আমরা কতটুকু করতে পেরেছি এবং ভবিষ্যতে কী করব; তা আমরা শুধু জনগণকে বলি, অন্য কাউকে নয়।
বিশেষ প্রতিবেদন: ৬ আগস্ট; গণভবনের খোলা আঙিনায় সাদা কাপড়ের প্যান্ডেল ঘেরা সভামঞ্চ। চারিদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বতঃস্ফূর্ত নানা বয়সের বিপুল নেতাকর্মীদের আসন উপচেপড়া ভিড়। ঠিক সেখানেই সকাল সাড়ে ১০টায় ‘শত সংগ্রামে অজস্র গৌরবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে’ এই স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বিশেষ বর্ধিত সভা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রাণবন্ত সভা শেষ হয় বিকাল সাড়ে ৫টায়।
সকালে সূচনা ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জনগণের শক্তিকেই তার দলের মূল শক্তি উল্লেখ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কেবল জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ। জনগণের শক্তিই আওয়ামী লীগের শক্তি। আওয়ামী লীগের কোনো প্রভু নেই, জনগণই আওয়ামী লীগের প্রভু। আমরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।’
বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অংশ নেন। দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌরসভা ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭-এর ২৩ জুন এ ধরনের সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সূচনা বক্তব্যের আগে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলতে বলেন, গণভবনের মাটি আজ ধন্য আপনাদের আগমনে। আমি সত্যি আনন্দিত। করোনার কারণে সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ দীর্ঘদিন হয়নি।
বিশেষ এ বর্ধিত সভায় প্রায় ৮ ঘণ্টায় বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ৪৩ জন তৃণমূল নেতা বক্তব্য রাখেন। তিনি সবার বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং নোট করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আপনারা বলতে চাইলে আরও বলেন আমি শুনতে পারব। রাত হলেও অসুবিধা নাই। সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে দুপুরের খাবার এবং নামাজের বিরতির পর ঠিক ৩টায় সভা শুরু হয়। সভার শুরুতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে দলের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শোক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ এমপি এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম।
সূচনা ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের সময় দেশবাসীর কাছে আমাদের অঙ্গীকার করে থাকি। আমরা কতটুকু করতে পেরেছি এবং ভবিষ্যতে কী করব; তা আমরা শুধু জনগণকে বলি, অন্য কাউকে নয়। আমি চাই সবাই এটা মাথায় রেখে একসঙ্গে কাজ করবেন।’ সাড়ে ১৪ বছরের অর্জন তৃণমূলের মানুষের সামনে তুলে ধরতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশনাও দেন। তিনি দলকে শক্তিশালী করতে বলেন এবং জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে আজ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ প্রদত্ত ‘উন্নয়নশীল দেশের’ মর্যাদা পেয়েছে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে। তিনি বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশের জনগণকে প্রশ্ন করবেন। কারণ তারাই (জনগণ) ভোটের মালিক। তারা যদি চায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাবে, তাহলে নৌকা মার্কায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে হবে। আর আওয়ামী লীগ ভোট পেলেই এটা সম্ভব হবে। তাছাড়া অন্য কেউ এটা করবে না। আর সকলের জন্যই কাজ করব, এটাই আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
‘আওয়ামী লীগ প্রতিটি মানুষের জন্য কাজ করেছে; এর আগে আর কেউ জনগণের জন্য চিন্তা বা কাজ করেনি’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের এই বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং একই সাথে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে বলেন। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব। আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় বলে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। তার দল একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভাগ্যও বদলে দিয়েছে। কতিপয় লোক আছে যারা চোর, দুর্নীতিগ্রস্ত ও খুনি। আসলে খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া ও জিয়াউর রহমান সকলেই খুনি। দেশের মানুষ তাদের হাতে নিরাপদ নয়, দেশও নিরাপদ নয়।’
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘তাই আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ (আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী) ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ যেসব উন্নয়ন কাজ করেছে তার সবগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একসময় ‘মঙ্গা’ চলত রংপুরে, যার জন্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হতো সেখানকার লোকদের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেখানে কোনো মঙ্গা নেই, নেই দুর্ভিক্ষও। এর কারণ হলো আওয়ামী লীগ, যে দলের প্রতিষ্ঠা করছেন জাতির পিতা।’
বিকালে সমাপণী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ দলীয় প্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সভায় উপস্থিত সকল নেতাকর্মী হাত তুলে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত সাড়ে ১৪ বছরে প্রতিটি এলাকায় যেসব উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে তা জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য তার দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশে এসব উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপি অগ্নিসংযোগ, মানুষ হত্যা, অবরোধ কর্মসূচিসহ নানা অপকর্ম করেছে। তবে, কোনো আন্দোলনই দেশ ও জনগণের ক্ষতি করতে পারবে না, কারণ, আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন এবং জনগণের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। গুজব ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো কারো কাছে মাথা নত করে না।
বিশেষ বর্ধিত সভায় সূচনা বক্তব্যে আগামী নির্বাচনের জন্য তৃণমূলের নেতাদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি বলেছেন, শপথ নিন, প্রস্তুত হোন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, অনেক রক্তঝরার বাংলাদেশের পতাকা আমরা পাকিস্তানের বন্ধুদের হাতে তুলে দেব না।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আমাদের আস্থার বিশ্বাসযোগ্য ঠিকানা। ভয় নেই, শেখ হাসিনা আছেন। আমরা তার নেতৃত্বে এগিয়ে যাব, আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের বন্দরে পৌঁছাব। যতকিছুই করুক, সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে বিজয়ের বন্দরে আমরা পৌঁছাব।
ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগের প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা এখন এক সংকট সংকুল দুর্গম পথের যাত্রী। আবারও ষড়যন্ত্র চলছে, সন্ত্রাস চলছে। আবারও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্মকালের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হুমকির মুখে। আবারও আমাদের পতাকা হুমকির মুখে।
তিনি বলেন, এ-কথা স্বীকার করতেই হবে, কিছু দুঃখ-কষ্ট আছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি। কিন্তু এগুলো আমাদের সৃষ্টি নয়, আমরা শাস্তি পাচ্ছি। বড় বড় দেশ এসব সংকট, দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। শেখ হাসিনার মতো নেতা আছেন বলেই আমরা এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এই দুর্দিন, দুঃসময় কেটে যাবে। বাংলাদেশ আবারও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সেতুমন্ত্রী বলেন, যত বাধা আসুক, ষড়যন্ত্র আসুকÑ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেন না। তিনি মাথানত করতে জানেন