Sunday, September 24, 2023

আঘাত­.

মালেকা পারভীন: কিছু কিছু মানুষের সাথে দেখা হবার পর আমি ভাবতে থাকি, এদের সাথে আমার কেন দেখা হয়। এদের সাথে কি কেবল আমারই দেখা হয় ভাবতে ভাবতে আমি কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যাই। এদের সাথে আমার দেখা না হলেই বা কী এমন হতো- এমন ভাবনাও আমাকে অনেকটা সময় ধরে কাবু করে রাখে। তারপর আমার যা স্বভাব, আরও নতুন ভাবনার হাওয়া এসে আমাকে অন্য কোনো চিন্তাভূমিতে নিয়ে আছড়ে ফেলে। আমি নতুন ভাবনার চোরা স্রোতে ভেসে যাই।
তো, যে মানুষগুলোর কথা বলছিলাম, তারা এমন এক বিশেষ প্রজাতির, যে কোনো অঘটন, অন্যায় বা অনাকাক্সিক্ষত কিছু, ঘটলেই বলে ওঠে দেশটা একেবারে রসাতলে গেল। এদেশের আর কিছু হবে না। দেশটার ভবিষ্যৎ বলে আর কিছু থাকল না। যেন দুনিয়ার সমস্ত অঘটন বা দুর্ঘটনা এদেশেই ঘটে। বাকি পৃথিবীতে স্বর্গের সুখ আর নিরবচ্ছিন্ন শান্তি।
এই যেমন সেদিন একজন নাক কুঁচকে বলে উঠল, বাংলাদেশের সমাজ এখনও নারীর অধিকার বা আরও বিশদভাবে জেন্ডার ইস্যু বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। এজন্য আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। এ-সমস্ত হাবিজাবি পরামর্শ আর কী। ফেনীর নুসরাত ঘটনার পর দেশব্যাপী সবাই যখন ফুঁসছে, তখন সেই বিজ্ঞ ব্যক্তি নিরাপদ আইভরি টাওয়ার থেকে বেমক্কা এই মন্তব্য করে বসল। যথারীতি তথ্যপ্রযুক্তির জঞ্জাল ফেসবুকের খোলা মাঠে যেখানে সবারই কিছু-না-কিছু বলার থাকে।
অযাচিতভাবে কথাটা সে বলে ফেলল কারও কোনো নির্দোষ প্রতিক্রিয়ার প্রতি-মন্তব্য হিসেবে। যেহেতু (ধরে নেওয়া হয়) সারাদুনিয়ার খবর জানার পরও নিজের দেশ সম্পর্কে এমন অর্বাচীন মন্তব্য করতে সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করল না, তখন তাকে বিষয়টি ভদ্র ভাষায় মনে করিয়ে দিতে হলো। এবং সেটা আমিই করলাম। দেশ নিয়ে অহেতুক যুক্তিহীন সমালোচনা আমার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। সবসময় না হলেও বেশিরভাগ সময় আমি মুখ খুলে আমার যা বলার বলি। এ-রকম দুটি শ্রেণি আছে। একদল দেশে বসেই এসব বাখোয়াজে ব্যস্ত থাকে। আরেক দল বিদেশে দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে থেকে, যা মনে আসে তাই বলতে থাকে। এই প্রবাসী শ্রেণিটার উদ্দেশ্যে কখনও কখনও আমার বলতে ইচ্ছে করে, এতই যখন দেশের প্রতি ভালোবাসা, যত সমালোচনা দেশে এসে করো। বিদেশের মাটিতে বসে অমন বাগাড়ম্বর অনেকই করা যায়।
এ-ধরনের মানসিকতার লোকদের সাথে আমার খাঁটি বাংলায় কথা বলতে মন চায়। ‘মুই কী হনু’ অথবা ‘দুদিনের বৈরাগী ভাতেরে কয় অন্ন’ বললে সংক্ষেপে আমার মনোভাব প্রকাশ পায়। আরেকটু খুলে বললে, ‘কোথাকার কোন নওয়াবের ছাওয়াল এসেছেন, বাহে! নিজের জন্মভূমির কথা সাত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চইল বে!’ ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের অভিব্যক্তি থাকার একটাই অর্থ : সামান্য আরাম-আয়েশের স্বাদ পেয়ে নিজের শেকড় নিয়ে আজেবাজে কথা বলা এ-রকম দুদিনের মোল্লা সবকালেই ছিল।
