ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন দেখে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করা হয়। তবে টার্গেট করা গুলি ভেদ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ।
ফারুক শাহ:
১৫ আগস্ট : জাতীয় শোক দিবস
শোকাবহ ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির শোকের দিন। ইতিহাসের কলঙ্কিত কালো দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে সংঘটিত হয়েছিল এ কলঙ্কিত অধ্যায়। ৪৭ বছর আগে এ দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ক্ষমতালোভী নরপিশাচ কুচক্রী মহল। বাঙালির মুক্তির মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা।
বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুনর্বাসিত হতে থাকে। তারা এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা পাঁয়তারা করে। শাসকদের রোষানলে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও যেন নিষিদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ঠেকাতে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেছিল মোশতাক সরকার। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা হয়। বিচার শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ললাটে যে কলঙ্কতিলক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৩৫ বছরেরও বেশি সময় পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সেই কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চূড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর অনেক পরে খুনি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদকে ২০২০-এ ফাঁসি দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকায় আরও কয়েকজন খুনির সাজা এখনও কার্যকর করা যায়নি।
১৭ আগস্ট : সিরিজ বোমা হামলা দিবস
বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর এবং মৌলবাদী রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের একটি জঙ্গি সংগঠন পরিকল্পিতভাবে সারাদেশে সিরিজ বামা হামলা চালায়। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টায় ঢাকার ৩৪টিসহ দেশের ৪৫০টি স্থানে পাঁচ শতাধিক বোমা হামলা করা হয়। আধাঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এই সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত ও দু-শতাধিক মানুষ আহত হন। ৬৪টি জেলার মধ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলা বাদে অবশিষ্ট ৬৩টি জেলায় এই হামলা করা হয়। হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারি-আধা সরকারি স্থাপনায় বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। হামলার জায়গাগুলোতে জেএমবির জঙ্গিরা লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ তৎপরতায় এটি সবচেয়ে বড় ঘটনা।
২১ আগস্ট : গ্রেনেড হামলা দিবস
রক্তাক্ত ২১ আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের ভয়াল দিন। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে চালানো হয় নজিরবিহীন গ্রেনেড হামলা। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে হিংসার দানবীয় সন্ত্রাস আক্রান্ত করে মানবতাকে।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়োজিত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী শান্তি সমাবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এসে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীরা মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করলেও গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। ভাগ্যগুণে নারকীয় গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। ঘাতকদের প্রধান লক্ষ্য শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন দেখে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ১২ রাউন্ড গুলি করা হয়। তবে টার্গেট করা গুলি ভেদ করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। হামলার পরপরই শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তার তৎকালীন বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে। ২১ আগস্টের রক্তাক্ত ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। আহত হন পাঁচ শতাধিক। যাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ আজও ফিরে পাননি স্বাভাবিক জীবন। গ্রেনেডের স্পিøন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর দিকে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২৩ আগস্ট : আন্তর্জাতিক দাস ব্যবসা বিলোপ স্মরণ দিবস
আন্তর্জাতিক দাস ব্যবসা বিলোপ স্মরণ দিবস। অর্থাৎ দাসপ্রথা বিলোপ দিবস। দাসপ্রথাকে মানব ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় বলা যায়। এখন দাসপ্রথাকে যত অদ্ভুতই মনে হোক না কেন, এক সময় এটিই ছিল স্বাভাবিক। বিত্তশালীদের আভিজাত্যের প্রতীক ছিল দাস। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ঘরেও দাস থাকত। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ আগস্ট প্রতি বছর বিশ্বে এ দিবসটি পালিত হয়।
১৭৯১ সালের ২২ ও ২৩ আগস্ট বর্তমান হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক অঞ্চলে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীতে ব্রিটেন ১৮০৭ সালে ও যুক্তরাষ্ট্র ১৮০৮ সালে তাদের আফ্রিকান দাসদের মুক্তি দেয়। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে ১৮৩৩, ১৮৪৮ ও ১৮৬৫ সালে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে।
গ্রিক সভ্যতা থেকে দাসপ্রথার উদ্ভব হলেও রোম সভ্যতা, বৌদ্ধযুগসহ সভ্যতার সকল পরতে-পরতে দাসত্ব প্রথার উপস্থিতি ছিল। প্রাচীন বাংলাসহ ভারত উপমহাদেশেও দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। ইংরেজ আমল পর্যন্ত এদেশে দাস ব্যবসা চলেছে। বিশ্বব্যাপী দাস ব্যবসার বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল আফ্রিকান নিগ্রো দাসের। প্রচ- শক্তি ও সুঠাম দেহ-ই সে-যুগে নিগ্রোদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়। তখন বিপুল সংখ্যক নিগ্রোদের জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের বেশিরভাগকে বিক্রি করে দেওয়া হতো ইউরোপের বাজারে।
বর্তমান বিশ্বের প্রধান পরাশক্তি আমেরিকাই ছিল দাস নির্যাতনের তীর্থস্থান। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই গ্রেট-ব্রিটেন থেকে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনে দাসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার পরও দাসদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অবশেষে দাসপ্রথা বিলুপ্তির আন্দোলনে ১৮৬১ সালে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই গৃহযুদ্ধে তৎকালীন আমেরিকার জনপ্রিয় নেতা (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) আব্রাহাম লিঙ্কন দাসদের এই অবস্থান নিয়ে ১৮৬৩ দাসপ্রথাবিরোধনীতি ঘোষণা করেন।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। দাসত্বের কবল থেকে মুক্ত হয়ে দাসরা তাদের মানবিক অধিকার ফিরে পেতে ১৭৯১ থেকে ১৮০৩ পর্যন্ত হাইতিতে বিদ্রোহ করে। ১৭৯১ সালের ২২ আগস্ট দাসদের আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং দাসকর্তৃক ১ হাজার ফরাসি প্রভু হত্যা করা হয়। মুহূর্তেই দাসদের এ আন্দোলন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
দিবসটি সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে উদযাপন করা হয় হাইতিতে। তার পরের বছর ১৯৯৯ সালে সেনেগালে আনুষ্ঠানিকভাবে যাপন করা হয়। বর্তমানে এটি একটি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালন করা হয়।