ড. জেবউননেছা: বিশ্বজুড়ে বিপর্যস্ত কোটি কোটি শিক্ষার্থীর সাথে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনেও করোনা আঘাত হেনেছিল মারাত্মকভাবে। যাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে গেছে করোনাভাইরাসের আগ্রাসী উপস্থিতিতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দক্ষ হাতে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ করেছিল। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যেন ব্যাহত না হয় সে-জন্য অনলাইনভিত্তিক পাঠদান এবং সংসদ টেলিভিশনের উদ্যোগে শিক্ষা কার্যক্রমসহ অ্যাসাইনমেন্ট গ্রহণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। বারবার বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কিন্তু করোনা সংক্রমণের হার উচ্চমুখী হওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও অনলাইনে পাঠদান চালু ছিল। এতসব উদ্যোগ গ্রহণের পরও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বক্তব্যে বলেন, ‘জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, সাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। ডিজিটাল সরঞ্জাম ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষিতদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ-জন্য তিনি জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।’ অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপনের দিন তিনি বলেন, ‘আমাদের অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে আমরা প্রায় দেড় বছর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে পারিনি। যদিও অনলাইনে বা টেলিভিশনের মাধ্যমে বা ঘরে বসে শিক্ষা কার্যক্রম চলেছে।’ এ দুটি বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা খাত নিয়ে কতটা সংবেদনশীল।
তবে এই অতিমারিতে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থীদের বাল্যবিবাহ এবং ঝরে পড়ার সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। কিছু কিছু শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। অভিভাবকবৃন্দ নিয়মিত শিক্ষার্থীদের বেতন পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে। যে কারণে শিক্ষকবৃন্দ মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। একটানা শিশুরা বাড়িতে অবস্থানের ফলে তাদের আচরণে ভারসাম্যহীনতা, শারীরিক স্থূলতা, মুঠোফোনে আসক্তি বেড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট ক্রয়ের অসামর্থ্যতা এক ধরনের ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তথাপি শহরের শিক্ষার্থীরা অনলাইনভিত্তিক শিক্ষায় এগিয়ে গেলেও অনেক সময় শুনতে পেয়েছি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্টগুলো গুগল বা ইউটিউব থেকে সংগ্রহ করেছে। প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের বিয়ে হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ মা হয়েছে। ছেলে শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে যুক্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল। যে বিচ্ছিন্নতা থেকে তৈরি হতে পারত সামাজিক সংকট। এই সংকট প্রকট আকার ধারণের পূর্বে গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার যুগোপযোগী সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে অভিভাবক এবং শিক্ষকবৃন্দ উভয়েরই সচেতন হতে হবে। সরকার থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাবৃন্দের বিদ্যালয় পরিদর্শন করা প্রশংসার দাবি রাখে। এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানা না হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজস্ব পোশাক নিয়ে এখনই কড়াকড়ি না করতে শিক্ষকদের নির্দেশ দেন।’ তাছাড়া সকল শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদানের পরিকল্পনা ও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় অনলাইনে পাঠদান স্থগিত আছে। এই প্রক্রিয়ায় পাঠদানের ফলে ভবিষ্যতে শহর এবং গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক এবং মেধাভিত্তিক বৈষম্য জেগে ওঠার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। শিক্ষার্থীদের অনলাইনভিত্তিক শিক্ষায় দারুণভাবে এগিয়ে গেলেও শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ এবং সবুজ মাঠের বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি ছিল। জাতিসংঘভিত্তিক সংগঠন ইউনেস্কোর মতামত ছিল বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার বিষয়ে। অন্যদিকে, ইউনিসেফ শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার বিষয়ে মতামত প্রদান করেছে। তাদের সুপারিশকৃত পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম সুপারিশ হচ্ছে, প্রতিটি বেঞ্চের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি করা, শিক্ষকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার পর জমায়েত না করা, বিদ্যালয়ের দিনগুলো আলাদা করা, শ্রেণিকক্ষের প্রবেশপথ বন্ধ করা, প্রবেশপথের চারপাশে এক মিটার দূরত্ব বৃদ্ধি করা। তবে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে শিক্ষক এবং অভিভাবকবৃন্দের সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। শিশুদের মুঠোফোন আসক্তি থেকে মুক্ত করার জন্য অভিভাবকদের সময় দিতে হবে।
সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, বাংলাদেশে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বিস্তৃতির পাশাপাশি খুব শিগগিরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, ‘ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালুর প্রক্রিয়া চলমান। আমাদের অর্থনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা অনলাইনে পাঠদানের সাথে ততটা অনুকূলে না থাকলেও এই সামান্য সংকট খুব দ্রুত নিরসন হবে বলে আশা করছি। তাছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগ ঘটাতেও সমস্যা হতো। তাই শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকবৃন্দের সাথে মানসিক যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়া জরুরি ছিল।’ দীর্ঘসময় অনলাইনে পাঠদানের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুঠোফোন সাথে নিয়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যদিও বিদ্যালয়গুলো কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তবুও এক্ষেত্রে মুঠোফোনে বিভিন্ন গেমস বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীরা ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে গেমস খেলার সুযোগ গ্রহণ করছে। এ বিষয়টি আরও ঘনীভূত হতো, যদি আর কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকত। প্রাথমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সকল শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মেডিকেল কলেজগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকার শিক্ষার্থীদের টিকা সুরক্ষা নিশ্চিতের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দিলে তরুণদের মধ্যে যে হতাশা এবং মানসিক সংকট তৈরি হয়েছে এ বিষয়টির উত্তরণ হবে, যার সিদ্ধান্ত ও ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বিষয়টি ভীষণভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে গেলে। তাছাড়া ক্যাম্পাসগুলোতে যে জীববৈচিত্র্য রয়েছে তাও ফিরে আসবে। কারণ শিক্ষার্থীদের খাদ্যের উচ্ছিষ্ট খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস করা কুকুর, বিড়াল এবং অন্যান্য প্রাণী। সুতরাং একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জীবন নয়; বরং আরও অনেক জীবন যুক্ত থাকে। প্রত্যাশা এই যে বিশ^বিদ্যালয়গুলোও শিগগির বিদ্যালয় এবং কলেজের মতো প্রাণ ফিরে পাবে।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষা হবে গণমুখী শিক্ষা’Ñ এ বক্তব্যটি নিয়ে ভাবনার মোক্ষম সময় এটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে সে-সময় বর্তমানের মতো থাকবে না। তাছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস আমাদের সতর্ক করে দিল। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষ হাতে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। তিনি অনলাইনে মন্ত্রিপরিষদ সভা করেছেন। দেশের সকল জেলার খবর অনলাইনের মাধ্যমে নিয়েছেন, যা বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও করোনার সময়ে যখন সবকিছু স্থবির ছিল, তখন শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কীভাবে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যায় সে-বিষয়ে কাজ করে প্রণীত হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা। এই রূপরেখাতে রয়েছে শিক্ষার মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার উপায়। কেননা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেভাবে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মানবিক-বিজ্ঞান-বাণিজ্যের বিভাজন তুলে দেওয়া একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে যেমন প্রত্যাশা করছি, সেই প্রত্যানুযায়ী পদক্ষেপ, আস্থা এবং বস্তুনিষ্ঠতার সাথে গ্রহণ ও সংস্কার করা জরুরি। প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রমে প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, গ্রুপওয়ার্ক, কুইজ, খেলাধুলা, পোস্টার প্রদশর্নীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যায়নের বিষয়টি ভালো লেগেছে। শিক্ষার্থীদের চারপাশ থেকে শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা হবে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রমে প্রস্তাব করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সেটি হলোÑ পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা তুলে নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রমে। প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম সম্পর্কে একদল শিক্ষাবিদ তাদের সুপরামর্শ প্রদান করেছেন। তাদের সুচিন্তিত মতামত এবং আরও শিক্ষক এবং গবেষকবৃন্দের মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করে শিক্ষা সংস্কারের পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হবে বলে ধারণা করা যায়। তবে এই শিক্ষা সংস্কারে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী ও তরুণদের আকৃষ্ট করে তাদের ধরে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কেননা প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য মেধাবী শিক্ষক। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটিগুলোকে কমিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি পাঠদানে তড়িৎভাবে পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। করোনাকালীন অনলাইন ক্লাসে কিছুসংখ্যক প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক এবং ডিভাইসের সমস্যায় সম্মুখীন হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানে রয়েছে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ বিষয়টি। ২০১০ সালে বাংলাদেশ পেয়েছে একটি শিক্ষানীতি। যদিও এর বাস্তবায়ন ধীর। শিক্ষার বিষয়টি সংযুক্ত হয়েছে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি ) এবং ভিশন-২০২১-এ। ২০৩০ সালের মধ্যে নারী ও পুরুষের জন্য সুলভে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, উচ্চ শিক্ষার বিষয়টিও অনেকটা পিছিয়ে আছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষার ওপর জোর দিলেও বাস্তবায়ন তেমন দেখা যায়নি। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ জনবলের জন্য ঘাটতি পূরণে ৪.৫ লাখ নাগরিককে নিযুক্ত করে প্রতি বছর দেশ থেকে ব্যয় হচ্ছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অন্ততঃপক্ষে ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী চাকরির জন্য তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। দক্ষ ব্যক্তির অভাবে দেশের পোশাক খাতের ১৩ শতাংশ কারখানায় বিদেশিরা কাজ করছে। বাংলাদেশে মাত্র ৭টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অথচ এই শিক্ষা বিশেষভাবে প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত কৃষি শিক্ষাকে গুরুত্ব প্রদান করা সময়ের দাবি।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এখন এগিয়ে যেতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায়। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রধান ক্লাউডস শোয়াইব এই বিপ্লবের কথা বলেন। কারিগরি শিক্ষা প্রশিক্ষণে অটোমেশন, রোবোটিকস ও ডেমোগ্রাফিক ডিফেন্ডেড এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে উচ্চ কারিগরি শিক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সমন্বিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এই শিল্পের বিকাশের কাজে হাত দেওয়া প্রয়োজন। না হলে প্রচলিত নিয়মে ২০৩০ সাল নাগাদ গ্রাজুয়েট তৈরি হলে সমাজে আর এদের চাহিদা থাকবে না। যদিও সরকার চতুর্থ বিপ্লবের বিষয়ে কাজ শুরু করেছে।
এতদসত্ত্বেও শিক্ষার মানসম্পন্ন উন্নয়নে প্রধান সমস্যা ‘শিখন সংকট’। যেটি বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়শীল দেশের সমস্যা। কারণ এ সমস্যাটির সাথে অর্থনৈতিক বিষয়টি জড়িত। শহরের অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তানের চেয়ে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা শিখে কম। তবে ঢালাওভাবে বলা যাবে না। কারণ অতীতে যারা দেশের হাল ধরেছেন, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ গ্রাম থেকে এসেছিলেন। অন্যদিকে, পরীক্ষার প্রশ্ন মাথা রেখে বিদ্যালয়ে লেখাপড়া এগিয়ে যায়। তাছাড়া, ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার তো আছেই। শিক্ষকের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষকের প্রশিক্ষণে মাত্র ৫০ শতাংশ। প্রশিক্ষণের মান সন্তোষজনক নয়। শিক্ষকের মান, যোগ্যতা এবং দক্ষতা এবং দায়িত্ব নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ইউনেস্কোর আর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাধ্যমিকে ৬৬ শতাংশ শিক্ষকই অপ্রশিক্ষিত। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে ৪৩ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারছেন না। অন্যদিকে, উন্নত দেশে বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীবৃন্দের কোনো পরীক্ষার চাপ নেই। এ সময়টাতে তারা জীবনমুখী শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। শিক্ষকবৃন্দও যথেষ্ট দক্ষ থাকেন। উন্নত বিশ্বে শিক্ষকতা একটি লোভনীয় পেশা।
কুদরাত-এ-খুদা জাতীয় শিক্ষা কমিশনের একটি রিপোর্টে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশের কথা, সেখানে শুরুতেই বলা হয়েছিল, আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার বর্তমান পদ্ধতি নানা দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ, শুধু বিভিন্ন বিষয়ের সংখ্যা সমতার দিকে দিয়ে নয়; বরং মান ও গুণগত উৎকর্ষের দিক থেকে বর্তমান উচ্চ শিক্ষা-ব্যবস্থা জাতির জন্য এক ভীষণ উদ্বেগের কারণ (অনুচ্ছেদ ১৩.১১, পৃষ্ঠা-৮৪)। বর্তমান সরকার উচ্চ শিক্ষা মানোন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন স্ট্রাটিজিক প্ল্যান ফর হায়ার অ্যাডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০১৭-২০২১ প্রতিবেদনে একটি সুপারিশ প্রদান করেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য একটি ‘আমব্রেলা লেজিসলেশন প্রণয়ন ও প্রবর্তন করা’ (অনুচ্ছেদ, সি-১, পৃ-৬২)। বিশ্বের ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাংকিংয়ের স্থান দখলের জন্য দূরদৃষ্টি এবং কর্মপরিকল্পনা, প্রশাসন, শিক্ষা ও গবেষণা, গুণগত মান, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ এই ৬টি সূচকে মন দিতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে অনুযায়ী (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে সচেষ্ট হইবেন। (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা করিবেন।’ এই অনুচ্ছেদের আলোকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সমান সুযোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে এখন এগিয়ে যেতে হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায়। ২০১৬ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রধান ক্লাউড শোয়াইব এই বিপ্লবের কথা বলেন। নইলে প্রচলিত নিয়মে গ্রাজুয়েট তৈরি হলে ২০৩০ সালে সমাজে আর এদের চাহিদা থাকবে না। যদিও সরকার চতুর্থ বিপ্লবের বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রম রূপরেখাকে যৌক্তিক মনে হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মিলবে মুক্তি, শিক্ষার্থীবৃন্দ পাবে স্বস্তি।