এই যে সেদিন আরেক ম্যাডাম মানে এক সিনিয়র আপার সাথে দেখা। ম্যাডাম বলাই নিরাপদ। পাছে আপা ডাকলে তার সম্মানহানি হয়। শুনেছি, অফিসে সাম্প্রতিক পদোন্নতির পরপর যারা তাকে আগে আপা ডাকত, তাদের তিনি সেরফ ম্যাডাম ডাকতে বলে দিয়েছেন। সে-কারণে সামনে পড়লে ম্যাডাম ডেকে নিজের মান বাঁচাই। পাছে কী বলতে কী বলেন। কী দেখলাম তাকে কয়েক বছর আগে, আর কী রকম বদলে ফেলেছেন নিজেকে। যাকে বলে একেবারে আগাপাছতলা পরিবর্তন।
একটা অফিসিয়াল গেট-টুগেদারে পরিচিত কয়েকজন একসাথে হয়েছি। এ-ধরনের ফরমাল অনুষ্ঠানে মহিলাদের শাড়ি পরে আসাই প্রত্যাশিত। তো সেই ম্যাডাম, যিনি পারতপক্ষে অফিসেও শাড়ি না পরার পক্ষে একশত-একটি যুক্তি দাঁড় করাতে থাকেন, প্রমাণ হিসেবে সিজার অপারেশনজনিত তলপেটের কাটা দাগ পর্যন্ত দেখাবার জন্য প্রস্তুত থাকেন এবং তার দল ভারী করার জন্য সবসময় সমমনাদের উসকানি দিতে থাকেন, তিনি উদ্ভট ডিজাইনের এক কুর্তা-সালোয়ার পরে হাজির। আড়াই গজি ওড়না স্কুলের পোশাকের মতো চার-ছয় ভাঁজ করে গলা পর্যন্ত এমনভাবে তুলে রেখেছেন যে তাতে স্টাইল হলেও শালীনতা থাকে না। থাক, এই শালীনতা-সংক্রান্ত তর্ক। এ-নিয়ে বেশি কথা বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে।
তো, ম্যাডাম, এদিক-সেদিক চড়কির মতো ঘুরে আমাদের দলে এসে ভিড়লেন এবং কিছুদিন আগে তার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস যে প্রায় ভাইরালের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছিল, সে-বিষয়ে আমাদের কৌতূহলের জবাব দিতে গিয়ে খুব অহংকারী আর প্রগলভ হয়ে উঠলেন।
‘হুম, আমি তো বেশ কিছু ইংরেজি পাবলিকেশনের এডিটিংয়ের সাথে জড়িত ছিলাম/আছি।’ ঘাড় একদিকে উঁচু করে খানিকটা উদ্ধত ভঙ্গিতে ম্যাডাম বললেন।
‘ম্যাডাম, আপনার নিজের কোনো পাব্লিশড বই আছে?’ উপস্থিত একজন জানতে চাইল।
‘না, বেসিক্যালি আমি এখনও এডিটিংটাই করছি। তবে, আই হাভ আ প্ল্যান টু স্টার্ট রাইটিং ফিকশান। ফিকশান, পিউর ফিকশান। আই এম আ প্যাশিওনেট রিডার অফ ফিকশান।’
আমি পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবার কথা শুনছিলাম। সেই সাথে ম্যাডামের ফেসবুক স্ট্যাটাসের প্রশংসাও করলাম। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন,
‘আর, তাছাড়া, আমি বাংলায় লিখি না বা লিখতে চাই না।’
কথাটা তিনি বললেন কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই। আমি যেহেতু সবকিছু সামান্য দেরিতে বুঝি এবং এ-কারণে পরিচিত মহলে টিউবলাইট খেতাব পেয়েছি, তো, কিছু সময় পরেও আমার বোধগম্য হলো যে কথাটার লক্ষ্যবস্তু আর কেউ না। স্বয়ং আমি নিজে যে কি না এতক্ষণ তার স্ট্যাটাসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম। কারণ, উপস্থিতদের মধ্যে আমারই সেটি পড়া ছিল এবং তেমন আহামরি কিছু না হলেও তাকে খুশি করবার জন্যই আগ বাড়িয়ে কিছু বলেছিলাম। এখন তো দেখি, তিনি আমার শংসাবচনের একেবারে যাকে বলে কি না মোক্ষম জবাবটাই দিয়ে দিলেন। সেই পুরনো কৌতুকটার কথা মনে পড়ে গেল। একজন আরেকজনকে বলছে, সেদিন উনি আপনার খুব নিন্দা-মন্দ করছিলেন। তার কোনো উপকার করেছি বলে তো মনে পড়ে না, আরেকজনের মন্তব্য।
