‘মিট এগেইন’, একটি সাড়া জাগানো গান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে, নতুন এক পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে ইংল্যান্ডের মানুষের মধ্যে এই গানটি ছিল প্রেরণাদায়ক গণসংগীত। সম্প্রতি প্রাণঘাতী করোনার বিপর্যয়ের মুখে এই গানটির কথা উল্লেখ করেন ইংল্যান্ডের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেনÑ মহামারির পর, আমরা কী সবাই মিলে বৈষম্যমুক্ত একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি?
করোনা সংকট মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। মানুষ যেমন এই ভাইরাসের কাছে অসহায় মৃত্যুর শিকার হয়েছে, তেমনি এই পরিণতি যে অনিবার্য ছিল না, সে প্রশ্নটিও তীব্রভাবে সামনে এনেছে। দৃশ্যত মনে হয় কোভিড-১৯ মানব সৃষ্ট নয়। এটা যেন প্রকৃতির রুদ্ররোষ। যার মোকাবিলার ন্যূনতম প্রস্তুতি পৃথিবীর ধনী-গরিব কোনো দেশেরই ছিল না। কিন্তু আমরা সত্যের অন্য পীঠটা দেখতে চাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল মানব সৃষ্ট। তারপরও যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই কোনো কোনো দেশ তার দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য নানা উদ্ভাবনী চেষ্টা করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চরম খাদ্যাভাবের সময়ও ইংল্যান্ডে অপুষ্টিজনিত সমস্যা কমে যায়। ব্রিটিশ সরকার অপ্রতুল খাদ্য যাতে সবাই মিলে ভাগ করে খেতে পারে, সে-জন্য রেশনিং ও সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে খাদ্য বণ্টনে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে যারা অপুষ্টিতে ছিল তারাও অনেক বেশি ভালো খাদ্য পেতে শুরু করে। একই ঘটনা ঘটে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে। এর ফল ছিল চমকপ্রদ। চল্লিশের দশকে যুদ্ধকালে ইংল্যান্ডে ও ওয়েলসে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ছেলেদের ক্ষেত্রে সাড়ে ছয় বছর ও মেয়েদের ক্ষেত্রে সাত বছর বাড়ে, যা আগের দশকের চেয়ে বেশি। আর অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য যুদ্ধকালে ও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে চালু হয় ব্রিটেনে প্রথম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ও ম্যানচেস্টারে চালু হয় পার্ক হাসপাতাল। ব্রিটেন যতদিন কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু রেখেছিল, ততদিন পর্যন্ত ব্রিটেনের হত-দরিদ্র থেকে শুরু করে সকল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ছিল। যদিও ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনামলে, ১৯৪৫ সালে পরাধীন বাংলায় ১৯৪৫ সালে ৩০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল।
করোনা সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের মতো দরিদ্র দেশ তো বটেই, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর স্বাস্থ্য খাত কতটা উপেক্ষিত এবং একই সাথে বৈষম্যমূলক। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মৃত্যুহার বেশি। শিকাগোতে মহামারিতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান, অথচ তারা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী দেশে দেশে স্বাস্থ্য খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ, মুনাফাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণায় প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না করা এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ধনী-গরিবের বিশাল বৈষম্য আজকের করোনা সংকট মোকাবিলায় ধনী-গরিব সব দেশকেই অসহায় করে তুলেছে। করোনা সংকট দেখিয়ে দিয়েছে, কেবল অসহায় মৃত্যুই না, প্রতিটি দেশের এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিকে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শ্রমশক্তি উৎপাদনশীল কাজে না লাগাতে পারলে এবং বাঁচার তাগিদে লকডাউন করে গৃহবন্দি থাকলে, একদিকে যেমন ক্ষুধার উপশম হয় না, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই সংকটে হত-দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হবে, তাদের মৃত্যুর মিছিল অপ্রতিরোধ্য হবে। কিন্তু সম্পদশালীরাও উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবসা-বাণিজ্য, চলাচল, আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলে পথে বসবে। জমানো টাকা চিবিয়ে খেয়ে তারা বাঁচবে না।
করোনার অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে, ভাইরাসটি মানবসৃষ্ট না হলেও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানুষের অসহায়ত্ত, তাদেরই সৃষ্টি। অতএব ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি আর না হয়, সমগ্র মানব জাতিকে সম্মিলিতভাবে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। ধনী-গরিব সকল মানুষের জন্য একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়া, সকল মানুষের খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ এবং করোনা সংকটের মতো যে কোনো সংকটের পুনরাবৃত্তি রোধে মহামারির পর বিশ্ব-ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রতিটি দেশে যেমন ধন-বৈষম্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে সম্পদের সুষম বণ্টন, তেমনি আন্তঃরাষ্ট্র বৈষম্যও কমাতে হবে। আমাদের একটাই পৃথিবী, অভিন্ন মানব জাতিকে রক্ষার জন্য অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। প্রকৃতিকে জয় করতে হবে, কিন্তু প্রকৃতির ভারসাম্যও রক্ষা করতে হবে। মানব জাতি ও প্রাণীকূলের জন্য হুমকি মোকাবিলায় সম্ভাব্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে নতুন এক পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেমন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রভৃতি গড়ে তোলা হয়েছিল, এবারও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কার্যকর আন্তর্জাতিক ও দৈশিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমরা সমবেতভাবে গাইতে পারব, মিট এগেইন ইন এ নিউ ওয়ার্ল্ড।