটে, ৫৩ জেলায় ও দুটি উপজেলা মিলিয়ে অসংখ্য জায়গায় বসানো কাউন্টডাউন ক্লকও সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায়। এ-সময় জাতীয় পতাকার রঙের লাল-সবুজের বেলুন এবং ১০০টি শান্তির প্রতীক পায়রা উড়ানো হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। এই ক্ষণগণনা শেষে আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে সূচনা হবে মুজিববর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানের; বছরজুড়ে চলবে সেই আয়োজন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও রয়েছে নানা বর্ণাঢ্য আয়োজন।