তো, এই হলো আমাদের স্বভাব। বাংলায় লিখেন না বলে আমাকে সরাসরি এই খোঁচা দেবার কারণ, আমি মূলত বাংলায় লিখি এবং প্রকাশিত লেখক হিসেবে স্থানীয় সাহিত্য পরিমণ্ডলে আমার মোটামুটি একটা পরিচয় আছে। ঈর্ষান্বিত তিনি হতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে নিজের মাতৃভাষা নিয়ে অবজ্ঞা বরদাস্ত করা সম্ভব নয়।
তবে তার মতো আরও আছে। আমার সাথে তাদের মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। আর তখন আমি নিজেকেই বলতে থাকি কেন এই অর্বাচীনদের সাথে আমার দেখা হতেই হবে। কথায় কথায় এরা স্বদেশ, স্বজাতি আর মাতৃভাষা সম্পর্কে এমন উন্নাসিক মনোভাব দেখায় আর অপমানসূচক কথা বলে যে তাদের জাত-পাত নিয়েই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করে। সব কালে, সব সমাজে এরা ছিল, আছে, থাকবে। এদের সম্পর্কেই তো মধ্যযুগের বিখ্যাত বাংলা কবি যা সিদ্ধান্ত দেবার দিয়ে গেছেন। আমার আর নতুন করে বলার কিছু নেই। ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’
যে ম্যাডাম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এত কথার অবতারণা, খেয়াল করে দেখলাম, নিজের খোলস পাল্টাতে পাল্টাতে তিনি তার মানসিক গঠনটাই আমূল বদলে ফেলেছেন। কাজের সূত্রে কদাচিৎ তার সাথে যোগাযোগ ছিল/হয়। দেশের বাইরে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে অনেকদিন লিয়েনে ছিলেন। কাজ যতটুকু করেছেন, অকাজের পরিমাণ তার চেয়ে বেশি। যারা তার সাথে ফেসবুকে আছে, তারা জানে যে বেশিরভাগ সময় তিনি এখানেই কাটাতেন/কাটান। দুই ছেলেমেয়ে আরেক দেশে আছে উচ্চশিক্ষার কারণে। ব্যবসায়ী স্বামীও তাদের সাথে। ফলে দেশে তিনি একা। তার একাকিত্বের যতটা সম্ভব তিনি এই ফেসবুকের উন্মুক্ত ময়দানে উন্মোচন করে দেন। সে-জন্য আমরা জানতে পারি, বেশিরভাগ সময় ঘরে ফিরে তার আর করার কিছু থাকে না। নিজের জন্য সামান্য কিছু খাবার আয়োজন করে তিনি ফেসবুক খুলে বসেন। যেদিন নতুন কিছু রান্না করেন, সেটার ছবির সাথে রেসিপি থাকে। যেদিন বাসি খাবার গরম করে খান, সেদিনও তিনি তার অবস্থার পক্ষে সাফাই তুলে দিন। আজ তিনি অফিসের কাজ করে ভীষণ ক্লান্ত তো আরেক দিন অন্য কোনো অজুহাত। সবসময় তার কিছু বলবার থাকে।
