Monday, October 2, 2023
বাড়িSliderআমনের শিষ এখন দুলছে

আমনের শিষ এখন দুলছে

অনাবৃষ্টির কারণে আমন আবাদে কিছুটা অসুবিধা হলেও চলমান মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন হয়েছে। চলতি বছর ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল।

রাজিয়া সুলতানা: মাঠে মাঠে সোনার বাংলার অববাহিকায় হেমন্তের আমন এখন বাতাসের সাথে শিষ দিয়ে দুলছে। মাঠের আধা কাঁচা-পাকা ধান এদিক-ওদিক ঢেউ খেলে যাচ্ছে নির্মল সমীরণে। এ যেন এক লাস্যময়ী নারীর মৃদুমন্দ বাতাসে নেচে নেচে খেলে যাওয়া আবহ। অচিরেই শেষ হচ্ছে অপেক্ষার পালা। কিছুদিনের মধ্যে সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে উঠবে। কৃষকের যেন আর তর সইছে না। প্রাণোদ্বীপ্ত মাঠের ধানের সাথে সাথে হাসছে বাংলার সাধক চাষাও। এই বুঝি সোনালি ধানে তাদের বাড়ির আঙিনা ভরে যাবে। কিন্তু হঠাৎ কি অলক্ষণে খবর কানে ভেসে এসেছিল কৃষকের। আসছে ‘সিত্রাং’ নামের কাল ঘূর্ণিঝড়। সিত্রাং; আসছে কৃষকের লালিত স্বপ্নকে ভেঙে দিতে।
ভয়ে জর্জর বাংলাদেশসহ ভারতের আশপাশের মানুষ। প্রবল শক্তিশালী প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং গত ২৩ ও ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। সিত্রাং-এর ঝড়ো বাতাস ও লাগাতার বৃষ্টিতে কৃষিতে হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে ফসলের ক্ষেত। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৩১ জেলায় প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার ক্ষতি কৃষিতে। এর মধ্যে আমন ফসলই রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমির। আর সম্পূর্ণ বাংলাদেশে আমনের ক্ষতি ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির। ফলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে। তদুপরি করোনা মহামারিতে বিশ্ব এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। এ দুঃসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ অনুভব করছিলেন। ঠিক সে-মুহূর্তে সিত্রাং-এর তাণ্ডব। কিন্তু দূরদর্শী সরকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে করোনার মতো মহামারিতেও কৃষি উৎপাদন ঠিক রেখেছিল। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এও দমে যাননি প্রধানমন্ত্রী। যথাসময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ফলে সিত্রাং-এ যে পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কা ছিল; মাঠ পর্যায়ে ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। বরং সিত্রাং-এ আমন ধানের ক্ষেত রাঙিয়ে দিয়েছে প্রাকৃতিক আশীর্বাদে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টির কারণে তুলনামূলকভাবে আমনের ফলন আরও ভালো হবে। কারণ ফসল উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন দরকার হয়, যা সাধারণ পানিতে (H2O) অক্সিজেন থাকে o2 হিসেবে। আর বৃষ্টির পানিতে অক্সিজেন থাকে o3 হিসেবে, যা ফসল উৎপাদনের জন্য খুবই দরকার। সুতরাং এবার আমনে বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর পূর্বাভাস পাওয়ার সাথে সাথে দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষি মন্ত্রণালয় জরুরি সভা ডাকল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হলো। তাদের সার্বক্ষণিক কর্মস্থলে থাকার নির্দেশ দিল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিভাগের সব কার্যালয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হলো। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক মাঠে অবস্থান করতে বলা হলো। যে কোনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হলো। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের প্রতিবেদন জরুরিভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হলো। আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী প্রস্তুতিমূলক পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল। শস্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ তথা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে আমনের কোনো বিকল্প নেই। তাই যেসব এলাকায় আমন ধান ৮০ শতাংশ পেকেছে, সেসব এলাকায় আগাম ধান কাটার নির্দেশ দেওয়া হলো। উপকূলীয় এলাকায় ফসলের ক্ষেতে পানি প্রবেশের সাথে সাথে পানি নিষ্কাশনের পরামর্শ দেওয়া হলো। আমাদের চালিকাশক্তি কৃষিকে বাঁচাতে কৃষিবান্ধব সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে- জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক সমন্বয়ের ব্যবস্থা করল। লবণাক্ত পানি যাতে শস্যক্ষেতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য  স্লইসগেট অপারেশনের ব্যবস্থা করল। এরপরও যদি জোয়ারের পানির উচ্চতা বেশি হয়, তাহলে লবণাক্ত পানি জমিতে প্রবেশ করবেই। সেক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ পানি নিষ্কাশনের জন্য কৃষি বিভাগকে নিয়মিতভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার নির্দেশ দিল। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের ফলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং জনগণের খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি।
এমনিতে আগে থেকে আমন নিয়ে সংশয় ছিল। আমন চাষের ভরা মৌসুমে ছিল পানির সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের দাম ছিল বেশি। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ সেচ দিতে পারেনি আমন চাষিরা। তাছাড়া সবকিছুর দাম বাড়ার সাথে সাথে ধানের চারা, সার, শ্রমিকের দামও ছিল বেশি। ফলে কৃষকরা ধানের উৎপাদন খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, আমন নিয়ে কোনো সংশয়ের কারণ নেই। তবে কৃষি খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আশার বাণী শুনিয়েছেন আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা। সিত্রাং-এর প্রভাবে কিছু জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুবই কম। কারণ উপকূলীয় এলাকায় এবার দেরিতে ধান রোপন করা হয়েছে। ফলে গাছগুলো এখনও ছোট। তবে বড় ও ফুল আসা গাছগুলো হেলে পড়েছে। সেগুলো এক সাথে খুঁটির সাথে বেঁধে দিলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। সার্বিক উৎপাদনে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। অন্যদিকে আমনের লক্ষ্যমাত্রা এবং উৎপাদন প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী কৃষিবিদ আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেন, আমন আমাদের একটা বড় ফসল। শ্রাবণ মাসে মাত্র একদিন বৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা খুবই উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। কারণ পানির অভাবে ধান লাগানো যাচ্ছিল না। তারপর একদম শেষের দিকে কৃষকরা সেচসহ নানাভাবে ধান লাগানো শেষ করেছে। অবশেষে বৃষ্টিও হয়েছে এবং সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড়ের বৃষ্টিসহ সব মিলিয়ে আমনের অবস্থা বেশ ভালো। তবে আশার কথা হলো, কম বৃষ্টি হওয়ার কারণে বিলের তলায়ও এবার মানুষ আমন ধান লাগাতে পেরেছে। এতে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এলাকা বেশি হয়েছে। ধানের এ মুহূর্তে অবস্থাও ভালো। যা বৃষ্টি হয়েছে পর্যাপ্ত। আশা করা যায়, দেরি হওয়ায় কিছুটা উৎপাদন কম হবে। তাতে করেও মোটামুটি আমাদের টার্গেট অর্জন হবে। তাছাড়া তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমনের উৎপাদন খুব একটা কম হবে না। কারণ যেসব ধান একটু পরিপক্ব হয়েছিল, সেগুলো কিছুটা নুয়ে গেছে। আর দক্ষিণাঞ্চলের ধান দিনাজপুর থেকে এক মাস পরে লাগায় বা নওগাঁর চেয়ে এক মাস পরে লাগায়। কাজেই আমার মনে হয় না আমন খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অনাবৃষ্টির কারণে আমন আবাদে কিছুটা অসুবিধা হলেও চলমান মৌসুমে আবাদের লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন হয়েছে। চলতি বছর ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। আর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ কোটি ৬৩ লাখ টন চাল। কৃষি মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমন আবাদ হয়েছিল ৫৬ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ১ কোটি ৪৫ লাখ টন। গত বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে আবাদ হয়েছিল ৫৭ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে; আর উৎপাদন ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল। সে হিসাবে এবার গত দু-বছরের চেয়ে বেশি উৎপাদন হতে যাচ্ছে আমন ধান।

লেখক : শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক
প্ল্যান্ট প্যাথলজি, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য