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হবে। এই পরিকল্পনায় শিক্ষাকে প্রাধান্য প্রয়োজন। আমাদের কারিগরি, বৃত্তিমূলক, প্রযুক্তিগত শিক্ষা প্রদানের প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন। তবে বর্তমান সরকার বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলকভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তারাই ধারাবাহিকতায়, ২০২২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে এবং ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে একটি কারিগরি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হচ্ছে।
সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মাধ্যমিক থেকে উন্নত কারিকুলাম। দক্ষ ব্যক্তির জন্য সিঙ্গাপুরের নানিয়াং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আদলে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে ও দক্ষতার স্তর যাচাই করে নিয়োগ দেওয়া দরকার। সরকারকে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ডিজিটাল এবং সফট স্কিলসকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। দেশে দুই-তৃতীয়াংশ তরুণকে কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তির খাতে কাজে লাগানোর সময় এখনই। কর্মক্ষেত্র বাড়াতে বিনিয়োগ বাড়ানো, দক্ষতা এবং জ্ঞানচর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা। ৮টি বিভাগে ৮টি টেকনিক্যাল স্কিল ইকোসিস্টেম গড়ে তোলা যেতে পারে। দেশে প্রতি বছর ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসছে। কিন্তু কারিগরি খাতে কতটা লোকবল প্রয়োজন তা নির্ণীত করা যায়নি।
শিক্ষাঙ্গন খুলে দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের অনুপুস্থিতিকে দ্রুত কমিয়ে আনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। স্কুলগুলোতে মিড ডে মিলের কর্মসূচি গ্রহণ, করোনার এই সময়ে শিক্ষার্থীরা প্রচ- পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের দুধ, ডিম এবং পুষ্টিকর খাবার যদি বিদ্যালয়ে বিতরণ করা যায়, তাহলে স্কুলে উপস্থিতি বাড়বে। বিদ্যালয় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে পাঠ্য বহির্ভূত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাণ চঞ্চলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিজ্ঞান সপ্তাহ, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, ক্রীড়া সপ্তাহ আয়োজন করা যেতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আকৃষ্ট করতে শিক্ষকবৃন্দও সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। যেমন : একটি উদ্যোগ খুব চোখে পড়েছে। স্কুলের পথে পানি থাকায় গাজীপুরের কালিয়াকৈরের উপজেলার ভাউমান টালাবহ মডেল হাইস্কুলের অভিভাবক এবং শিক্ষকবৃন্দ মিলে ২৪ হাজার টাকা ব্যয় করে ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছেন। এই বিদ্যালয়ে প্রথম দিনই শতভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। এ বিদ্যালয়টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু রেখেছে। এ উদ্যোগটি প্রশংসার দাবি রাখে। এ-রকম উদ্যোগ নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করবে বিদ্যালয়ে ফিরে আসতে।
তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বপ্ন দেখি, করোনামুক্ত বিশ্বে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একটি আইডি পাসওয়ার্ড থাকবে। যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার নম্বর এবং পুরো কোর্সের পরিকল্পনা এবং লেকচার প্রেজেন্টেশন বছর শুরুতেই পেয়ে যাবে। সময়মতো ফলাফল প্রকাশ হবে। মেধাবীরা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে। ‘সেশনজট’ নামক শব্দটি অভিধান থেকে মুছে যাবে। শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাবে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে। দেশের সব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ থেকে শুরু করে সমস্ত বিষয়াদি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে। মেধাবী তরুণরা দেশের বাইরে পাড়ি জমাবে না। দেশের ভিতরেই তাদের শানিত মেধা দিয়ে দেশকে আলোকিত করবে। প্রাথমিক শিক্ষা-ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মেধাবীদের প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সম্মানীর বিষয়টা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি সকল পর্যায়ের শিক্ষকতায় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। উন্নত বিশ্বে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন এবং সম্মান প্রদান করা হয়। বাংলাদেশেও এটা করতে পারলে করোনামুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন হবে আরও মানসম্পন্ন এবং গতিশীল। শেষ করব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি ৯ অক্টোবর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল)-এ বলেছিলেন, ‘শৃঙ্খলা ফিরে না আসলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। সততা ফিরে না আসলে কোন জাতি বড় হতে পারে না।’
লেখক : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়