তার দেশে ফিরে আসার খবর জানতে পেরে যখন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম, উল্টো বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, দেশে ফিরে যাবার জন্য তিনি মোটেও উদগ্রীব নন। ওখানেই ভালো আছেন। ঢাকা শহরের জীবন তাকে ক্লান্ত করে তোলে। নোংরা, দূষিত, একঘেয়ে আর বিরক্তিকর। মানুষের ঘামের গন্ধ, গায়ের ওপর উঠে পড়া গাড়ি, অসহনীয় শব্দ দূষণ, ডেঙ্গু আর চিকনগুনিয়া। ইত্যাদি। ইত্যাদি। নিজের দেশের প্রতি তার এই নিখুঁত অভিযোগের লম্বা তালিকা দেখে হকচকিয়ে গিয়ে আমি আর কথা বাড়াই নি। নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি এই বলে, একেকজন মানুষ একেকরকম। ভ্যারাইটি ইজ দ্য স্পাইস অব লাইফ। বৈচিত্র্যই জীবনের সৌন্দর্য।
ম্যাডাম, ধরা যাক তার নাম আফরোজা, নানারকম অদ্ভুত আচরণের কারণে ইতোমধ্যে অফিসে মিসেস স্কেয়ারক্রো উপাধি পেয়েছেন। আড়ালে সবাই না-কি তাকে এই নামে ডাকে এবং দরকার ছাড়া পারতপক্ষে তার সামনে পড়তে চায় না। পড়লেই হয়েছে। তিনি তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক আর দাপ্তরিক যাবতীয় সমস্যার কাসুন্দি না-কি সুরে গাইতে থাকেন এবং বলতে থাকেন যে তিনি নানা ধরনের বঞ্চনার শিকার।
আমি এমনও বলতে শুনেছি, দীর্ঘদিন সেক্স-স্টারভেশনের কারণে তার মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটেছে। বিদেশে থাকার সময় স্বামীর সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বলে বাজারে একটি গুজব চালু আছে। তবে সেটার সত্যতা যাচাই করার সুযোগ হয়নি। সম্ভবত এটি সত্য নয়। কারণ, অধিকাংশ সময় তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলোতে স্বামীকে লটকে রাখেন মানে ট্যাগ করেন। আবার এমনও হতে পারে, লোকের চোখে ধুলা দেবার জন্যও এমনটা করতে পারেন। ঘটনা যাই হোক, কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। আগ বাড়িয়ে এসব কখনই শুনতে যাই না। কেননা, অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, যে বা যাদের সাথে আমি আরেকজন বা অন্যদের নিয়ে অহেতুক কুৎসা বা মন্দ কথা চর্চা করতে যাব, দুদিন ঘুরতে না ঘুরতে আমার সাথেই এমনটি ঘটবে।
আফরোজা ম্যাডামকে যেহেতু এড়িয়ে চলি, কাজেই অফিসের মিটিং-ফিটিং ছাড়া তার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগ কম। সেদিন, ওই সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আসার সপ্তাহ দুয়েক পরে মনে হয়, সিঁড়িতে দেখা হয়ে গেল। তিনি নামছেন। আমি উঠছি। মাঝখানের ল্যান্ডিং-এ থেমে তাকে সালাম দিলাম। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। সালামের জবাব দিলেন না দেওয়ার মতোই। তার মুখের অভিব্যক্তি জানান দিল তিনি কিছু বলতে চান। বলতে চান মানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তাই। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। আমার ধারণা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সত্য হয়ে দেখা দিল।
‘সাবিনা, তুমি আমার রুমে একবার আসবে। কথা আছে।’ বলে তিনি আমাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেলেন। পেন্সিল হিলের অশ্রাব্য খটখট আওয়াজ তুলে। সারাদুনিয়াকে জানান দিয়ে যে কোনো একজন মহারানি যাচ্ছেন। এই পেন্সিল হিলের বিষয়টা আমার কাছে এতটাই অভব্য মনে হয় যে এটা নিয়ে কথা বলতেও আমার রুচি অনুমোদন করে না।
