Monday, December 4, 2023
বাড়িSliderআত্মঘাতী বাঙালি ও একুশের আত্মদান

আত্মঘাতী বাঙালি ও একুশের আত্মদান

সম্পাদকের কথা

হীনম্মন্যতাবোধ বাঙালির প্রাচীন ব্যাধি। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ সেই বৈদিক যুগে বর্ণবাদী আর্যদের মতে, ‘পাখির ভাষায়’ কথা বলত। এটা ছিল একটি জাতিসত্তার উন্মেষকালের প্রপঞ্চ। প্রাচীন ভারতীয় মিশ্র সংস্কৃতির উপজাত বাঙালির স্বকৃত সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবনাচরণ স্বতন্ত্র ধারায় বিকশিত হচ্ছে। মহাভারতের কাল থেকে অন্তত দু-তিন হাজার বছর কেটেছে এই প্রক্রিয়া। সাধারণ ঐক্যমত এই যে, চর্যাপদের যুগে এসে বিশেষত বাংলা ভাষা একটা নির্দিষ্ট আদলে জনভাষা থেকে মূর্ত নির্দিষ্ট বর্ণমালা, শব্দসম্ভার এবং অলঙ্কারাদি নিয়ে পরিশীলিত হয়ে উঠেছে। এ-কারণে বলা হয়, বাংলা ভাষার বয়স হাজার বছর।
মধ্যযুগে এসে বাংলা ভাষা তার স্বকীয় ঐশ্বর্য নিয়ে এক বিশাল জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের প্রধান অবলম্বন এবং সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে।
মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষার আরও উন্নতি হয়েছে। আরবি-ফার্সি ভাষার মিশ্রণে বাংলা ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আধুনিক রূপলাভ করে। ইংরেজি শিক্ষার সুবাদে বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার বিকাশের গতি ত্বরান্বিত হয়। রবীন্দ্রনাথ নোবেল বিজয়, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় উন্নীত করে।
কিন্তু এতসব উন্নতি-সমৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলা ভাষা কোনোদিন ‘রাজভাষা’ ছিল না। রাজভাষা ছিল আর্যভাষা, ফারসি ভাষা ও ইংরেজি ভাষা। বাঙালির আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-হীনম্মন্যতা কাটেনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায় করা হলেও, তা ছিল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। স্বাধীনতার পর আমাদের সংবিধানে হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বাংলা ‘রাষ্ট্রভাষা’র মর্যাদা লাভ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেন। আমরা আশা করেছিলাম, গত ৫০ বছরে দেশের রাষ্ট্র-জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা তার আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তা হয়নি। ইংরেজি ভাষার দোর্দ-প্রতাপ রাষ্ট্র থেকে জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যুগে সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব বেড়ে গিয়েছিল। দোকানপাট, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ছেলে-মেয়েদের নাম বাংলায় রাখা হতো তখন। আর এখন বাংলা ভাষা যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে তখনও, বাংলা ভাষা বাঙালির জীবনে যথার্থ মর্যাদা পায়নি। সরকারি অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু থাকলেও, তা এখনও সর্বব্যাপী হয়নি।
আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ৩টি ভাষার যথেচ্ছাচার চলছে। বাংলা ছাড়াও, ইংরেজি ও আরবির প্রতাপ চলছে। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন বাড়ছে, তেমনি বিশেষত দরিদ্র মানুষকে ধর্মের নামে অশিক্ষিত ও অনুৎপাদনশীল রাখতে মাদ্রাসা শিক্ষার লাগামহীন বিস্তার চলছে। আমরা ধর্ম শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার বিরোধী নই। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলায় কি ধর্ম শিক্ষা সম্ভব নয়? আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কি বাংলা ভাষায় সম্ভব নয়?
সবার না হলেও বাঙালি জনগোষ্ঠীর একাংশের এক ধরনের মানসিক বৈকল্য চলছে। ইংরেজি হয়ে উঠেছে আভিজাত্য বা কৌলিন্যের প্রতীক। বিভাষী বা বিদেশির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারেও বিয়ের দাওয়াত কার্ড লেখা হচ্ছে ‘রাজভাষা’ ইংরেজিতে। মুসলমানত্ব জাহির করার জন্য অপ্রচলিত আরবি ফারসি ভাষায় ছেলেমেয়ের নাম রাখা হচ্ছে। পোশাক-পরিচ্ছদেও অপ্রচলিত ধারা চালু হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইনবোর্ড অহেতুক ইংরেজিতে রাখা হচ্ছে। বাঙালির এই হীনম্মন্যতা ব্যাধি, আখেরে বাংলা ভাষার বিকাশ ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে।
খোদ বাংলাদেশে যখন এই অবস্থা তখন ভারতের বাংলাভাষী মানুষগুলোও আজ অস্তিত্বের সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গÑ বাংলাভাষী রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও সেখানে হিন্দি ও ইংরেজির আগ্রাসন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ভারত বহুভাষিক দেশ হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু হিন্দির? পশ্চিমবঙ্গের টেলিভিশন সিরিয়ালগুলো থেকে বাংলা গান যেন নির্বাসিত হয়েছে।
কোনো বিদেশি বিভাষীরা নয়, আমরা বাঙালিরাই বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করছি। রাষ্ট্রভাষা করতে পেরেছি; কিন্তু ‘রাজভাষা’ করতে পারিনি। বাংলা ভাষার মর্যাদাকে অবনমন করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, জাপান, চীন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ ও জাতি যদি নিজ নিজ মাতৃভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে যেতে পারে, আমরা বাঙালিরা তা পারব না কেন? এবারের মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে আমাদের নতুন করে প্রতিজ্ঞা নিতে হবে, সকল হীনম্মন্যতা, আবিলতা ঝেড়ে ফেলে আমাদের ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে, আমাদের দেশপ্রেম, মাতৃভাষা প্রেম ও জাতীয়তাবোধকে আরও শানিত করতে হবে। শহিদের আত্মদান বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য