যা হোক, ম্যাডাম তার রুমে যেতে বললেন বলেই গিয়ে হাজির হব কি না সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ নিজের সাথে তর্কযুদ্ধ চলল। তার সাথে আকস্মিক দেখা। তাই যেতে বললেন। হয়তো কথার কথা। তেমন জরুরি কিছু হলে তো ফোন করেই ডেকে নিতেন। আবার ভাবলাম, বলার পরেও না গেলে তার যা স্বভাব সুযোগমতো কোথাও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বসবে যে আমি সিনিয়রদের সম্মান করি না। ইত্যাদি। আর বেশি ভাবতে গেলে সিদ্ধান্তহীনতার চোরাবালিতে ডুবে যাবার আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, যাই, কী আছে কপালে। কী আর বলবেন। নিজের ঢাক পেটানো ছাড়া আর কিছু তো নয়। এ তো সবাই করে। মুখ বুজে শুনে আসি। ভাগ্য ভালো থাকলে কিছু গল্পের মশলা পেয়ে যেতে পারি। সেটাই বরং আমার লাভ।
এরপর দরজায় টোকা দিয়ে যেদিন ম্যাডামের রুমে ঢুকলাম, বুঝলাম খুব বাজে একটা সময় আমি এসে পড়েছি। তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। চোখ ফোলা এবং ভেজা। কিছুক্ষণ আগে যে তার ওপর দিয়ে ভয়ানক একটা ঝড় বয়ে গেছে সেটা বোঝার জন্য একবার তাকানোই যথেষ্ট। যেহেতু আমি ঢুকে পড়েছি, এখন এ-অবস্থায় বের হয়ে যাব কি না ভাবতেই তিনি আমাকে বসতে বললেন।
‘তুমি বসো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।’ বলে তিনি রুমের বাথরুমে ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণের জন্য তিনি আমার উপস্থিতি থেকে রেহাই পেলেন ভেবে আমার নিজের কাছেই ভালো লাগল। যত যাই হোক, ম্যাডামের এমন বিপর্যস্ত চেহারা দর্শন করে আমার মনটা বরং খারাপই হয়েছে। ভাবছি, কী এমন হতে পারে। স্বামীর সাথে ঝগড়া অথবা ছেলেমেয়েদের লম্বা অভিযোগ? কে জানে। মনে হয়, মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন। টেবিলে দুটো মোবাইল সেট পাশাপাশি রাখা। তিনি বাথরুমে ঢোকার পরই তার একটা ফোন ঝলমলিয়ে বেজে উঠল। টেবিলের অপর পাশ থেকেও বুঝতে পারলাম কলটা তার স্বামীর। ম্যাডাম তার সব ফেসবুক পোস্টে অবধারিতভাবে দুই ছেলেমেয়ে এবং স্বামীকে ঝুলিয়ে দেন যেটা অনেক সময় চোখের জন্য বেশ পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। খোলা ময়দানে সবসময় এমন পারিবারিক সম্প্রতি প্রদর্শনের তো প্রয়োজন নেই। মাঝে মাঝে ঠিক আছে। কিন্তু নিয়ম করে নয়।
এই হতচ্ছাড়া ফেসবুকের কথা কী আর বলা যায়। আধুনিক বিজ্ঞানের এই উদ্ভাবন উপকারের চেয়ে অপকারই করে যাচ্ছে বেশি। এর দায় অবশ্য ব্যবহারকারীর ওপরই বর্তায়। একটা ভালো জিনিসও অপপ্রয়োগ বা বাজে ব্যবহারের দোষে যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ফেসবুক নামের এই জিনিস তা হাড়েহাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে।
যা হোক, আপা বা ম্যাডাম যে নামেই তার কথা বলি, চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে এসে যখন চেয়ারে বসলেন, তখনও তাকে মলিন দেখাচ্ছিল। আমার এ-সময় চলে যাওয়াটাই উত্তম মনে হলো।
‘ম্যাডাম, কোনো কারণে আপনার মনটা খারাপ। আমি না হয় পরে আসব।’
‘না, না, তুমি বসো। ঠিকই ধরেছ। মনটা ভীষণ খারাপ। এ-সময় কারও সাথে কথা বলতে পারলে একটু হলেও হয়তো হাল্কা লাগবে। চা দিতে বলি।’ বলে তিনি স্টাফকে বেল চেপে ডাকলেন।
এরপর টোস্ট আর চা খেতে খেতে ম্যাডামের কাছ থেকে যা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যেদিন তিনি আমাকে তার রুমে আসতে বলেছিলেন, সেদিন নিশ্চয় অন্য কথা বলতে চেয়েছিলেন। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই কথার বিষয়বস্তু আলাদা।
আপার স্বামী তাদের দুই টিনএজ ছেলেমেয়ে নিয়ে বেশ কয়েক বছর সিডনিতে আছেন। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য দেশের ব্যবসাপাতি গুটিয়ে ওখানেই থেকে যেতে চান। সমস্যা হয়েছে আপার সরকারি চাকরি। চাইলেই তো আর এত সুবিধা-সম্মানের চাকরি ছেড়ে দেওয়া যায় না। আপার স্বামী এতদিন সামলে চলবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তার বয়স হয়েছে। নানা অসুখ-বিসুখ শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। এখন আর পেরে উঠছেন না। তাই তাকে চাকরি ছেড়ে পরিবারের সাথে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছেন। আপা কূল-কিনারা করতে পারছেন না।
‘যাই বলো, নিজের দেশে কত সম্মান নিয়ে চলি। একা থাকার কষ্ট ছাড়া আর সবকিছুই আমার জন্য ভালো। বৃদ্ধ বাবা-মাকেও যখন ইচ্ছে দেখতে যেতে পারি। পরের দেশে গিয়ে এ-বয়সে তেমন কিছু করতেও পারব না। ছেলেমেয়ে দুটো ভার্সিটিতে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে ওদের আলাদা জীবন হবে। তখন তো আবার আমরা একা হয়ে যাব। সেজন্য আমি আমার হাজব্যান্ডকেই বলছি দেশে চলে আসতে। সে আমার কথা শুনে খুব রেগে গেছে। রাগারই কথা। আমি সবকিছু অন্ধকার দেখছি।’
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ম্যাডাম কপালটা চেপে ধরলেন। এমন দারুণ সুযোগটা আমি হারাতে চাইলাম না।
‘কিন্তু, ম্যাডাম, আমি যতটুকু বুঝেছি, আপনি উন্নত দেশের জীবনটাই পছন্দ করেন। অনেকদিন দেশের বাইরেও ছিলেন। তাছাড়া, দেশে ঘরে-বাইরে কত রকম সমস্যা আর বিপদ! আমি অবশ্য দেশেই থাকতে চাই। পরের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে আর যা-ই হোক, গৌরবের কিছু নেই। তা সে যত নিশ্চিন্ত জীবনই হোক না কেন।’
বুঝতে পারলাম না, মোক্ষম জায়গায় আমি ঘা-টা দিতে পারলাম কি না? আপা, সামনে অবশ্য ম্যাডামই ডাকি, আমার কথা শুনে গভীর দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকালেন। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক!’

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতা
পরবর্তী নিবন্ধদেশের আরও ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে
আরও পড়ুন
spot_img

জনপ্রিয় সংবাদ

মন্তব্য